Saturday, 9 June 2018

‘অনুস্মরণীয় উত্তম ও আদর্শ মানব তথা সফল মু’মিনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী’


দারসুল কুরআন
আল-কুরআনের সূরা আল-মুমীনূন’-এর আলোকে
অনুস্মরণীয় উত্তম ও আদর্শ মানব তথা সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী
মুফ্তি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
 

দারসের আলোচ্য বিষয় / শিরোনাম ঃ
আল-কুরআনের ১৮ নং পারা, ২৩ নং সূরাতুল মুমীনূন এর ০১ থেকে ১১ নং পর্যন্ত আয়াতগুলোর আলোকে : অনুস্মরণীয় উত্তম ও আদর্শ মানব তথা সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী

অবতরণিকা ঃ
সকল স্তুতি ও ভূয়ুশী প্রশংসা মহান ¯্রষ্টার জন্য যিনি মুমিনদের জন্য আল-কুরআনকে রাসূল (সা)-এর জীবন্ত চরিত্ররূপে আখ্যায়িত করেছেনঅনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অনুস্মরণীয় উত্তম গুণাবলী ও আদর্শ মানব তথা সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অবশ্যম্ভাবী ও ইত্যাবশ্যকীয় করেছেনদুরূদ-সালাম ও শান্তি বর্ষিত হউক মহান চরিত্রের অধিকারী, সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, একমাত্র অনুসরণীয় যোগ্য ও আদর্শ নেতা যিনি তাঁর চারিত্রিক মাধূর্যতার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেনসাহাবা, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীসহ সকল আপামোর জনসাধারণের প্রতিও

উপস্থাপনা ঃ
السلام عليكم ورحمة الله تعالى وبركاته সম্মানিত উপস্থিতি, সূধী মন্ডলী এবং দ্বীন প্রিয়, কুরআন প্রিয় তাওহিদী জনতা এবং অদ্যকার দারসুল কুরআনঅনুষ্ঠানের শ্রোতা-বক্তা, গবেষক, সাহিত্যিক, ইসলামিক স্কলারশিপ এবং বিজ্ঞ-বিচক্ষণ, নিরপেক্ষ, উদার ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারীগণ! মনের সকল সংকীর্ণতা, দীনতা, হীনতা, হীনমন্নতা ও গোঁড়ামী সম্পূর্ণ পরিহার করত; একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, উদারতা, মনের প্রশস্ততা, কুরআন-সুন্নাহ্ ও বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষনের মানসিকতা নিয়ে মনের অন্ধকারাচ্ছন্ন জানালা খুলে কুরআনের প্রশস্ত ও উন্মুক্ত উর্বর ভুমিতে বেরিয়ে এসে ইহ-লৌকিক ও পার-লৌকিক জীবনের সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বাচ্ছন্দ্য ও সফলতার অর্জন করতে ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন আমাদেরকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছেমহান আল্লাহ তায়ালা আল-কুরআনকে মানব জাতীর জন্য সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন যাতে মানব সম্প্রদায় উহাকে জীবন-বিধান হিসাবে গ্রহন করতে পারে

দারসের উদ্দেশ্য ঃ
সত্যিকার মুমিনগণ যেন কুরআনের দিক-নির্দেশনা অনুপাতে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অনুস্মরণীয় উত্তম গুণাবলী ও আদর্শ মানব তথা সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে কার্যকরী ভুমিকা রাখাই দারসুল কুরআনের উদ্দেশ্য

দারসুল কুরআননের মূল পয়েন্ট সমূহঃ
v দারসুল কুরআননের মূল পয়েন্ট সমূহঃ
১. সহীহ্ (বিশুদ্ধ) তিলাওয়াত / التلاوة الصحيحة
২. সরল (প্রাঞ্জল) অনুবাদ / الترجمة التسهيلة
৩. নাম করণ (নাম করণের কারণ) / وجه التسمية
৪. অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক পটভূমি / شان نزول وأهمية نزولها فى موكب التاريخية
৫. দারসের আলোচ্য বিষয় / موضوع الدرس
৬. ব্যাখ্যা / নির্দেশনা / আনুসাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয় / التشريحات / المعلومات المتعقلة بالأيات
৭. শিক্ষা / উপকারিতা / الإستفادة من الدرس / الفائدة
৮. উপসংহার / যবণিকা / সমাপনী / الخاتمة / الإختتامة / الإنتهاء

১. সহীহ্ (বিশুদ্ধ) তিলাওয়াত / التلاوة الصحيحة
قال الله تعالى : ﴿قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ 1 الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ 2 وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ 3 وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ 4 وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ 5 إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ 6 فَمَنِ ابْتَغَىٰ وَرَاءَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْعَادُونَ 7 وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ 8 وَالَّذِينَ هُمْ عَلَىٰ صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ 9 أُولَٰئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ 10 الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ 11 - {سورة المؤمنون : 1 11}.

