বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সীরাত বিষয়ক শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ-রচনা :
বিশ্বের
প্রথম ঐক্য ও শান্তি সংঘ ‘হিলফুল ফুযূল’
Hilful Fujul is the first
Organization of Unity and Peace in the world
حلف الفضول هى أول
منظمة الإتحاد والأمن فى العالم
সংকলনে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
১. অবতরণিকাঃ
সমস্ত প্রশংসা মহান প্রভুর জন্য যিনি, সহনশীল ধর্মের
অনুসারী করে সৃজন করেছেন। দুরূদ-সালাম ও শান্তি বর্ষিত হউক মহান চরিত্রের অধিকারী, সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও শান্তি প্রতিষ্ঠাকরী ঐক্যের
মশালবাহী রাসূল (সাঃ) এর প্রতি এবং সকল সাহাবা (রাঃ) গণ ও শান্তিকামী সকল আপামর
জনসাধারণের প্রতিও।
সম্মানিত সূধী, ঐক্য ও শান্তি কামী বিজ্ঞমহল! ইসলাম হলো মহান
আল্লাহর প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা। তথা Islam is the complete of code of life পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এবং ইহার বাস্তব রূপায়নে
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর অনন্য চরিত্র মহিমা যুগে যুগে মানুষকে সত্য-সুন্দর জীবনের দিকে
আকর্ষণ করেছে। বর্তমান বহুদ্বাবিভক্ত, সংঘাত-সঙ্কুল, অশান্ত বিশ্বের মুসলমানদের ভয়াবহ ও করুন
বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণ, স্বমর্যাদায়
পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে কল্যাণ ও শান্তির শ্রেষ্টতম দিশারী, অনুপম মহান চরিত্রের অধিকারী রাসূল (সাঃ) এর পূত-পবিত্র জীবন-চরিত অনুসরণ ও
বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।
রাসূল (সাঃ) এর আগমনের পূর্ব মুহুর্তে আরব উপ-দ্বীপের মানব
সভ্যতা ও সংস্কৃতির এতই অধঃপতন হয়েছিল যে, স্মরণ হলে
মানবকুল আৎকে ওঠে এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ার উপক্রম হয়। যার কৃয়দাংশ ইসলামী রেঁনেসার কবি ‘ফররুখ আহমদের’ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে :
‘‘যখন মানবতা হয়েছে বিদায়,
তখন তুমি এসেছিলে এ ধুলার ধরায়।
পশুর মত হয়েছিলাম মোরা
না বুঝিতাম মোদের মান,
যথায় তথায় এ মস্তককে
করেছি শুধু অপমান। ’’
সেই সময় মানব নামীয় জীবগুলো নিজ সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতে ও হত্যা করতে
কুন্ঠাবোধ করত না। মান-ইজ্জত, সম্মান-সম্ভ্রম হরণে বিচলিত হতো না। একতা-ঐক্যতার লেশমাত্র ছিলনা। গোত্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ অব্যাহত রাখতে ও হানাহানীতে ছিল খর্গ হস্ত। সামাজিক জীবনে অশান্তি-বিশৃংখলা, জন-জীবনে জীবনহানী, অনিরাপত্তা, অরাজকতা ও
নীতিহীনতার দাবানল উধ্বগিরণ ও অগ্নীঝড় বইছিল সর্বত্রে। ব্যবসায়ী বণিক, পর্যটক ও কারিগরদের হেফাজত ও সাহায্য-সহযোগিতার কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এমনি দুর্বিসহ পরিস্থিতির ক্রান্তিলগ্নে একদল
উৎসাহদীপ্ত, সাহসী, শান্তি-সৌহার্দ্য
