Monday, 28 January 2019

কিয়ামাতের আলামত ও সময়


কিয়ামাতের আলামত  সময়
রচনায় : ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস সালাম

কিয়ামাত (القيامة) শব্দটি (قام) ক্রিয়া থেকে গৃহীতএর অর্থ দাঁড়ানো বা উত্থিত হওয়াইসলামী পরিভাষায় মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানকে কিয়ামাত বলা হয়সাধারণত মহাপ্রলয় ও পুনরুত্থানকে একত্রে কিয়ামতবলা হয়অনেক সময় সামগ্রিকভাবে পরকালীন জীবনকে কিয়ামাতবা কিয়ামত দিবসবলা হয়আমরা আগেই দেখেছি যে, আখিরাত ও কিয়ামাতের বিশ্বাস ঈমানের অন্যতম বিষয়কিয়ামাতে বিশ্বাসের অন্যতম দিক যে এর সময় বা ক্ষণ আল্লাহ তাঁর কোনো সৃষ্টিকে জানান নিকুরআনে বিষয়টি বারংবার বলা হয়েছেএকস্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
বল, ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গাইবের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না তারা কখন পুনরুত্থিত হবে
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কিয়ামাত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
 : إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِالآيَةَrمَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنْ السَّائِلِ وَسَأُخْبِرُكَ عَنْ أَشْرَاطِهَا إِذَا وَلَدَتْ الأَمَةُ رَبَّهَا وَإِذَا تَطَاوَلَ رُعَاةُ الإِبِلِ الْبُهْمُ فِي الْبُنْيَانِ فِي خَمْسٍ لا يَعْلَمُهُنَّ إِلا اللَّهُ ثُمَّ تَلا النَّبِيُّ
প্রশ্নকারীর চেয়ে প্রশ্নকৃত ব্যক্তি এ বিষয়ে বেশি জানে নাআমি তোমাকে কিয়ামাতের আলামত বলবযখন দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে এবং যখন অবলা উটের রাখালগণ সুউচ্চ ইমারত-অট্টালিকা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবেকিয়ামাতের জ্ঞান পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে নাঅতঃপর তিনি তিলাওয়াত করেন : নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর কাছেই রয়েছে কিয়ামাতের জ্ঞান….”
এভাবে আমরা দেখছি যে, কিয়ামাতের সময় আল্লাহ মানুষকে জানান নি, তবে কিয়ামাতের বিষয়ে কিছু পূর্বাভাস তিনি জানিয়েছেনকুরআনে বলা হয়েছে:
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ
তারা কি কেবল এজন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামাত তাদের নিকট এসে পড়ক আকস্মিকভাবে? কিয়ামাতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে! কিয়ামাত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?”
কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলিমগণ কিছু বিষয়কে আলামাত সুগরা’ (العلامات الصغرى) অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর আলামত  এবং কিছু বিষয়কে আলামাত কুবরা’ (العلامات الكبرى) অর্থাৎ বৃহত্তর আলামতবা বিশেষ আলামতবলে উল্লেখ করেছেন
আলামাত সুগরা
আমরা দেখলাম যে, কিয়ামাতের পূর্বাভাসসমূহ প্রকাশিত হয়েছে বলে কুরআনে বলা হয়েছেএ সকল পূর্বাভাসের অন্যতম সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনসাহল ইবনু সাদ আস সায়িদী (রা) বলেন:
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَذِهِ مِنْ هَذِهِ أَوْ كَهَاتَيْنِ وَقَرَنَ بَيْنَ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর হাতের তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি একত্রিত করে বলেন: আমি প্রেরিত হয়েছি কিয়ামাতের সাথে এভাবে পাশাপাশি
উপরের আলামতগুলো ছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামাতের আরো অনেক পূর্বাভাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছেএ সকল হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামাতের পূর্বে আরব উপদ্বীপে নদনদী প্রবাহিত হবে এবং ক্ষেত-খামার ছড়িয়ে পড়বেমক্কার বাড়িঘরগুলো মক্কার পাহাড়গুলো ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাবে, মক্কার মাটির নিচে সুড়ঙ্গগুলো একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত হবে, পাহাড়গুলো স্থানচ্যুত হবেইরাকের ফুরাত নদীর তলদেশ থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশিত হবে, যে জন্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিগ্রহ ছড়িয়ে পড়বেমানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হবে, অল্প সময়ে মানুষ অনেক সময়ের কাজ করবে, অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে যাবেতবে মানুষের বিশ্বাস ও ধার্মিকতা কমে যাবে, নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে, পাপ, অনাচার ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করবে, মিথ্যা ও ভণ্ড নবীগণের আবির্ভাব ঘটবে, হত্যা, সন্ত্রাস, ও বৃহৎ পরিসরের যুদ্ধ হতে থাকবেএ সকল আলামাতবা পূর্বভাস প্রকাশের এক পর্যায়ে বৃহৎ আলামতগুলোপ্রকাশিত হবে
আলামাতে কুবরা