২. সরল (প্রাঞ্জল) অনুবাদ / الترجمة التسهيلة
(১) নিশ্চিত ভাবেই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা। (২) যারা নিজেদের নামাযে বিনয়ী ও ন¤্র। (৩) যারা বাজে বা বেহুদা কথা ও কাজ থেকে দুরে থাকে। (৪) যারা তাজকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়। (৫) এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। (৬) তবে তাদের স্ত্রীদের ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (৭) তবে যদি কেউ তাদের ছাড়া অন্য কাউকে (যৌন ক্ষুধা মেটাবার জন্য) কামনা করে তবে তারা হবে সীমালঙ্গনকারী। (৮) এবং যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদাচুক্তির (অঙ্গীকার) রক্ষণাবেক্ষণ করে। (৯) এবং যারা তাদের নামাযসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষন করে। (১০) তারাই (এসব গুনের অধিকারী) উত্তরাধিকার লাভ করবে (১১) তারা উত্তরাধিকার হিসাবে ফিরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে। [সূরা আল-মুমিনূন : ০১ -১১]

৩. নাম করণ (নাম করণের কারণ) / وجه التسمية
সুরার নামকরন দুই ভাবে হয়ে থাকেযথা :
  ক. বহুল আলোচিত শব্দ (শব্দ ভিত্তিক) নাস, ফালাক
  খ. বিষয়ভিত্তিক - সুরা ফাতেহা, ইখলাসএ সুরাটি ১ম আয়াতের اَلْمُؤْمِنُونَ (আল মুমিনূন) শব্দ থেকে নামকরন করা হয়েছে

৪. সূরা আল-মুমিনুনের ফজিলত ঃ
হযরত উমর (রাঃ) বলেন রসুল (সঃ) এর প্রতি যখন অহি নাজিল হত তখন মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ শুনা যেতএকদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা অহি শুনার জন্য থেমে গেলামঅহির বিশেষ এ অবস্থার শেষ হলে নবী করীম (সাঃ) কিবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং দুআ করতে লাগলেন : اَللَّهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا وَآَثِرْنَا وَلَا تُؤْثِرْ عَلَيْنَا وَأَرْضِنَا وَارْضَ عَنَّاহে আল্ল¬াহ! আমাদেরকে বেশী দাও কম দিওনাআমাদের সম্মান বৃদ্ধি কর- লাঞ্ছিত করো নাআমাদেরকে দান কর-বঞ্চিত করো নাআমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও অন্যদেরকে আমাদের উপর অগ্রধিকার দিয়ো না, আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাক এবং আমাদেরকে তোমার সন্তুষ্ট কর’ [তিরমিজি]

এরপর রাসুলুল¬াহ (সাঃ) বললেনঃ এক্ষণে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছেকেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করে, তবে সে সোজা জান্নাতে যাবেএরপর তিনি সুরা মুমিনুনের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। [আহমাদ]

ইমাাম নাসায়ী তফসীর অধ্যায়ে ইয়াযিদ ইবনে কাবনুস বর্ণনা করেছেন যে, আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হয় যে, রাসুলুল¬াহ (সাঃ)-এর চরিত্র কিরূপ ছিল? তিনি বললেন তার চরিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন ঃ এগুলোই ছিল রাসুলুল¬াহ (সঃ)-এর চরিত্র ও অভ্যাস। [ইবনে কাসীর]

৪. অবতীর্ণের প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক পটভূমি / شان نزول وأهمية نزولها فى موكب التاريخية
সূরার বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তুর উৎস হতে এটি প্রমাণিত হয় যে, এটি রাসূল (সাঃ)-এর মাক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে নাযিল হয়েছেঅবতীর্ণের প্রেক্ষাপটে এ কথা স্পষ্ট যে, এ সময় রাসূল (সাঃ) ও কাফেরদের মধ্যে দ্বন্দ চলছিল কিন্তু তখনও অত্যাচার চরমে পৌছেনি। (৭৫-৭৬) আয়াত থেকে- মক্কায় দুর্ভিক্ষের সময় মাক্কী যুগের মধ্যভাগেউরওয়া ইবনে জুবাইর (রাঃ) বলেন, এ সুরাটি নাযিল হবার পূর্বেই উমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেনতিনি আব্দুর রহমান ইবনে আব্দুল কারীর বরাত দিয়ে উমর (রাঃ) উক্তি উদ্বৃত্ত করেনউমর (রাঃ) বলেন- একদিন ওহীর বিশেষ অবস্থা (মৌমাছির ন্যায় গুঞ্জনের) লক্ষ্য করে ওহী শোনার জন্য থেমে গেলামওহীর অবস্থা কেটে গেলে রাসূল (সাঃ) বলেল এক্ষনে দশটি আয়াত নাজিল হয়েছেযদি কেউ এ আয়াতগুলি পুরোপুরি পালন করে সে সোজা জান্নাত যাবেঅতঃপর তিনি উপরোল্লি¬খিত দশটি আয়াত পাঠ করে শোনান