প্রিয়, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন, সভ্য ও অভিজাত শ্রেণীর ‘ফুদায়েল’ গণ শান্তি প্রতিষ্ঠা, সাহায্য-সহযোগিতা, একতা-ঐক্যতা ও মহানুভবতা মূলক পারস্পারিক
চুক্তিতে আদ্ধের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেণ ‘হিলফুল ফুযূল’ এর।
২. পরিচিতিঃ
حلف (হিলফুন) আরবী
শব্দ। অর্থ হলো : পারস্পারিক
সহযোগিতা ও অঙ্গীকার। [লিসানুল আরব : ২/৯৬৩]। সুদূর অতীতে ‘আল-ফাদল’ নামক কয়েকজন
শান্তি প্রিয় লোকের উদ্যোগে হিজাযে বিশেষত মক্কা-মুয়াজ্জমায় সামাজিক শান্তি-শৃংখলা
ও জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাই ইতিহাসে ‘হিল্ফুল ফুযূল’ নামে প্রসিদ্ধ।
আল-ফুদাইল ইবন্ হারিছ আল-জুরহুমী, আল-ফুদাইল ইবন্
ওয়াদ’আ আল-কাতুরী ও আল-মুফাদ্দাল ইবন্ ফাদালা আল-জুরহুমী একতাবদ্ধ হয়ে এই মর্মে
অঙ্গীকার করেণ যে, তারা মক্কায় কোন স্বৈরাচারী যালিমকে অবস্থান
করতে দিবেন না। তারা আরো বলেন যে, আল্লাহ মক্কাকে যেই মর্যাদা দিয়েছেন তাতে এইরূপই হওয়া উচিত। [আল-কামিল : ১/৫৭০]।
এই সেবাসংঘটি মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্বের। পরবর্তীতে কালের আবর্তনে ইহা হাঁরিয়ে যায়। আরবের মধ্যে শুধুমাত্র ইহার নামটিই স্মরণীয় হয়ে
থাকে। এক পর্যায়ে আরব
গোত্রসমূহের মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও হানাহানির ফলে, বিশেষ করে ফিজার যুদ্ধে বহুসংখ্যক জীবনহানী ঘটলে এবং সামাজিক জীবনে
শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে কিছু সংখ্যক লোকের মনে ‘হিলফুল ফুযূলের’ কথা জাগ্রত হয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা বহাল করার
জন্য উক্ত সংঘের পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয়।
সুতরাং রাসূল (সাঃ) এর পিতৃব্য যুবাইর ইবন্ আব্দুল মুত্তালিবের অনুপ্রেরণায়
আব্দুল্লাহ ইবন্ জুদ’আনের বাড়ীতে সমবেত হয়ে ফিজার যুদ্ধের চার বৎসর
পর, মহানবী (সাঃ) এর নবুওয়াত লাভের বিশ বৎসর পূর্বে যুল-ক্বাদা মাসে ‘হিলফুল ফুযূল’ নামক সেবাসংঘ পুনর্গঠিত হয়। ইহা আরবদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ও প্রশিদ্ধ
চুক্তি হিসাবে বিবেচিত ছিল। [সীরাতুন-নাবাবীয়্যাহ
: ১/১৩৯-৪০, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/২৭০]।
মানব কল্যাণ ও উৎপীড়িতদের সাহায্য এবং অত্যাচার প্রতিরোধে কৃত শান্তি চুক্তি
সম্পর্কে যুবাইর ইবন্ আব্দুল মুত্তালিব বলেন :
إِنَّ الْفُضُوْلَ تَحَالَفُوْا وَتَعَاهَدُوْا * أّنَّ لَا يُقِيْمَ بِبَطْنِ مَكَّةَ ظَالِمٌ
أَمْرٌعَلَيْهِ تَعَاهَدُوْا وَتَوَافِقُوْا * فَالْجَارُوَالْمُعْتَرُّ فِيْهِمْ سَالِمٌ
‘ফযলেরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো যে, মক্কায় কোন অত্যাচারীর
ঠাই হবে না। এই বিষয়ে তাঁরা দৃঢ়ভাবে
অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো যে, এখানে মক্কাবাসী ও বহিরাগত সকলে নিরাপদ থাকবে। [সীরাতুন-নাবাবীয়্যাহ : ১/১৩৯-৪০, আল-বিদায়া
ওয়ান-নিহায়া : ২/২৭০]।
৩. মানব জীবনে একতা-ঐক্যতার প্রয়োজনীয়তাঃ