হুযাইফা ইবনু আসীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আরাফাতের মাঠে (বিদায় হজ্জের সময়ে) অবস্থান করছিলেনআমরা তাঁর থেকে নিচু স্থানে অবস্থান করছিলামতিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা কি আলোচনা করছ? আমরা বললাম: কিয়ামাতের আলোচনা করছিতিনি বলেন:
إِنَّ السَّاعَةَ لا تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ، ونُزُولُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ
দশটি আয়াত বা নিদর্শন না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামাত হবে না: (১) পূর্ব দিকে ভূমিধ্বস (ভূপৃষ্ঠ যমীনের মধ্যে ডুবে যাওয়া), (২) পশ্চিমদিকে ভূমিধ্বস, (৩) আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস, (৪) ধুম্র, (৫) দাজ্জাল, (৬) ভূমির প্রাণী, (৭) ইয়াজূজ-মাজূজ, (৮) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (৯) এডেনের ভূগর্ভ থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে মানুষদেরকে তাড়িয়ে নেওয়া এবং (১০) মরিয়ম-পুত্র ঈসা (আ)-এর অবতরণ
এ সকল আলামতের বিস্তারিত বর্ণনায় অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিতকুরআন কারীমে কোনো আলামতের বিষয়ে ইঙ্গিত বা উল্লেখ রয়েছেআল্লাহ বলেন:
وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآَيَاتِنَا لا يُوقِنُونَ
যখন ঘোষিত শাস্তি তাদের নিকট আসবে তখন আমি যমিন হতে বের করব এক জীব যা তাদের সাথে কথা বলবে, এ জন্য যে মানুষ আমার নিদর্শনে অবিশ্বাসী
কুরআনের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈসা (আ)-এর পুনরাগমনের পর সকল কিতাবী তাঁর বিষয়ে সঠিক জ্ঞান ও ঈমান লাভ করবেনআল্লাহ বলেন:
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا
আর আমরা আল্লাহর রাসূল মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছিতাদের (ইহূদীদের) এ উক্তির জন্যঅথচ তারা তাকে হত্যা করে নি, ক্রুশবিদ্ধও করে নি; কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিলযারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয় এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল নানিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করে নিবরং আল্লাহ্ তাকে তাঁর নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়কিতাবীদের মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামাতের দিন সে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে
ইয়াজুজ মাজুজের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِينَ
এমন কি যখন য়াজুজ ও মাজুজকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতি উচ্চভূমি হতে ছুটে আসবেঅমোঘ প্রতিশ্রতকাল আসন্ন হলে সহসা কাফিরদিগের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে হায়, দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; না, আমরা সীমালঙ্ঘনকারীই ছিলাম
কিয়ামতের আলামাত: মুমিনের করণীয়
আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় কিয়ামতের আলামত বিষয়ে মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করাএগুলোর ব্যাখ্যা ও প্রকৃতি জানা আমাদের দায়িত্ব নয়অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ বিষয়ক ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন ও অন্তহীন বিতর্ক সৃষ্টি করেযেমন: হাদীসে যে ভূমিধ্বসের কথা বলা হয়েছে তা কি তুরস্কের ভূমিকম্প? ইরানের ভূমিকম্প? জাপানের সুনামি? না তা ভবিষ্যতে ঘটবে? কবে ঘটবে? অথবা: ইয়াজূজ-মাজূজ কারা, তারা কি তাতার? চেঙ্গিশ খানের বাহিনী? চীন জাতি?  অন্য কোনো জাতি? কোথায় তারা থাকে? তারা বের হয়েছে না বের হবে? অথবা: দাজ্জাল কে? ¯্রায়েল রাষ্ট্র? আমেরিকা? দাজ্জাল কি বের হয়েছে? না ভবিষ্যতে হবে? কখন তার আবির্ভাব ঘটবে? কিয়ামতের আলামত বিষয়ক এ জাতীয় প্রশ্ন বা গবেষণার নামে সময় ধ্বংস করে দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিনের কোনোই লাভ হয় না, তবে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ইবাদত, দাওয়াত, উপার্জন, আল্লাহর হক্ক, বান্দার হক্ক ইত্যাদি জরুরী কর্ম ফাঁকি দিতে মুমিনকে এরূপ অকারণ বিতর্কে লিপ্ত করে শয়তান
মুমিনের দায়িত্ব সাধারণভাবে বিশ্বাস করা যে, কিয়ামতের আগে এ সকল আলামত দেখা যাবেএ সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে সবই সত্যযখন তা ঘটবে তখন মুমিনগণ জানবেন যে কিয়ামত ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছেএগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আল্লাহই জানেনএর ব্যাখ্যা জানার দায়িত্ব মুমিনকে দেওয়া হয় নিমুমিনের দায়িত্ব দুনিয়া ও আখিরাতে কাজে লাগার মত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা করাকুরআন-হাদীস অনুসন্ধান করে মানুষের প্রায়োগিক জীবনের সমাধান দেওয়ার জন্য গবেষণা করতে নির্দেশ দেয় ইসলামচিকিৎসা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি সকল মানব-কল্যাণ বিষয়ক গবেষণার নির্দেশ দেয় ইসলামএ সকল বিষয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান মানুষকে একটি নিশ্চিত ফলাফল লাভের পথে নিয়ে যায়কিন্তু গাইবী বিষয় নিয়ে গবেষণার নামে অকারণ বিতর্ক কোনো ফলাফল দেয় নামহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) ইয়াজূজ-মাজূজ বা দাজ্জাল বলতে কী বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে হাজার বছর এভাবে গবেষণা নামের প্রলাপ-বিলাপ ও বিতর্ক করেও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না
ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বিষয়ে কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবেএটিই আহলুস সুন্নাতের মূলনীতিশুধু সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা, দুর্বল ও জাল বর্ণনা বর্জন করা এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলি অপব্যাখ্যা না করে সরল অর্থে বিশ্বাস করা
ইমাম মাহদী
উপরের হাদীসে কিয়ামতের দশটি পূর্বভাসের মধ্যে ইমাম মাহদী’-র বিষয় উল্লেখ করা হয় নিইমাম আবূ হানীফাও কিয়ামতের আলামতের মধ্যে বিষয়টি উল্লেখ করেন নিতবে বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামতের পূর্বে ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছেকোনো কোনো হাদীসে বিষয়টিকে ঈসা মাসীহের অবতরণ ও দাজ্জালের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে
আমরা দেখেছি যে, হাদীস, ফিকহ ও আকীদার পরিভাষায় ইমামশব্দটি খলীফাবা রাষ্ট্রপ্রধানশব্দের সমার্থকমাহদী অর্থ হেদায়াত-প্রাপ্তএজন্য পারিভাষিকভাবে ইমাম মাহদীঅর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত-প্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরের খলীফাগণকে খুলাফা রাশিদীন মাহদিয়্যীনবা মাহদী রাশিদ খলীফাবলে আখ্যায়িত করেছেনএ থেকে আমরা জানি যে, খুলাফায়ে রাশিদীন সকলেই মাহদীবা হেদায়াতপ্রাপ্তছিলেনতবে শেষ যুগে আরো একজন মাহদী রাষ্ট্রপ্রধানক্ষমতাগ্রহণ করবেন বলে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছেমাহদীর কথা উল্লেখ করে কোনো হাদীস সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেইঅন্যান্য হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো সংকলিতএ বিষয়ে কিছু সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ হাদীস বিদ্যমান এবং অগণিত জাল হাদীস এ বিষয়ে প্রচারিত হয়েছেএখানে এ বিষয়ক কয়েকটি গ্রহণযোগ্য হাদীস উল্লেখ করছি
) বলেন:rপ্রথম হাদীস: আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (
لَوْ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ يَوْمٌ لَطَوَّلَ اللَّهُ ذَلِكَ الْيَوْمَ حَتَّى يَبْعَثَ فِيهِ رَجُلاً مِنِّى أو مِنْ أَهْلِ بَيْتِى (يَمْلِكَ الْعَرَبَ/ يلي رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِى) يُوَاطِئُ اسْمُهُ اسْمِى وَاسْمُ أَبِيهِ اسْمَ أَبِى يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ ظُلْمًا وَجَوْرًا.
দুনিয়ার যদি একটি দিনও বাকি থাকে তবে আল্লাহ সে দিনটিকে দীর্ঘায়িত করে আমার বংশধর থেকে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যার নাম ও পিতার নাম আমার নাম ও আমার পিতার নামের মতই হবে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবেন, আরবদের উপর রাজত্ব গ্রহণ করবেন জুলুম পূর্ণ পৃথিবীকে ইনসাফে পূর্ণ করবেনহাদীসটি সহীহ
দ্বিতীয় হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْمَهْدِىُّ مِنِّى أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الأَنْفِ يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا وَظُلْمًا يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ
মাহদী আমার (বংশধর) থেকে, তার কপাল চুলমুক্ত (মাথার সম্মুখভাগে চুল থাকবে না) এবং নাক চিকনসে অত্যাচারে পরিপূর্ণ দুনিয়াকে ন্যায়পরায়ণতায় পূর্ণ করবেসে সাত (অন্য বর্ণনায়: নয়) বছর রাজত্ব করবেহাদীসটি সহীহ
তৃতীয় হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَكُونُ اخْتِلاَفٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ وَيُبْعَثُ إِلَيْهِ بَعْثٌ مِنَ الشَّامِ فَيُخْسَفُ بِهِمْ بِالْبَيْدَاءِ بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَإِذَا رَأَى النَّاسُ ذَلِكَ أَتَاهُ أَبْدَالُ الشَّامِ وَعَصَائِبُ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ ثُمَّ يَنْشَأُ رَجُلٌ مِنْ قُرَيْشٍ أَخْوَالُهُ كَلْبٌ فَيَبْعَثُ إِلَيْهِمْ بَعْثًا فَيَظْهَرُونَ عَلَيْهِمْ وَذَلِكَ بَعْثُ كَلْبٍ وَالْخَيْبَةُ لِمَنْ لَمْ يَشْهَدْ غَنِيمَةَ كَلْبٍ فَيَقْسِمُ الْمَالَ وَيَعْمَلُ فِى النَّاسِ بِسُنَّةِ نَبِيِّهِمْ -صلى الله عليه وسلم- وَيُلْقِى الإِسْلاَمُ بِجِرَانِهِ إِلَى الأَرْضِ فَيَلْبَثُ سَبْعَ سِنِينَ/ تِسْعَ سِنِينَ، ثُمَّ يُتَوَفَّى وَيُصَلِّى عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ
একজন খলীফার মৃত্যুর সময় মতভেদ হবেতখন মদীনার একজন মানুষ পালিয়ে মক্কায় চলে আসবেতখন মক্কার কিছু মানুষ তার কাছে এসে তাকে বের করে আনবেতার অনিচ্ছা ও অপছন্দ সত্ত্বেও তারা হাজার আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার বাইয়াত করবেসিরিয়া থেকে একটি বাহিনী তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হবেমক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে এ বাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবেযখন মানুষেরা তা দেখবে তখন সিরিয়া থেকে আবদালগণ এবং ইরাক থেকে দলেদলে মানুষ এসে হাজার আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবেএরপর কুরাইশ বংশ থেকে একব্যক্তি তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, যার মাতুল হবে কালব বংশেরএ ব্যক্তি একটি বাহিনী তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেকিন্তু মাহদীর বাহিনী কালব গোত্রের বাহিনীকে পরাজিত করবেকালব গোত্রের গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) বণ্টনে যে উপস্থিত থাকবে না সে দুর্ভাগাতখন সে (মাহদী) সম্পদ বণ্টন করবে এবং মানুষদের মধ্যে তাদের নবীর (সা.) সুন্নাত অনুসারে কর্ম করবেআর পৃথিবীর বুকে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হবেসে সাত (অন্য বর্ণনায়: নয়) বৎসর এভাবে থাকবেএরপর সে মৃত্যুবরণ করবে এবং মুসলিমগণ তার সালাতুল জানাযা আদায় করবে
হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেনআল্লামা ইবনুল কাইয়িম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান এবং সহীহ পর্যায়ের বলে উল্লেখ করেছেনপক্ষান্তরে শাইখ আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন
চতুর্থ হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَكُونُ فِي أُمَّتِي الْمَهْدِيُّ إِنْ قُصِرَ فَسَبْعٌ وَإِلَّا فَتِسْعٌ فَتَنْعَمُ فِيهِ أُمَّتِي نِعْمَةً لَمْ يَنْعَمُوا مِثْلَهَا قَطُّ تُؤْتَى أُكُلَهَا وَلَا تَدَّخِرُ مِنْهُمْ شَيْئًا وَالْمَالُ يَوْمَئِذٍ كُدُوسٌ فَيَقُومُ الرَّجُلُ فَيَقُولُ يَا مَهْدِيُّ أَعْطِنِي فَيَقُولُ خُذْ
আমার উম্মাতের মধ্যে মাহদী আসবেকম হলে সাত (বছর), না হলে নয় (বছর)তখন আমার উম্মাতের মধ্যে নিয়ামত সর্বজনীন হবেতারা এমনভবে প্রাচুর্য ও নিয়ামত ভোগ করবে যা তারা ইতোপূর্বে কখনোই ভোগ করে নিউম্মাতকে সকল প্রাচুর্য দেওয়া হবে এবং মাহদী তাদেরকে না দিয়ে কিছুই সঞ্চিত করে রাখবে নাতখন সম্পদ হবে অফুরন্তকোনো ব্যক্তি যদি বলে, হে মাহদী, আমাকে প্রদান করুন তবে মাহদী বলবে: তুমি নিয়ে যাওহাদীসটি হাসান
পঞ্চম হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْمَهْدِيُّ مِنْ عِتْرَتِي مِنْ وَلَدِ فَاطِمَةَ
মাহদী আমার বংশের, ফাতিমার বংশধর থেকেহাদীসটি সহীহ
ষষ্ঠ হাদীস: সাওবান (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلَاثَةٌ كُلُّهُمْ ابْنُ خَلِيفَةٍ ثُمَّ لَا يَصِيرُ إِلَى وَاحِدٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَطْلُعُ الرَّايَاتُ السُّودُ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلًا لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ ثُمَّ ذَكَرَ شَيْئًا لَا أَحْفَظُهُ فَقَالَ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ
তোমাদের সংরক্ষিত সম্পদ নিয়ে তিন ব্যক্তি লড়াই করবে, তিনজনই খলীফার সন্তানতাদের তিনজনের একজনও তা অধিকার করতে পারবে নাএরপর পূর্ব দিক থেকে কাল পতাকাসমূহের উদয় হবে, তখন তারা তোমাদেরকে এমনভাবে হত্যা করবে যেভাবে ইতোপূর্বে কেউ করে নিএরপর তিনি কিছু বললেন, যা আমি মনে রাখতে পারি নিএরপর বলেন: যখন তোমরা তা দেখবে তখন তার  বাইয়াত করবেবরফের উপরে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও বাইয়াত করবে; কারণ সেই আল্লাহর খলীফা মাহদীইমাম বাযযার, হাকিম নাইসাপূরী, যাহাবী, বূসীরী, সুয়ূতী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেনআলবানী হাদীসটি শেষ বাক্যটিকে যয়ীফ বলেছেন
বুখারী ও মুসলিম সংকলিত কয়েকটি হাদীস ইমাম মাহদী প্রাসঙ্গিক বলে গণ্য করেছেন আলিমগণআবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ
তোমরা কি জান তোমাদের কী অবস্থা হবে যখন মরিয়মের পুত্র ঈসা যখন তোমাদের মধ্যে অবতরণ করবেন আর তখন তোমাদের ইমামহবেন তোমাদেরই মধ্যকার একজন
অন্য হাদীসে জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِقَالَفَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ -صلى الله عليه وسلم- فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا. فَيَقُولُ لاَ. إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ. تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ.