৫. দারসের আলোচ্য বিষয় / موضوع الدرس
এই সুরাটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে রাসূল (সাঃ) এর আনুগত্যতিলাওয়াতকৃত ১১টি আয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো ; যেসব লোক এই নবীর কথা মেনে নেবে, তাদের মধ্যে এসবগুন সৃষ্টি হবে আর নিঃসন্দেহে দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ লাভ করবেইমাম নাসাঈ তার কিতাবের তাফসীর অধ্যায়ে ইয়াজীদ ইবনে কাবনুস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করেছিলেন রাসূল (সাঃ) এর চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বলেন, তার চরিত্র কুরআনে বর্ণিত আছেঅতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে শোনানএবং বলেন এসব ছিল রাসূল (সাঃ) এর চরিত্র

৬. পটভূমি ঃ
অত্র সূরা বিশেষ করে তিলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাজিলে মক্কার কাফেররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয় (বাণিজ্য)অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। (আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত দিক দিয়ে) এই অবস্থায় কাফেররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করততখন মুমিনদের প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলি নাজিল করেন

প্রকৃত সফলতার অর্থ ঃ
তাফসীরকারকগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, কোন একটি সুন্দর দালানে এক ব্যক্তি ৫দিন থাকতে পারবে এবং যদি কুড়েঘরে থাকে তবে সারাজীবন থাকতে পারবে- এক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান কোনটি বেছে নেবেঅথচ আখেরাতে চিরজীবনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে

৭. ব্যাখ্যা / নির্দেশনা / আনুসাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয় / التشريحات / المعلومات المتقلة بالأيات
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ অর্থঃ নিশ্চিত ভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরাএখানে মুমিন বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা, রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ঈমান এবং তাঁর আনীত বিধান মেনে নিয়েছে এবং তার দেখানো জীবনপদ্ধতি অনুসরন করেছে

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَনিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভদিয়ে বাক্য শুরু করার তাৎপর্য বুঝতে হলে নাজিলের পরিবেশকে সম্মুখে ব্যাখ্যা দরকার
 ১. কাফিরদের ইসলাম বিরোধীতা
 ২. সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি
 ৩. মুসলমানদের সামাজিক ও আর্থিক পশ্চাতপদতা
আল্ল¬াহ যখন এই মুসলমানদেরই সফল বললেন তখন বোঝা যায় আল্ল¬াহর নিকট সফলতার মানদন্ড ঈমান অর্থ নয়প্রকৃত সাফল্য আখেরাত
আল কুরআনে সাফল্য ঃ ব্যবস্থা-পত্র
অর্থঃ যে নিজেকে পাপ থেকে পবিত্র রেখেছে সেই সফলসফলতা লাভের জায়গা আখেরাতঅর্থাৎ (হে মানুষ) তোমরা দুনিয়াকেই পরকালের উপর অগ্রাধিকার দিচ্ছঅথচ দুনিয়ার তুলনায় আখেরাতের জীবন অতি উত্তম এবং স্থায়ীআলোচ্য আয়াতসমূহে আল¬াহ তায়লা সেসব মুমিনকে সাফল্য দান করার ওয়াদা করেছেনযারা আয়াতে উলি¬খিত সাতটি গুনে গুনান্বিতপরকালের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এবং দুনিয়ার সম্্ভাব্য সাফল্য সবই এই ওয়াদার অন্তর্ভূক্ত

বিশ্ববিখ্যাত কালজয়ী তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে ইবনে কাছীর’ (রহ) বলেন : রাসূল (সা)-এর ঐতিহাসিক কুরআনের ভাষ্যকার আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)হতে বর্ণিত একটি উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেনএতে বলা হয়েছে যে : সমস্ত ইসলাম ত্রিশটি অংশে সীমাবদ্ধ। (অর্থাৎ সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো ত্রিশটি) তন্মধ্যে দশটি সূরা তাওবা [১১২ নং আয়াত], দশটি সূরা মুমীনূন [প্রথম ১০ আয়াত] ও দশটি সূরা আহযাবে [৩৫ নং আয়াত] বর্ণিত হয়েছেআল্লাহ প্রদত্ত শরয়ী বিধানে সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও পরীক্ষার সংখ্যার ব্যাপারে কেউ বলেছেন তিনটি আবার কেউ বলেছেন ত্রিশটি। [তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ও তাফসীরে ইবনে কাছীর গ্রন্থদ্বয়ের সূরা বাক্বারা : ১২৪ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য]