মুসলমানদের সামাজিক, জাতীয় ও সমষ্টিগত জীবনের কল্যাণের শক্তির উৎস
হলো তাক্বওয়া ও একতা-ঐক্যতা। তাক্বওয়া ও ঐক্যের শক্তির বলে বলিয়ান হয়েই সারা বিশ্ব শাসন করেছিল। শিক্ষা-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির উন্নতি সাধন করেছেন। সামাজিক শক্তি, নেতৃত্ব ও আর্থীক ভাবে ছিলেন স্বনির্ভর। পৃথিবীর সকল পরাশক্তিই ছিল তাদের পদতলে। এসব কোন রূপকথার আজব কাহিনী নয়। এমনটিই ছিল ঐতিহ্যবাহী মুসলমানদের গৌরবোজ্জল
সোনালী যুগের ইতিহাস।
কিন্তু আজ অত্যন্ত আফসোসের সাথে, দুঃখ ভরাক্রান্ত
ভগ্ন হৃদয়ে বলতে বাধ্য যে, মুসলমানদের ভিতর আল্লাহর আহ্কাম ও রাসূল (সাঃ)
এর আদশের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং একতা-ঐক্যতা নেই। নেই সামাজিক শক্তি, নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। বাসা বেঁধেছে দুনিয়া পুজারী, ভোগবাদী, স্বার্থবাদী, অর্থলোভ, ঐক্যহীনতা ও
প্রতিহিংসার। এহেন অধঃপতনের ফলে
প্রতিটি মুসলিম জনপদই নির্নমভাবে বিপর্যস্ত, লাঞ্চিত, নির্যাতীত, নিপীড়িত, পদদলিত ও অপমানিত। অভিশপ্ত কালো এই অধ্যায় থেকে উত্তরণে পরস্পর
মতানৈক্যতা-ঐক্যহীনতা, দীনতা-হীনতা ও হীনমন্নতা, বিচ্ছিন্নতা অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গোঁড়ামী, সংকীর্ণতা ও উগ্রতা পরিহার করে ক্ষুদ্র ও ব্যক্তি স্বার্থের পরিবর্তে জাতীয় ও
বৃহৎ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক শান্তি-শৃংখলা, সাম্য-মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, উদারতা-সহনশীলতা ও একতা-ঐক্যতার কোন বিকল্প নেই।
এব্যাপারে ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআনে ধ্বনিত হচ্ছে :
﴿وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا﴾
আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না ’’ [সূরা আল-ইমরান : ১০৩]।
অনুরূপ হাদীসেও রাসূল (সাঃ) উম্মতকে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করত: একতাবদ্ধ
জীবন-যাপনের জন্য বিশেষ গুরুত্বারূপ করেছেন। [সহীহ্ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাবু বয়ানি খিলালিল মুনাফিক ১/৯৭]।
৪. হিলফুল ফুযুল সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) এর উক্তিঃ
হিলফু ফুযুলের শান্তি চুক্তি ও অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে রাসূল (সাঃ) স্বয়ং উপস্থিত
ছিলেন। তখন তিনি বিশ বৎসর বয়সী
ছিলেন। নবুওয়ত প্রাপ্তির একসময়
তিনি এ সম্পর্কে এরশাদ করেণ
لَقَدْ شَهِدْتُ عُمُوْمَتِىْ حِلْفًا فِيْ دَارِ عَبْدِ اللهِ بْنِ جُدْعَانَ مَا أُحِبَّ أَنَّ لِيْ بِهِ حُمْرَ النَّعَمِ، وَلَوْدُعِيَتْ بِهِ فِي الْإِسْلَامِ لَأَجْبُتُ
আব্দুল্লাহ ইবন্ জুদ’আনের গৃহে শপথ অনুষ্ঠানে আমি আমার পিতৃবর্গ
গণের সাথে অংশ গ্রহন করেছি। তার বিনিময়ে আমাকে লাল বর্ণের উষ্ট্রী প্রদান করা হলেও আমি তাতে সন্তুষ্ট হবো
না। ইসলামী সমাজেও যদি কেহ
আমাকে উহার দোহাই দিয়ে ডাকে তবে, আমি অবশ্যই সাড়া দিব। অর্থাৎ : যদি কোন অত্যাচারিত ব্যক্তি হিল্ফুল