আমার উম্মাতের কিছু মানুষ হক্কের উপরে বিজয়ী থেকে লড়াই করে চলবে কিয়ামত পর্যন্ততিনি বলেন: অতঃপর মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ) অবতরণ করবেন তখন তাদের আমীর বলবে: আসুন আমাদের জন্য ইমাম হয়ে সালাত আদায় করুনতিনি বলবেন: না, আপনারা একে অপরের উপর আমীর, এটি এ উম্মাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মাননা
এ সকল হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেন যে, ইমাম মাহদীর সময়েই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন এবং তাঁরই ইমামতিতে তিনি সালাত আদায় করবেন
উপরের হাদীসগুলো থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
(ক) ইমাম মাহদীবলতে একজন হেদায়াতপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়েছেযিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে বিশ্বে প্রাচুর্য, শান্তি, ইনসাফ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে
(খ) তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বংশধর এবং ৭ বা ৯ বৎসর রাজত্ব করবেন
(গ) তার রাজত্বকালেই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন
(ঘ) তার ইমামত, খিলাফত বা শাসন আরবদেশ কেন্দ্রিক হবে
(ঙ) তার ক্ষমতাগ্রহণের পূর্বে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ হবেবাইতুল্লাহর পাশে তার বাইয়াত হবেসিরিয়া, ইরাক ও পূর্বদিক থেকে তার পক্ষে যোদ্ধারা আসবে
) জানিয়েছেনতবে যখন তার বিরোধী সৈন্যবাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবে, সিরিয়া, ইরাক ও পূর্ব দিকের সেনাবাহিনী তাঁর বাহিনীতে যোগ দিবে এবং সামগ্রিকভাবে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে বা মুসলিম উম্মাহ তাঁকে স্বীকার করে নিবে, তখন মুমিনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর বাইয়াত করাএজন্য ইমাম মাহদী প্রসঙ্গে ইমাম সুফিয়ান সাওরী বলেন:r(চ) এ রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতাগ্রহণ, বাইয়াত ইত্যাদি বিষয়ে মুমিনের কোনো দায়িত্ব নেইএগুলো ঘটবে বলে রাসূলুল্লাহ (
لو مر ببابك فلا تبايعه حتى يجتمع الناس عليه
যদি তিনি তোমার দরজা দিয়ে গমন করেন তবুও তুমি তাঁর বাইয়াত করবে না; যতক্ষণ না সকল মানুষ তাঁর বিষয়ে একমত হয়
ইমাম মাহদী দাবিদারগণ
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি যে, যুগে যুগে অনেক মানুষ নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেছেন এবং দ্রুত জুলুম-অনাচার দূর করে ইনসাফপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগে অথবা স্বপ্ন ও কাশফের গল্পে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গিয়েছেনসব স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছেঅকারণে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন বা রক্ত দিয়েছেনইতিহাসের বইগুলো ঘাটলে এরূপ কয়েক হাজার প্রসিদ্ধ ইমাম মাহদী’-র পরিচয় পাওয়া যায়এখানে অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি
(১) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান হাসানী: আন- নাফসুস যাকিয়্যাহ (৯৩-১৪৫ হি)তিনি আলী-বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, আবিদ ও বীর ছিলেনআব্বাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগে নবী-বংশের খিলাফতের নামে আব্বাসী নেতৃবৃন্দ তাঁর হাতেই বাইয়াত করেনকিন্তু ১৩২ হিজরীতে উমাইয়াগণের পতনের পর আব্বাসীগণ ক্ষমতা দখল করেনদ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা মানসূর (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেনতিনি লুকিয়ে থাকার কারণে খলীফার বাহিনী তাঁর পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করে এবং নির্যাতন করে হত্যা করেনএ পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ করেনমদীনা, বসরা ও অন্যান্য স্থানে তাঁকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করা হয়কিন্তু আব্বাসী সেনাবাহিনী ১৪৫ হিজরীতে তাকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হয়তৎকালীন অনেক নেককার বুজুর্গ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম তাকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন
(২) তৃতীয় আব্বাসী খলীফা মাহদী (জন্ম: ১২৭, খিলাফাত: ১৫৮-১৬৯ হি)তিনি দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর মানসূরের পুত্রমনসূরের মূল নাম আব্দুল্লাহতিনি পুত্রের নাম রাখেন মুহাম্মাদমানসূরের মৃত্যুর পর মাহদী খলীফা হনতিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করতেনতার এ দাবীর পক্ষে কিছু দুর্বল হাদীসও বিদ্যমান, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহদী আব্বাসের বংশধর হবেন
(৩) হুসাইন ইবন যাকরাওয়াইহি ইবন মাহরাওয়াইহি (২৯১ হি)তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেনতিনি সিরিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে লুটপাট ও গণহত্যা চালানসর্বশেষ আব্বাসী খলীফা মুকতাফী বিল্লাহ নিজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই ইমাম মাহদীর বাহিনীকে পরাজিত করেন ও তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন
(৪) উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন কাদ্দাহ (২৫৯-৩২২ হি)তৃতীয় হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে ২৯৬ হিজরী সালে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে প্রচার করেনকাইরোয়ানে ২৯৭ হিজরীতে তাঁর অনুসারীরা ইমাম মাহদী ও ইমামে যামান হিসেবে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেদ্রুত তারা মরক্কোয় তাদের ফাতিমীরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন৩৫৮ হিজরীতে তার বংশধর মিসর দখল করেনপ্রায় দুই শতাব্দী পর ৫৬৭ হিজরী সালে সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে মিসরের ফাতিমী শীয়া মাহদী রাজত্বের পতন ঘটে