ক. সূরা মুমীনূন এর প্রথম ১০ আয়াতে বর্ণিত দশটি অনুসরনীয় উত্তম আদর্শ মানব ও সফল মুমীনের গুনাবলীর বর্ণনা ঃ
মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ 1 الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ 2 وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ 3 وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ 4 وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ 5 إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَ 6 فَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ 7 وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ 8 وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ 9 أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ 10
অর্থ : (১) মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে। (২) যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র; (৩) যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত। (৪) যারা যাকাত দান করে থাকে। (৫) এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। (৬) তবে তাদের স্ত্রী ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (৭) অত:পর কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা সীমালংঘনকারী হবে। (৮) এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার স¤পর্কে হুশিয়ার থাকে। (৯) এবং যারা তাদের নামাযসমূহের খবর রাখে। (১০) তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে। [সূরা মুমীনূন : ১-১০]

খ. সূরা তাওবা এর ১১২ নং আয়াতে বর্ণিত দশটি অনুসরনীয় উত্তম আদর্শ মানব ও সফল  মুমীনের গুনাবলীর বর্ণনা ঃ
মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآَمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থ :  তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) স¤পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দকাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহ্র দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারীবস্তূত: সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে। [সূরা তাওবা : ১১২]

গ. সূরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে বর্ণিত দশটি অনুসরনীয় উত্তম আদর্শ মানব ও সফল মুমীনের গুনাবলীর বর্ণনা ঃ
মহান আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন :
إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
অর্থ : নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ, মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ, ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ, অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ, সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ, ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ, বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ, দানশীল নারী, রোযা পালণকারী পুরুষ, রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহ্র অধিক যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারী নারী-তাদের জন্য আল্লাহ্ প্রস্তূত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কাার। [সূরা আহযাব : ৩৫]

সফল মুমিনের সাতটি গুণ ঃ
সর্বপ্রথম গুণ হলো ঈমানদার হওয়াকিন্তু এটা একটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুণের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে

প্রথম গুণ ঃ 
الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ অর্থাৎ : যারা তাদের সালাতে / নামাযে বিনয়ী ন¤্রসালাতে / নামাযে খুশু বলতে বিনয়ম ন¤্র হওয়া বুঝায়খুশুর আভিধানিক অর্থ স্থিরতাশরীয়তের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকাঅর্থাৎ আল্ল¬াহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে না করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থির রাখাদিলের খুশু হয় তখন, যখন কারো ভয়ে বা দাপটে দিল ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে ওঠেআর দেহের খুশু এভাবে প্রকাশ পায় যে, কারো সামনে গেলে তার মাথা নিচু হয়ে যায়অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে পড়ে অশাঢ়, চোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে, গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়

হাদীসে আবু যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন : সালাতের / নামাযের সময় আল্ল¬াহ তাআলা বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন যতক্ষণ না নামাযী অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করেযখন সে অন্য কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে তখন আল্ল¬াহ তাআলা তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। [নাসায়ী ও আবু দাউদ]আয়াতে কারীমাতে বর্ণিত নামাযের নিয়ম-নীতি নামাযে খুশু-খুজু সৃষ্টি করতে সাহায্য করে