ফুযুলের সদস্যগণকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে তবে, আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দিব। [মুস্তাদরাকে হাকীম :
২/২২০,
মুসনাদে আহমাদ : ১/১৯০ ও ১৯৪]।
৫. হিল্ফুল ফুযুলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য / প্রতিষ্ঠাকালীন প্রতিজ্ঞাসমূহঃ ফুদালাগণ
নিম্নবর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে চুক্তিবদ্ধ হন। যথাঃ
১. আমরা দেশ ও সমাজ থেকে অশান্তি দূর করবো।
২. আমরা বহিরাগতদেরকে রক্ষা করবো।
৩. আমরা নিঃস্বদিগকে সাহায্য করবো।
৪. আমরা শক্তিহীনদের উপর শক্তিবানদের অত্যাচার প্রতিহত করবো এবং
৫. পাওনাদারদের প্রাপ্য আদায় করে প্রাপকের নিকট হস্তান্তর করবো (৫নং বর্ধিত
সংকলক) [সীরাত রাহমাতুল্লিল আ’লামীন পৃঃ ৪৩]।
৬. একতা-ঐক্যতা, সাংগঠনিক জীবনের তাৎপর্য ও উপকারিতাঃ
একক ও ব্যক্তি জীবনের চেয়ে সাংগঠনিক জীবনই উত্তম। সাংগঠনিক জীবনে সমাজে শান্তি-শৃংখলা, জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তাক্বওয়া ও কল্যাণের ভিত্তিতে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে যে
কোন কর্মসূচীতে গভীর আত্ম বিশ্বাস, এস্তেকামতের তথা
দৃঢ়তার সাথে অব্যাহত গতিতে সম্মুখ পানে অগ্রসর হলে, মহান আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য-সহযোগিতা আসবেই ইন-শা-আল্লাহ। আর আল্লাহ দ্রোহী শক্তির দোষর ইসলাম বিদ্ধেষী ও
অপরাধ রাজ্যের কীটদের মজবূত ভিত্তিও চুর্ণবিচুর্ণ হযে ভীতু হয়ে যাবে। সর্বপরি সকলেই সমীহ করবে। নির্যাতিতরা উপকৃত হবে, অধিকার বঞ্চিতরা ফিরে পাবে ন্যায্য অধিকার। সম্মানিরা এবং সর্বস্তরের মানব ফিরে পাবে
হারানো মান-সম্মান। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত
হলো ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক সংঘের। তাই এই সেবা সংঘের প্রচেষ্টায় সমাজে অত্যাচারির
অত্যাচার-অবিচার বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছিল। মানুষের যাতায়াত হয়েছিল নিরাপদ।
* সম্মানিত সূধী মহলের তন্দ্রাচ্ছন্নতা দূরীকরনার্থে নিম্নে দু’টি বিবরণ উল্লেখ করছি :-
(ক) ইসলাম পূর্ব যুগে একদা খাছ’আ গোত্রীয় জনৈক ব্যক্তির
পরমা সুন্দরী কন্যা দুঃচরিত্র লম্পট কর্তৃক অপহরিত হলে ‘হিলফুল ফুযুল’ এর সক্রিয়, সাহসী ও শান্তি
প্রিয় সদস্যগণ অপহরণকৃত কন্যাকে উদ্ধার করে পিতৃস্নেহের নিকট ফিরিয়ে দেন।
(খ)
যুবাইদ গোত্রীয় জনৈক ব্যক্তি, ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্যে পন্য-সামগ্রী নিয়ে মক্কায় পৌছার পর তা আস ইবন্ ওয়াইলের
কাছে বিক্রি করে। কিন্তু সে মূল্য পরিশোধ
না করে আত্মসাৎ করে। আরবীয় আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ‘হিলফুল ফুযূলে’ এর সদস্যগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ক্রেতা মালের সূলভ মূল্য দিতে বাধিত হয়। এ ছাড়াও সত্যের প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিতের
সাহায্যের বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। [আল-বিদায়া
