কিয়ামাতের
আলামত ও সময়
রচনায় : ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস
সালাম
কিয়ামাত (القيامة) শব্দটি (قام) ক্রিয়া থেকে গৃহীত। এর
অর্থ দাঁড়ানো বা উত্থিত হওয়া। ইসলামী পরিভাষায় মৃত্যু থেকে
পুনরুত্থানকে কিয়ামাত বলা হয়। সাধারণত মহাপ্রলয় ও পুনরুত্থানকে
একত্রে ‘কিয়ামত’ বলা হয়। অনেক
সময় সামগ্রিকভাবে পরকালীন জীবনকে ‘কিয়ামাত’ বা ‘কিয়ামত
দিবস’ বলা হয়। আমরা
আগেই দেখেছি যে, আখিরাত
ও কিয়ামাতের বিশ্বাস ঈমানের অন্যতম বিষয়। কিয়ামাতে
বিশ্বাসের অন্যতম দিক যে এর সময় বা ক্ষণ আল্লাহ তাঁর কোনো সৃষ্টিকে জানান নি। কুরআনে
বিষয়টি বারংবার বলা হয়েছে। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ
“বল, ‘আল্লাহ ব্যতীত
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গাইবের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না তারা কখন
পুনরুত্থিত হবে।”
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কিয়ামাত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:
: إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ…الآيَةَrمَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنْ السَّائِلِ وَسَأُخْبِرُكَ عَنْ أَشْرَاطِهَا إِذَا وَلَدَتْ الأَمَةُ رَبَّهَا وَإِذَا تَطَاوَلَ رُعَاةُ الإِبِلِ الْبُهْمُ فِي الْبُنْيَانِ فِي خَمْسٍ لا يَعْلَمُهُنَّ إِلا اللَّهُ ثُمَّ تَلا النَّبِيُّ
“প্রশ্নকারীর
চেয়ে প্রশ্নকৃত ব্যক্তি এ বিষয়ে বেশি জানে না। আমি
তোমাকে কিয়ামাতের আলামত বলব। যখন দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে
এবং যখন অবলা উটের রাখালগণ সুউচ্চ ইমারত-অট্টালিকা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। কিয়ামাতের
জ্ঞান পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেগুলি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। অতঃপর
তিনি তিলাওয়াত করেন : “নিশ্চয়
আল্লাহ, তাঁর
কাছেই রয়েছে কিয়ামাতের জ্ঞান….”
এভাবে আমরা দেখছি যে,
কিয়ামাতের সময় আল্লাহ মানুষকে জানান নি, তবে কিয়ামাতের বিষয়ে কিছু পূর্বাভাস তিনি জানিয়েছেন। কুরআনে
বলা হয়েছে:
فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ
“তারা
কি কেবল এজন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামাত তাদের নিকট এসে পড়–ক আকস্মিকভাবে? কিয়ামাতের লক্ষণসমূহ তো এসেই পড়েছে! কিয়ামাত
এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?”
কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলিমগণ কিছু বিষয়কে ‘আলামাত সুগরা’ (العلامات الصغرى)
অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্রতর
‘আলামত’ এবং কিছু
বিষয়কে ‘আলামাত
কুবরা’ (العلامات الكبرى)
অর্থাৎ ‘বৃহত্তর
‘আলামত’ বা ‘বিশেষ আলামত’ বলে উল্লেখ
করেছেন।
আলামাত সুগরা
আমরা দেখলাম যে, কিয়ামাতের
পূর্বাভাসসমূহ প্রকাশিত হয়েছে বলে কুরআনে বলা হয়েছে। এ সকল
পূর্বাভাসের অন্যতম সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমন। সাহল
ইবনু সাদ আস সায়িদী (রা) বলেন:
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَذِهِ مِنْ هَذِهِ أَوْ كَهَاتَيْنِ وَقَرَنَ بَيْنَ السَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى
“রাসূলুল্লাহ
সা. তাঁর হাতের তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি একত্রিত করে বলেন: “আমি প্রেরিত
হয়েছি কিয়ামাতের সাথে এভাবে পাশাপাশি।”
উপরের আলামতগুলো ছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামাতের আরো অনেক পূর্বাভাসের কথা
উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিয়ামাতের
পূর্বে আরব উপদ্বীপে নদনদী প্রবাহিত হবে এবং ক্ষেত-খামার ছড়িয়ে পড়বে। মক্কার
বাড়িঘরগুলো মক্কার পাহাড়গুলো ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বে উঠে যাবে, মক্কার মাটির
নিচে সুড়ঙ্গগুলো একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত হবে, পাহাড়গুলো স্থানচ্যুত হবে। ইরাকের
ফুরাত নদীর তলদেশ থেকে স্বর্ণের পাহাড় প্রকাশিত হবে, যে জন্য ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিগ্রহ ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের
জীবনযাত্রা উন্নত হবে, অল্প
সময়ে মানুষ অনেক সময়ের কাজ করবে, অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী হয়ে যাবে। তবে
মানুষের বিশ্বাস ও ধার্মিকতা কমে যাবে, নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় ঘটবে, পাপ, অনাচার ইত্যাদি
ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করবে,
মিথ্যা ও ভণ্ড নবীগণের আবির্ভাব ঘটবে, হত্যা, সন্ত্রাস, ও বৃহৎ পরিসরের যুদ্ধ হতে থাকবে। এ সকল ‘আলামাত’ বা পূর্বভাস
প্রকাশের এক পর্যায়ে ‘বৃহৎ
আলামতগুলো’ প্রকাশিত
হবে।
আলামাতে কুবরা
হুযাইফা ইবনু আসীদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আরাফাতের মাঠে (বিদায় হজ্জের সময়ে) অবস্থান
করছিলেন। আমরা তাঁর থেকে নিচু স্থানে অবস্থান করছিলাম। তিনি
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন,
তোমরা কি আলোচনা করছ?