যেসব কাজ নামাযে খুশু-খুজু সৃষ্টিতে বাধা দেয় ঃ
১. নামাযের মধ্যে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা করা বা নাড়াচাড়া করাএকবার নবী (সা:) এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে মুখের দাড়ী নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন : لَوْ خَشَعَ قَلْبُ هَذَا خَشَعَتْ جَوَارِحُهُযদি এ লোকটির দিলে খুশু-খুযূ থাকত তাহলে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও উপরও খুশু-খুযূ থাকত’ [বায়হাকী]
২. নামাযে এদিক-ওদিক তাকালে নামাযের একগ্রতা বা খুশু-খুজু নষ্ট হয়ে যায়এব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন : وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا وَهُمْ كُسَالَى وَلَا يُنْفِقُونَ إِلَّا وَهُمْ كَارِهُونَতারা নামাযে আসে অলসতার সাথে ব্যয় করে সঙ্কুচিত মনে’ [সূরা তাওবাহ্ : ৫৪]এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন :  এটা নামাযীর (মনোযোগের) উপর শয়তানের থাবা
৩. নামাযে ছাদ বা আকাশের দিকে তাকালে নামাযের খুশু-খুযূ নষ্ট হয়ে যায়নবী করিম (সা:) বলেন : مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُوْنَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِىْ صَلَاتِهِمْ فَاشْتَدَّ قَوْلُهُ فِىْ ذَلِكَ حَتَّى قَالَ لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذَلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْলোকেরা যেন নামাযে তাদের চোখকে আকাশমুখী না করে। (কেননা তাদের চোখ) তাদেও দিকে ফিরে নাও আসতে পারে’ [সহীহ বুখারী]
৪. নামাযে হেলা-ফেলা করা ও নানাদিকে ঝুকে পড়া
৫. সিজদায় যাবার সময় বসার জায়গা বা সিজদার জায়গা বার বার পরিস্কার করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। (তবে ক্ষতিকারক হলে একবার সরানো যাবে)মহানবী (সাঃ) বলেছেন : মহানবী (সা:) বলেছেন : إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فإِنَّ الرَّحْمَةَ تُوَاجِهُهُ فَلَا يَمْسَحِ الْحَصَىকোন ব্যক্তি যেন নামাযের অবস্থায় (সিজদার জায়গা হতে) কংকর না সরায়কেননা আল্ল¬াহর রহমত নামাযী ব্যক্তির উপর প্রসারিত হয়’ [আহমেদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ]
৬. একটানা গর্দান খাড়া করে দাড়ানো এবং খুব কর্কশ স্বরে কোরআন পড়া কিংবা গীতের স্বরে কুরআন পাঠ
৭. জোরে জোরে হাই এবং ঢেকুর তোলাইচ্ছা করে গলা খেকরা বা কাশি দিলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়রাসূল (সাঃ) বলেছেন : নামাযে হাই ওঠে শয়তানের প্রভাব থেকে যদি কারো হাই ওঠে তার উচিত সে যেন সাধ্যমতো হাই প্রতিরোধ করে। [মুসলিম, তিরমিযী]
৮. তাড়াহুড়ো করে নামায আদায় করানামাযে রুকু, সিজদা কিয়াম সঠিক ভাবে আদায় না করারাসূল (সা:) বলেছেন :
ﻣَﺎ ﺗَﺮَﻭْﻥَ ﻓِﻲ ﺍﻟﺸَّﺎﺭِﺏِ ﻭَﺍﻟﺴَّﺎﺭِﻕِ ﻭَﺍﻟﺰَّﺍﻧِﻲْ ﻭَﺫﻟِﻚَ ﻗَﺒْﻞَ ﺃﻥْ ﻳَﻨْﺰِﻝَ ﻓِﻴْﻬِﻢْ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﺍَﻟﻠﻪ ﻭَﺭَﺳُﻮْﻟُﻪ ﺃَﻋْﻠَﻢُ ﻗَﺎﻝَ ﻫُﻦَّ ﻓَﻮَﺍﺣِﺶُ ﻭَﻓِﻴْﻬِﻦَّ ﻋُﻘُﻮْﺑَﺔٌ ﻭَﺃﺳْﻮَﺃُ ﺍﻟﺴَّﺮَﻗَﺔِ ﺍﻟَّﺬِﻱْ ﻳَﺴْﺮِﻕُ ﺻَﻠَﺎﺗَﻪ ﻗَﺎﻟُﻮْﺍ ﻭَﻛَﻴْﻒَ ﻳَﺴْﺮِﻕُ ﺻَﻠَﺎﺗَﻪ ﻳَﺎ ﺭَﺳُﻮْﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﻗَﺎﻝَ ﻟَﺎ ﻳُﺘِﻢَّ ﺭُﻛُﻮْﻋَﻬَﺎ ﻭَﻟَﺎ ﺳُﺠُﻮْﺩَﻫَﺎ
মদখোর, ব্যভিচারী ও চুরি করা কবীরা গুনাহ এবং তার সাজাও খুব (ভয়ঙ্কর) তবে, সবচেয়ে জঘন্য চুরি হলো সেই চোর যে, ব্যক্তি নামাযে চুরি করেসাহাবীরা বললেন নামাযে কিভাবে চুরি হয়? রাসূল (সা:) বললেন নামাযে রুকু ও সিজদা ঠিকমতো না করা’ [মালেক, আহমেদ, দারেমী]
৯. নামাযীর সামনে পর্দায় কোন ছবি থাকলে নামাযে খুশু-খুযূ বা একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়