ওয়ান-নিহায়া : ২/২৯১ -- ২৯২]।
৭. একতা-ঐক্যতাহীন, অসাংগঠনিক জীবনের ভয়াবহ পরিণতি ও অপকারিতাঃ
তাক্বওয়া ও ঐক্যহীন দলছুট বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি ইহ-লৌকি ও পার-লৌকিক
জীবনের অঙ্গন, চিন্তা-চেতনার প্রতিটি শাখা-পল্লবে, অমানিষার ন্যায় কালো থাবার দ্বার প্রান্তে উপণিত। আত্মগৌরব, প্রতিহিংসা, অর্থ ও ক্ষমতার লোভ, ক্ষুদ্র ও বহু দলে বিভক্ত মনিষীগণ ভয়াবহ
পরিণতির বেড়াজালে আক্রান্ত।
এব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে :
﴿وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾
আর তোমরা সেই সব লোকদের মত হয়ো না, যারা ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়েছে; এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নির্দেশ পাওয়ার পরও
মতবিরোধে লিপ্ত হয়ে আছে, তাদের জন্য কঠোর ও লাঞ্চনাদায়ক শাস্তির
ব্যবস্থা রয়েছে’’। [সূরা আল-ইমরান : ১০৫]।
আবু যর গিফারী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন :
যে ব্যক্তি জামা’আত ত্যাগ করে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে যেন ইসলামের রজ্জু হতে গর্দানকে আলাদা করে নিল। [আর-রাওদুল উনুফ
: ১/৮২,
মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ]।
অনুরূপ রাসূল (সাঃ) আরো এরশাদ করেন
يَدُ اللهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ وَمَنْ شَذَّ شُذَّ إِلٰي النَّارِ
জামা’আতের প্রতি আল্লাহর রহমতের হাত প্রসারিত থাকে। যে জামা’আত ছাড়া একা চলে, সে তো একাকী দোযখের পথে ধাবিত হয়। [সুনান তিরমিযী হা/নং ২১৬৭, আর-রাওদুল উনুফ : ১/৮২, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ]।
৮. বর্তমান সময়ে হিলফুল ফুযূলের বৈধতাঃ
হিলফুল ফুযূলের বৈধতা এখনও বিদ্যমান। রাসূল (সাঃ) এর পূর্বোক্ত হাদীস :
وَلَوْدُعِيَتْ بِهِ فِي الْإِسْلَامِ لَأَجْبُتُ
ইহার প্রমান। তাঁর কথার অর্থ ছিল, যদি কোন অত্যাচারিত ব্যক্তি হিল্ফুল ফুযূলের সদস্যগণকে সাহায্যের জন্য আহ্বান
করে আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দিব। [মুস্তাদরাকে হাকীম : ২/২২০, মুসনাদে আহমাদ : ১/১৯০ ও ১৯৪]।
কেননা সত্যের প্রতিষ্ঠা করতে এবং নির্যাতিতদের সাহায্য করতে
ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে। অতএব উক্ত সংঘ দ্বারা তার শক্তিই বর্ধিত হবে। রাসূল (সাঃ) জাহেলী যুগের গোত্রে-গোত্রে
যুদ্ধ-সংঘাতে শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে মিত্র (হালীফ) পক্ষকে সহায়তা করার সংঘ অবৈধ
ঘোষণা করছেন। ইসলামে কেবল এই জাতীয়
জাহেলী আহ্বানকে নিষিদ্ধ করেছে। অন্যথায় হিলফুল ফুযূলের আবেদন এখনও অবশিষ্ট আছে। [আর-রওদুল উনুফ
: ১/৮২]।
অতএব এই জাতীয় স্বৈরাচার, অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধ কল্পে হিলফুল ফুযূলের মত কল্যাণধর্মী সংঘের
প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ভাল ও কল্যাণময় কাজের সূচনার পুরস্কার ঘোষণায় মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেন :
مَنْ سَنَّ سُنَّةَ خَيْرٍ فَاتُّبِعَ عَلَيْهَا فَلَهُ أَجْرُهُ وَمِثْلُ أُجُورِ مَنِ اتَّبَعَهُ غَيْرَ مَنْقُوصٍ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ سَنَّ سُنَّةَ شَرٍّ فَاتُّبِعَ عَلَيْهَا كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهُ وَمِثْلُ أَوْزَارِ مَنِ اتَّبَعَهُ غَيْرَ مَنْقُوصٍ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْئً
কেউ যদি কোন ভাল কাজের প্রচলন করে আর তা অনুসৃত হয়, তবে তার কাজের ছওয়াব তো সে পাবেই উপরন্তু যারা তার অনুসরণ করেছে তাদের ছওয়াবের
সমান ছওয়াবও পাবে। কিন্তু তাতে
অনুসরণকারীদের ছওয়াবের মধ্যে কোন ঘাটতি হবে না। আর যদি কেউ কোন মন্দ কাজের প্রচলন ঘটায় এবং যদি
তা অনুসৃত হয়, তবে তার উপর নিজের গুনাহ এবং যারা তার অনুসরণ
করেছেন তাদের সকলের গুনাহের দায়িত্বও বর্তাবে। কিন্তু এতে অনুসরণকারীদের নিজের গুনাহের মধ্যে
কোন ঘাটতি হবে না। [সহীহ মুসলিম ৬৫৫৬, তিরমিযী ২৬৭৫ (ই. ফা), ইবনু মাযাহ ২০৩, কিতাবুল ইল্ম, বাব : সৎ পথে / ভ্রান্ত পথে ডাকার ফলাফল। মুসলিম : কিতাবুল ইল্ম, বাব : মানা সান্না সুন্নাতান হাসানাতান ফালাহু আজরুহু ওয়া আজরু মান আমিলা’]।
৯. যবাণিকাঃ
পরিশেষে তাক্বওয়া ও ঐক্যের ভিত্তিতে অনুসরণীয় সচ্ছ-নির্মল, সুন্দর, কোলষমুক্ত, নিরঙ্কুস ভাবে
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের নিমিত্তে, শান্তি-শৃংখলা, নিরাপত্তা, সম্মিলিতভাবে ‘আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠায় উদারচিত্তে আন্তরিকতার সাথে গভীর
আত্মবিশ্বাস ও মনোবল নিয়ে সর্বস্তরের মানবমন্ডলীকে, বিশেষত আলেম সমাজকে ইস্পাত, লৌহ মানবের ন্যায় শক্ত
ভুমিকা রাখতে হবে। সেই সাথে সমাজের প্রতিটি
পর্যায় থেকে অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার মূলোৎপাটনে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে
হবে।
মহান প্রভু আমাদের সকলকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, আর্ন্তজাতিক জীবনসহ রান্না ঘর থেকে সংসদ পর্যন্ত
সর্বত্রই ইসলাম বাস্তবায়ন করার এবং স্বনির্ভরতা, সর্বাঙ্গীন সফলতা, কল্যাণ-মঙ্গল, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ ও পঠিতব্য বিষয়ে আমল করার
তাওফীক দান করুন, আমিন।
১০. সহায়ক গ্রন্থাবলী / নির্ঘন্টঃ
১. আল-কুরআন।
২. আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া (পৃথিবীর আদি-অন্ত ইতিহাস) ইবন
কাছীর (রাহি.)।
৩. সীরাত রাহমাতুল্লিল আ’লামীন।
৪. সীরাত বিশ্বকোষ ৪র্থ খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত।
৫. পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভার্চুওয়াল লাইব্রেরী ; আল-মাকতাবাতুশ শামিলা।
৬. সীরাত ইবনে হিশাম, ইবনে হিশাম (রাহি.)।
৭. আর-রাহীকু ওয়াল মাখতুম, আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রাহি.)।
৮. নবীয়ে রহমত, আল্লামা আবুল
হাসান আলী নদভী (রাহি.)।
৯. ইউকিপিডিয়া ; ইন্টারনেট
ভিত্তিক মুক্তবিশ্বকোষ।
১০. বিভিন্ন প্রবন্ধ সমূহঃ।