(৫) হুসাইন ইবন মানসূর হাল্লাজ (৩০৯ হি)তিনি সূফী ও দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেনতিনি নিজেকে আল্লাহর মধ্যে ফানাপ্রাপ্ত ও বাকা প্রাপ্ত ওলী, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, নতুন শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইমাম মাহদী ইত্যাদি দাবি করেনতাঁর অনুসারীরা তাঁর বহু অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচার করে৩০৯ হি. সালে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়তবে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তাঁর একজন শত্রুকে তার আকৃতি প্রদান করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন
(৬) আল-মুয়িয্য ইবনুল মানসূর: মাআদ ইবন ইসমাঈল ইবন উবাইদুল্লাহ ফাতিমী (৩৬৫ হি)পূর্বোক্ত উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন-এর পৌত্রতিনি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবি করেনতিনি কয়েক দিন নির্জনে থাকেন এবং দাবি করেন যে, তিনি এ সময়ে আরশে আল্লাহর সাথে ছিলেনতার অনুসারীরা তার অগণিত কারামত প্রচার করতেনএভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গভীর প্রভাব পড়েতিনি ক্রমান্বয়ে মিসর দখল করে কাইরো শহর প্রতিষ্ঠা করেন
(৭) বালিয়া (৪৮৪ হি)এ ব্যক্তি শয়তান-সাধক ও জ্যোতিষী (ধংঃৎড়ষড়মবৎ) ছিলমানুষদেরকে অনেক ভেল্কি দেখিয়ে ৪৮৩ হি. সালে দাবি করে যে, সেই ইমাম মাহদীতাকে যে অবিশ্বাস করবে সে কাফিরসাধারণ মানুষেরা অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে তার দলে যোগ দেয়সে বসরা অঞ্চলে অনেক শহর ও গ্রাম দখল করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেএ বছরেরই শেষ প্রান্তে সে ধৃত ও নিহত হয়
(৮) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন তাওমারত (৪৮৫-৫২৪ হি)৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শুরুতে মরোক্কোয় তিনি আলিম, আবিদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেনতিনি নিজেকে আলীর বংশধর ও ইমাম মাহদী বলে দাবি ও প্রচার করেনদ্রুত তাঁর অনুসারী বাড়তে থাকেমরোক্কোর শাসক ইবন তাশফীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিশুদ্ধইসলামী রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেনরাষ্ট্র দখলের আগেই তার মৃত্যু হয়তার সাথী ও খলীফা আব্দুল মুমিন মরক্কোর শাসনক্ষমতা দখল করে নতুন রাজবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন
(৯) আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন হাশিম মুলাস্সাম (৬৫৮-৭৪০ হি)মিসরে ফকীহ, আবিদ, সূফী ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেনএকপর্যায়ে ৬৮৯ সালে তিনি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবি করেনতিনি তার কারামত ও হাল সম্পর্কে আল্লাহর নামে শপথ করে অনেক দাবি-দাওয়া করেনতিনি দাবি করেন যে, তিনি মহান আল্লাহকে স্বপ্নে দেখেন ও তাঁর সাথে কথা বলেন, তাকে মহান আল্লাহর কাছে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি তাকে মাহদী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেনএছাড়া অনেক দাবি-দাওয়া তিনি ও তার অনুসারীরা করেনতাকে কয়েকবার কারারুদ্ধ করা হয়
(১০) শাইখ আবুল আব্বাস আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ সালজামাসী, ইবন মহাল্লী (৯৬৭-১০২২ হি)মরক্কোর সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও সূফী ছিলেনপ্রথম জীবনে তিনি ফিকহে পারদর্শিতা অর্জন করেনএরপর তিনি তাসাউফের বিভিন্ন তরীকায় অনুশীলন করে কাশফ-কারামত সম্পন্ন সূফী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেনতার কারামত ও ইবাদতের প্রসিদ্ধির কারণে দলেদলে মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায়তিনি  সমাজে প্রচলিত অন্যায়, জুলুম ও পাপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেনএকপর্যায়ে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেনতিনি পাপী ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেনমরোক্কোর তৎকালীন শাসকের বাহিনীকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি সালজামাসা শহর অধিকার করেন এবং তথায় তিন বৎসর রাজত্ব করেনতিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন১০২২ হিজরীতে এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হনমরক্কো শহরের প্রাচীরে তার ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ট ভক্তের কর্তিত মাথা প্রায় ১২ বৎসর ঝুলানো ছিলতার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তিনি লুকিয়ে রয়েছেন এবং যথাসময়ে প্রকাশিত হবেনপরবর্তী কয়েকশত বৎসর পর্যন্ত অনেক মানুষ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন
(১১) মুহাম্মাদ আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ (১২৫৯-১৩০২হি/১৮৮৫খৃ)সুদানের সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও ইমাম মাহদীসুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর প্রভাব সুদূর প্রসারীফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জনের পর তিনি তাসাউফের অনুশীলন, ইবাদত-বন্দেগি এবং শিক্ষা প্রচারে মনোনিবেশে করেনক্রমান্বয়ে তার ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা বাড়তে থাকেতিনি শাসকদের অনাচার থেকে দেশকে পবিত্র করার দাওয়াত দিতে থাকেন১২৯৮ হি/১৮৮১ খৃস্টাব্দে তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী বলে দাবি করেনসুদানের আলিমদের পত্র লিখে তাকে সহযোগিতা করতে আহ্বান জানানতিনি দরবেশউপাধিতে আখ্যায়িত তাঁর অনুসারীদেরকে সুদানের সকল অঞ্চলে জিহাদের দাওয়াত দিতে প্রেরণ করেনমিসর-সুদানের সরকারী বাহিনী ও বৃটিশ বাহিনী অনেকবার মাহদীর বাহিনীকে নির্মূল করতে চেষ্টা করেকিন্তু মূলত এ সকল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়সমগ্র সুদান মাহদীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসেতবে অল্প কিছুৃ দিনের মধ্যেই তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেনতার স্থলাভিষিক্ত ও অনুসারীরা তাদের রাজত্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেনতবে অল্প সময়েই তারা পরাজিত হন এবং সুদান ও মিসর বৃটিশের অধীনে চলে যায়
(১২) আলী মুহাম্মাদ ইবন মিরযা রিদা শীরাযী (১২৬৬ হি/ ১৮৫০খৃ)বাবিয়্যা বাহায়ী মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতাইরানের শীরায প্রদেশে তার জন্মসংসার ত্যাগ, সাধনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রৌদ্রে অবস্থান ইত্যাদি দ্বারা তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেনতিনি নিজেকে প্রথমে আল-বাবঅর্থাৎ দরজা উপাধিতে আখ্যায়িত করেনএরপর তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেনস্বভাবতই অনেক মানুষ তার অনুসারী ও ভক্ত হয়ে যায়সর্বশেষ তিনি সকল ধর্মের সমন্বয়ে নতুন এক ধর্মের উদ্ভাবন করেনতার এ নতুন ধর্ম সমাজে অনেক হানাহানি সৃষ্টি করে১৮৫০ খৃস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়
(১৩)  মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮খৃ)কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাসে প্রথম দিকে সূফী দরবেশ ও কাশফ-কারামতের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেইসলামের পক্ষে হিন্দু ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও বইপত্র লিখে বৃটিশ শাসিত মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেহিন্দু ও খৃস্টানদের প্রতিবাদের নামে ১৮৮০ সালে বারাহীন আহমাদিয়া নামক গ্রন্থটির প্রথম খ- প্রকাশ করেগ্রন্থটি মূলত তার নিজের কাশফ ও কারামতের দাবি-দাওয়ায় পরির্পূণক্রমান্বয়ে তার দাবি-দাওয়া বাড়তে থাকে১৩০২ হিজর সালে (১৮৮৫খৃ) সে নিজেকে চতুর্দশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে১৮৯১ সালে সে নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেএরপর নিজেকে ঈসা মাসীহ বলে দাবী করেএরপর নিজেকে ওহী-প্রাপ্ত ছায়া নবী বলে দাবি করেসর্বশেষ ১৯০১ সালে সে নিজেকে তিন লক্ষ মুজিযা প্রাপ্ত পূর্ণ নবী বলে দাবি করে১৯০৮ খৃস্টাব্দে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়
(১৪) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানী (১৪০০ হি/১৯৭৯ খৃ)১৪০০ হিজরী সালের প্রথম দিনে (১৯/১১/৭৯) এ মাহদীর আবির্ভাবজুহাইমান উতাইবী নামক একজন সৌদি ধার্মিক যুবক সমাজের অন্যায় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেনসৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলিমগণ তাকে ভালবাসতেনক্রমান্বয়ে জুহাইমানের আন্দোলনে অনেক শিক্ষিত ও ধার্মিক যুবক অংশ গ্রহণ করেনএকপর্যায়ে জুহাইমানের একজন আত্মীয় মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানীকে তিনি প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী হিসেবে ঘোষণা করেনকাহতানী নিজে এবং তার অনেক অনুসারী স্বপ্নে দেখতে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং কাহতানীকে ইমাম মাহদীবলে জানাচ্ছেনএভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে তারা সুনিশ্চিত হন যে কাহতানীই ইমাম মাহদীযেহেতু কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কাবা শরীফের পাশে হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে মাহদীর বাইয়াত হবে, এজন্য তারা ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিনে এ বাইয়াত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেনঅনেকগুলো লাশের কফিনের মধ্যে অস্ত্র ভরে ১/১/১৪০০ (১৯/১১/৭৯) ফজরের সময় তারা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেনসালাতের পর তারা মসজিদ অবরোধ করেন এবং ইমাম ও মুসল্লীদেরকে ইমাম মাহদীর বাইয়াত গ্রহণ করতে বাধ্য করেনসৌদি সরকারী বাহিনী দীর্ঘ ১৫ দিন প্রাণান্ত প্রচেষ্টার পর অবরুদ্ধ মাসাজিদুল হারাম মুক্ত করেনইমাম মাহদী ও তার অনেক অনুচর নিহত হয়এছাড়া অনেক হাজী ও মুসল্লীও উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হন
(১৫) হুসাইন ইবন মূসা হুসাইন আল-লুহাইদীবর্তমান যুগের ইমাম মাহদীগণেরএকজনতিনি কুয়েতের অধিবাসীযুবক বয়সে পাপাচারের পথে ছিলেনএরপর তিনি ইবাদত-বন্দেগি ও নির্জনতার মধ্যে বাস করতে থাকেনসমাজের অবক্ষয়ের অজুহাতে মসজিদে সালাত আদায় বর্জন করেনএকপর্যায়ে তিনি দাবি করেন যে তিনি ইমাম মাহদী, তার কাছে আল্লাহর ওহী ও ইলহাম আসেনষ্ট সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেনফলে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে পড়েছেআমরা দেখেছি যে, সহীহ হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুত মাহদীর নাম ও পিতার নাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতই হবেএ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, লুহাইদী মাহদী নয়এজন্য এর ব্যাখ্যায় লুহাইদী প্রচার করে যে, এ সকল হাদীসে মূলত রাসূলুল্লাহ সা.- এর পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছেতিনি পুনরুজ্জীবিত হয়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসবেনবর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক ভক্ত অনুসারী বিদ্যমানপাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের আলিমগণ তার বিভ্রান্তিগুলো প্রকাশ করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন
৯. ৭. বিভ্রান্তির কারণ ও প্রতিকার
ইতিহাসে এ জাতীয় শত শত ইমাম মাহদী’-র সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেনমাহদী দাবিদার ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভ- ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার মানুষও ছিলেনতাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ কার্যকর বলে আমরা দেখি:
(১) সমাজ পরিবর্তনের অন্ধ আবেগসকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমানপাপাচারী, জালিম ও ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশিআবেগী ধার্মিক মানুষ, বিশেষত যুবক, এ সকল অন্যায় দূর করে আদর্শসমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেনস্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষঅসম্ভববলে মনে হয়এজন্য জিহাদবা ইমাম মাহদীবিষয়টি খুবই আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষফলে এ জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা
অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছেসকলেই অপেক্ষা করেন, এই তো মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ, জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন  এগুলো সবই পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজদুনিয়ায় ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত ও মর্যাদা লাভ করেনমাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান
(২) স্বপ্ন-কাশফের উপর নির্ভর করামাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেনআর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েনঅথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নিস্বপ্নে যদি তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবেতারপরও স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখেএছাড়া স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) দাবি করে মিথ্যা বলতে পারেবস্তুত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেনকিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে মাহদীবলে বিশ্বাস করার কোনোরূপ দলীল নেইকারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে, কিন্তু এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন
কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেনকাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিততিনি কিভাবে জানলেন যে, তিনি মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়নবীগণ ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেনএ সকল দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?
)-এর পরে কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করাrসাধারণত তারা ওহীর দাবি করেন না; কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভ- নবী বলে গণ্য হবেনএজন্য তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেনসরলপ্রাণ মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হনঅথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একইকারণ যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের বলে দাবি করেছেনঅনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (
মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেনমাহদী ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলকভূমিধ্বস হবে, পাহাড় স্থানচ্যুত হবেঅন্যান্য বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবেকিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মুমিনের নয়অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি প্রকাশ পেয়েছেযখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই মুমিন তাকে মেনে নিবেন
মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্বচিন্তাটি ভিত্তিহীনযদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদীআর যদি দাবি-দাওয়া ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্তকারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছে দেবেনসকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত করা
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল অর্থ পরিত্যাগআকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণউপরে আলোচিত মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় নাতারপরও হাজার হাজার মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেনহাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেনকারো বিষয়ে একবার সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করেফলে তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেনঈমানী দুর্বলতার কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহবিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব নাপ্রত্যেকের প্রতিটি কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করবআর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