নামাযে খুশু-খুযূ সৃষ্টির জন্য যা করতে হবে ঃ
১. আল্ল¬াহ তাআলাকে সবসময় হাজির-নাজির জানাহাদীসে জীবরীলে ইহ্সান সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) কে জিব্রাঈল (আঃ)  প্রশ্ন করলে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন :
اَلْإِحْسَانُ : ﺃَﻥْ ﺗَﻌْﺒُﺪَ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻛَﺄَﻧَّﻚَ ﺗَﺮَﺍﻩُ ﻓَﺈِﻥْ ﻟَﻢْ ﺗَﻜُﻦْ ﺗَﺮَﺍﻩُ، ﻓَﺈِﻧَّﻪُ ﻳَﺮَﺍﻙَ
তুমি এমনভাবে আল্ল¬াহর ইবাদত করবে (নামাযে) যেন তুমি আল্ল¬াহ্কে দেখতে পাচ্ছআর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়, তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নেবে যে আল্ল¬াহ্ তোমাকে দেখছেন’ [সহীহ বুখারী, মুসলিম ও মিশকাত]
২. নামাযে পঠিত দুআ-কালিমা অন্তর থেকে পড়া
৩. নামাযে খুশু সৃষ্টি করার জন্য নামাযীর দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে
৪. নামাযে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য নামাযে যা পড়া হয় তার অর্থ জানা

দ্বিতীয় গুণ ঃ
وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَযারা বেহুদা কাজ ও কথা থেকে দুরে থাকেবলা হয় এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও নিস্ফলযেসব কথা এবং কাজের কোনই ফল নেই

اللَّغْوِ -এর অর্থ উচ্চারণে গুনাহ যাতে ধর্মীয় উপকার তো নেই বরং ক্ষতি বিদ্যমান
রাসূল (সাঃ) বলেছেন : মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত হয়

আল্ল¬াহ বলেন : ﴿وَالَّذِينَ لَا يَشْهَدُونَ الزُّورَ وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا﴾ অর্থাৎ : যখন এমন কোন জায়গা দিয়ে তারা চলে যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়। [আল ফুরক্বান : ৭২]
মুমিনের মাঝে সবসময় দায়িত্বানুভুতি জাগ্রত থাকেতার কাছে দুনিয়াটা পরীক্ষাগারপরীক্ষার হলে নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছু করতে হয়ফুটবল, ক্রিকেট খেলা দেখায় পার্থিব বা আখেরাতের কোন কল্যাণ নেই

তৃতীয় গুন ঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَযারা যাকাত বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়যাকাত দেয়া বা যাকাতের পথে কর্মতৎপর সক্রিয় হওয়ার মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বিকট পার্থক্য বিদ্যমান

মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুরআনের বিশেষ ধরনের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে এটা বলার তাৎপর্য ঃ
اَلزَّكَاةُ আরবি শব্দআর আরবি ভাষায় اَلزَّكَاةُ (যাকাত) শব্দের দুটি অর্থ বিদ্যমানযথা :
  ক. পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, পরিশুদ্ধি
  খ. বিকাশ সাধন কোন জিনিসের সাধনে যেসব জিনিস প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায় সেসব দুর করা এবং তার মৌলবস্তুকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করাএই দুটি ধারনা মিলিয়ে যাকাতের পরিপূর্ণ ধারনা সৃষ্টি হয়তারপর এই শব্দটি, ইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত হলে এর দুটি অর্থ প্রকাশ পায়যথা :
  ক. এমন সম্পদ যা পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বের করা হয়
  খ. পরিশুদ্ধ করার মূল কাজটি যদি বলা হয় তবে এর অর্থ হবে তারা সম্পদ পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে সম্পদের একটি অংশ নেয়কিন্তু যদি বলা হয় তবে তার অর্থ হবে তারা পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা তায্কিয়ার কাজ করছেএ অবস্থায় ব্যাপারটি শুধুমাত্র আর্থিক যাকাত আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নাবরং এর অর্থ ব্যাপক হবেযেমন :
  ক. আতœার পরিশুদ্ধি                 
  খ. চরিত্রের পরিশুদ্ধি
  গ. জীবনের পরিশুদ্ধি                 
  ঘ. তার পারিবারিক পরিশুদ্ধি
  ঙ. সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি        
  চ. অর্থের পরিশুদ্ধি, ইত্যাদি
উপরোক্ত প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বেএছাড়া এর অর্থ কেবল নিজেরই জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং নিজের চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে
কুরআনের অন্যত্র আল্ল¬াহ তাআলা বলেন :
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ১৪ وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى ১৫ অর্থ : কল্যাণ ও সফলতা লাভ করল সে যে, পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়লো। [সুরা আলা : ১৪ - ১৫]

আল্ল¬াহ তাআলা বলেন : قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَاوَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ১০সফলকাম হলো সে যে, নিজের নফস্কে পবিত্র বা তায্কিয়া করলোআর ব্যর্থ হলো সে যে নিজেকে কলুষিত করল’ [সূরা শাম্স : ৯ - ১০]এ আয়াতে গোটা সমাজ জীবনের কথা বলা হয়েছে