আমরা বললাম: কিয়ামাতের আলোচনা করছি। তিনি বলেন:
إِنَّ السَّاعَةَ لا تَكُونُ حَتَّى تَكُونَ عَشْرُ آيَاتٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَالدُّخَانُ وَالدَّجَّالُ وَدَابَّةُ الأَرْضِ وَيَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَطُلُوعُ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنَارٌ تَخْرُجُ مِنْ قُعْرَةِ عَدَنٍ تَرْحَلُ النَّاسَ، ونُزُولُ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ…
“দশটি
আয়াত বা নিদর্শন না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামাত হবে না: (১) পূর্ব দিকে ভূমিধ্বস (ভূপৃষ্ঠ
যমীনের মধ্যে ডুবে যাওয়া),
(২) পশ্চিমদিকে ভূমিধ্বস,
(৩) আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস, (৪) ধুম্র, (৫) দাজ্জাল, (৬) ভূমির প্রাণী, (৭) ইয়াজূজ-মাজূজ, (৮) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, (৯) এডেনের
ভূগর্ভ থেকে অগ্নি নির্গত হয়ে মানুষদেরকে তাড়িয়ে নেওয়া এবং (১০) মরিয়ম-পুত্র ঈসা (আ)-এর
অবতরণ।”
এ সকল আলামতের বিস্তারিত বর্ণনায় অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত। কুরআন
কারীমে কোনো আলামতের বিষয়ে ইঙ্গিত বা উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ
বলেন:
وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنَ الأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآَيَاتِنَا لا يُوقِنُونَ
“যখন
ঘোষিত শাস্তি তাদের নিকট আসবে তখন আমি যমিন হতে বের করব এক জীব যা তাদের সাথে কথা
বলবে, এ জন্য
যে মানুষ আমার নিদর্শনে অবিশ্বাসী।”
কুরআনের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈসা (আ)-এর পুনরাগমনের পর সকল কিতাবী তাঁর বিষয়ে সঠিক জ্ঞান
ও ঈমান লাভ করবেন। আল্লাহ বলেন:
وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا
“আর ‘আমরা আল্লাহর
রাসূল মরিয়ম-তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি’ তাদের (ইহূদীদের) এ উক্তির জন্য। অথচ
তারা তাকে হত্যা করে নি,
ক্রুশবিদ্ধও করে নি;
কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার
সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল তারা নিশ্চয় এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে
অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। নিশ্চিত
যে তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং আল্লাহ্ তাকে তাঁর নিকট তুলে
নিয়েছেন এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। কিতাবীদের
মধ্যে প্রত্যেকে তার মৃত্যুর পূর্বে তাকে বিশ্বাস করবেই এবং কিয়ামাতের দিন সে
তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।”
ইয়াজুজ মাজুজের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنْسِلُونَ وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَا وَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِينَ
“এমন কি
যখন য়া’জুজ ও
মা’জুজকে
মুক্তি দেওয়া হবে এবং তারা প্রতি উচ্চভূমি হতে ছুটে আসবে। অমোঘ
প্রতিশ্র“তকাল
আসন্ন হলে সহসা কাফিরদিগের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে, তারা বলবে ‘হায়, দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; না, আমরা
সীমালঙ্ঘনকারীই ছিলাম’।”
কিয়ামতের আলামাত: মুমিনের করণীয়
আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় কিয়ামতের আলামত বিষয়ে মুমিনের দায়িত্ব কুরআন ও
হাদীসের বক্তব্যগুলো সরল অর্থে বিশ্বাস করা। এগুলোর