চতুর্থ গুণ ঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ فَإِنَّهُمْ غَيْرُ مَلُومِينَفَمَنِ ابْتَغَى وَرَاءَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْعَادُونَ ৭ অর্থ ঃ এবং যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করেনতবে তাদের স্ত্রীদের এবং মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না করলে তারা তিরস্কৃত হবে নাতবে কেউ যদি এদের ছাড়া অন্য কাউকে কামনা তবে এক্ষেত্রে তারা হবে সীমালংঘনকারী

فُرُوجِهِمْ حَافِظُونَলজ্জাস্থান হেফাজত করা’-এর দুটি অর্থ হতে পারেযথা :
  ক. নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা
  খ. যৌন শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাগামহীন না হওয়া

একটি প্রাসঙ্গিক বাক্যলজ্জাস্থানের হেফাজত করেবাক্য থেকে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার জন্য
  * লজ্জাস্থানের সাধারণ হুকুম থেকে দুধরনের লোককে বাদ দেয়া হয়েছে
  ক. স্ত্রী শব্দটি আরবী ভাষায় পরিচিত ব্যবহার এবং কুরআনের ষ্পষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী যেসব নারীকে
  খ. বলতে এমন বাদী যার উপর মানুষের মালিকানা অধিকার আছেসুতরাং মালিকানাধীন দাসীদের যৌনসম্পর্ক বৈধ এবং বৈধতার ভিত্তি বিয়ে নয়কারণ এখানে স্ত্রী ও দাসী আলাদা ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে

এ বাক্যটি উপরোক্ত দুটি পন্থা ছাড়া কামনা চরিতার্থ করার যাবতীয় পথ অবৈধ করেছেহারাম উপায়গুলি হলো :
যিনা যেমন হারাম তেমনি হারাম নারীকে বিয়ে করাও যিনার মধ্যে গণ্য
স্ত্রী অথবা দাসীর সাথে হায়েজ-নেফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস হারাম
পুরুষ, বালক বা জীবজন্তুর সাথে কামনা চরিতার্থ করা হারামআর এটা  অধিকাংশ তাফসীরবিদগণের মতে হস্তমৈথুন এর অন্তর্ভূক্ত
এছাড়া যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল বই-পুস্তক পাঠ ও নারীর উলঙ্গ ছবি দেখাউপরোক্ত সবকিছুই সীমালঙ্গনের মধ্যে গণ্য হবে

ও  ৫ম ও ৬ষ্ঠ গুণ ঃ
وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ অর্থ ঃ যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে

আমানত প্রত্যাপর্ন করা ঃ
আমানত শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপকআভিধানিক অর্থে : এমন একটি বিষয় শামিল যার দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোন ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়বিধায় আমানত শব্দটি বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত

দুধরনের আমানত সংক্রান্ত কথা ঃ
  ক. হক্কুল¬াহ বা আল্ল¬াহর হক্ব        
  খ. হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক

১. حق الله হক্কুল¬াহ বা আল্লাহর হক (অধিকার) ঃ
শরীয়ত আরোপিত সকল ফরজ ও ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হরারম ও মাকরুহ বিষয় থেকে দুরে থাকামানুষ আল্ল¬াহর খলিফাখিলাফতের দায়িত্ব পালনের আমানত রক্ষা করা

২. حق العباد হক্কুল ইবাদ বা বান্দার (মানুষের) হক (অধিকার) ঃ
কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক আরোপিত ধন-সম্পদের আমানতগোপন কথার আমানত রক্ষা করামজুর, শ্রমিক ও চাকরীজীবীদের জন্য যে কার্য সময় নির্ধারন করে দেয়া হয় তা পালন করা দায় দায়িত্বের আমানতসংগঠন, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, পরিবার পরিচালক হিসেবেগণতান্ত্রিক দেশে ভোটারদের ভোট আমানতমহান আল্লাহ তাআলা বলেন : إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا আল্লাহ তাআলা তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদরে হাতে ফরেত দেওয়ার নর্দিশে দিচ্ছেন’ [সূরা নিসা : ৮৫]রাসুল (সাঃ) বলেছেন : لَا إِيْمَانَ لَهُ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُতার ঈমান নেই যার আমানতদারী নেই” [আহ্মাদ]তাছাড়া মুনাফেকের যে চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে তন্মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যটি হলো : وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ কোন আমানত তার কাছে সোপর্দ করা হলে সে তার খেয়ানত করে। [সহীহ বুখারী]

অঙ্গীকার পূর্ণ করা ঃ 
অঙ্গীকার বলতে প্রথমত, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বুঝায় যা কোন ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়এরূপ চুক্তি পূর্ণ করা ফরজদ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকারকে ওয়াদা বলা হয় অর্থাৎ এক তরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেয়ার বা কোন কাজ করে দেয়ার অঙ্গীকার করাহাদীসে আছে যে, “ওয়াদাও এক প্রকার কসম

সপ্তম গুণ ঃ
وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ যারা তাদের নামায সমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেএখানে পাচওয়াক্ত নামায মুস্তাহাব বা আউয়াল ওয়াক্তে যথাযথভাবে পাবন্দী সহকারে আদায় করা বুঝায়এখানে নামায সমূহের সংরক্ষণ বলতে নামাযের বাইরের এবং ভেতরের যাবতীয় নিয়মনীতি যথাযথভাবে পালন করাঅর্থাৎ আরকান-আহকাম পালন

সালাত / নামাযের অন্যতম আরকানগুলো নি¤œরূপ ঃ
  ক. শরীর, পোশাক, পরিচ্ছদ পাক পবিত্র
  খ. সময়মত সালাত / নামায আদায়
  গ. অযু ঠিকভাবে করে নামায আদায়
  ঘ. জামায়াতের সাথে নামায
  ঙ. শুদ্ধ, ধীরস্থিরভাবে দোয়া কালাম পাঠ করা
  চ. নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নামাযের হেফাজত করা
  ছ. ইহ্সানের সাথে নামায আদায়
কুরআনে সালাত / নামাযের ব্যাপারে এরশাদ হচ্ছে : وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِতুমি সালাত আদায় কর, নিশ্চয়ই নামায মানুষকে অশ্লীল, অপকর্ম থেকে বিরত রাখে” [সূরা আনকাবূত : ৪৫]

আয়াত ঃ ১০-১১ ; أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ ১০ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
অর্থ ঃ তারাই (এসবগুণের অধিকারীকেই) উত্তরাধিকার লাভ করবেতারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফেরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবেএখানে উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে এজন্য যে, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ যেমন উত্তরাধিকারদের নিশ্চিত প্রাপ্যএবং গুণের অধিকারীদেরও জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিতসফলকাম ব্যক্তিদের গুণাবলী পুরোপুরি উল্লে¬খ করার পর এই বাক্যে আরও ইঙ্গিত আছে যে, পূর্ণাঙ্গ সফল জান্নাতী ব্যক্তি

 اَلْفِرْدَوْسُশব্দটি এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারিদিকে পাচিল দেয়া থাকেবাগানটি বিস্তৃত হয়মানুষের আবাস গৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়াকোন কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে এ কথাও বোঝায় যে, এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু পাখি পাওয়া যায়কুরআনে বিভিন্ন সমষ্টিকে ফিরদাউস বলা হয়েছেতাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদৌসের বাগানগুলি আছেএ থেকে মনের মধ্যে এ ধারনা জন্মে যে, ফিরদৌস একটা বড় জায়গা, যেখানে অসংখ্য বাগ-বাগিচা ও উদ্যান রয়েছে

৭. শিক্ষা / উপকারিতা / الإستفادة من الدرس / الفائدة
১. সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষনা অথবা নিছক সৎ চরিত্র ও সৎকাজের ফল নয়বরং উভয়ের সম্মিলনের ফল
২. নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়আখেরাতের স্থায়ী সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য
৩. খুশু খুযুর সাথে নামায আদায়
৪. বাজে কথাও কাজে সময় নষ্ট না করা
৫. সর্ববস্থায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া
৬. অবৈধ পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার চিন্তাও না করা
৭. আমানতের হেফাজতের করা এবং অঙ্গীকার বা ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা
৮. নামাযের পাবন্দী করা এবং প্রত্যেক নামায মুস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা

৮. উপসংহার / যবণিকা / সমপনী / الخاتمة / الإختتامة / الإنتهاء
পরিশেষে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুপম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অনুস্মরণীয় উত্তম গুণাবলী ও আদর্শ মানব তথা সফল মুমিনের বৈশিষ্ট্যেও মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করত; জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ইসলামের যথাযথ বাস্তবায়ন পূর্বক শয়তানের ও মানবরূপী শয়তানের অনুরসরণ থেকে সকল প্রকার ধোঁকা ও প্রবঞ্চনামুক্ত হয়ে চির অশান্তির স্থান জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা ও চির শান্তির স্থান জান্নাত লাভের জন্য মহান আল্লাহ আমাকে, সাংঘটনিক কর্মী ভাই ও তাওহীদি জনতাকে তাওফীত দান করুন, আমীন

গ্রন্থপঞ্জি / নির্ঘন্ট / সহায়ক গ্রন্থাবলী ঃ
১. তাফসীর ইবনে কাছীর’. আল্লামা আবুল ফিদা ইবনে কাছীর রা.
২. তাফসীর তাফহীমুল কুরআন’. আল্লামা সায়্যিদ আবুল আলা মাওদূদী রা.
৩. তাফসীর কুরআনুল কারীম’. প্রফেসর ড. মুজিবুর রহমান
৪. অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থাবলী

No comments:

Post a Comment