ব্যাখ্যা ও প্রকৃতি জানা আমাদের দায়িত্ব নয়। অধিকাংশ
ক্ষেত্রে এ বিষয়ক ব্যাখ্যা ভিত্তিহীন ও অন্তহীন বিতর্ক সৃষ্টি করে। যেমন: হাদীসে
যে ভূমিধ্বসের কথা বলা হয়েছে তা কি তুরস্কের ভূমিকম্প? ইরানের
ভূমিকম্প? জাপানের
সুনামি? না তা
ভবিষ্যতে ঘটবে? কবে
ঘটবে? অথবা: ইয়াজূজ-মাজূজ
কারা, তারা
কি তাতার? চেঙ্গিশ
খানের বাহিনী? চীন
জাতি? অন্য কোনো জাতি? কোথায় তারা
থাকে? তারা
বের হয়েছে না বের হবে? অথবা: দাজ্জাল
কে? ই¯্রায়েল
রাষ্ট্র? আমেরিকা? দাজ্জাল কি বের
হয়েছে? না
ভবিষ্যতে হবে? কখন
তার আবির্ভাব ঘটবে? কিয়ামতের
আলামত বিষয়ক এ জাতীয় প্রশ্ন বা গবেষণার নামে সময় ধ্বংস করে দুনিয়া ও আখিরাতে
মুমিনের কোনোই লাভ হয় না,
তবে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়। ইবাদত, দাওয়াত, উপার্জন, আল্লাহর হক্ক, বান্দার হক্ক
ইত্যাদি জরুরী কর্ম ফাঁকি দিতে মুমিনকে এরূপ অকারণ বিতর্কে লিপ্ত করে শয়তান।
মুমিনের দায়িত্ব সাধারণভাবে বিশ্বাস করা যে, কিয়ামতের আগে এ সকল আলামত দেখা যাবে। এ সকল
বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসে যা বলা হয়েছে সবই সত্য। যখন তা
ঘটবে তখন মুমিনগণ জানবেন যে কিয়ামত ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে। এগুলোর
বিস্তারিত ব্যাখ্যা আল্লাহই জানেন। এর ব্যাখ্যা জানার দায়িত্ব মুমিনকে
দেওয়া হয় নি। মুমিনের দায়িত্ব দুনিয়া ও আখিরাতে কাজে লাগার
মত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা করা। কুরআন-হাদীস অনুসন্ধান করে মানুষের
প্রায়োগিক জীবনের সমাধান দেওয়ার জন্য গবেষণা করতে নির্দেশ দেয় ইসলাম। চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি
সকল মানব-কল্যাণ বিষয়ক গবেষণার নির্দেশ দেয় ইসলাম। এ সকল
বিষয়ে গবেষণা-অনুসন্ধান মানুষকে একটি নিশ্চিত ফলাফল লাভের পথে নিয়ে যায়। কিন্তু
গাইবী বিষয় নিয়ে গবেষণার নামে অকারণ বিতর্ক কোনো ফলাফল দেয় না। মহান
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) ইয়াজূজ-মাজূজ বা দাজ্জাল বলতে কী বুঝিয়েছেন সে বিষয়ে
হাজার বছর এভাবে গবেষণা নামের প্রলাপ-বিলাপ ও বিতর্ক করেও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে
পৌঁছানো যাবে না।
ইমাম আবূ হানীফা উল্লেখ করেছেন যে, এ সকল বিষয়ে কেবলমাত্র সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে। এটিই
আহলুস সুন্নাতের মূলনীতি। শুধু সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা, দুর্বল ও জাল
বর্ণনা বর্জন করা এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত বিষয়গুলি অপব্যাখ্যা না করে সরল অর্থে
বিশ্বাস করা।
ইমাম মাহদী
উপরের হাদীসে কিয়ামতের দশটি পূর্বভাসের মধ্যে ‘ইমাম মাহদী’-র বিষয় উল্লেখ করা হয় নি। ইমাম
আবূ হানীফাও কিয়ামতের আলামতের মধ্যে বিষয়টি উল্লেখ করেন নি। তবে
বিভিন্ন হাদীসে কিয়ামতের পূর্বে ‘ইমাম মাহদী’র আবির্ভাবের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো
কোনো হাদীসে বিষয়টিকে ঈসা মাসীহের অবতরণ ও দাজ্জালের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ
করা হয়েছে।
আমরা দেখেছি যে, হাদীস, ফিকহ ও আকীদার
পরিভাষায় ‘ইমাম’ শব্দটি ‘খলীফা’ বা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ শব্দের সমার্থক। মাহদী
অর্থ ‘হেদায়াত-প্রাপ্ত’।এজন্য
পারিভাষিকভাবে ‘ইমাম
মাহদী’ অর্থ ‘আল্লাহর পক্ষ
থেকে হেদায়াত-প্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান’।
ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরের খলীফাগণকে ‘খুলাফা রাশিদীন
মাহদিয়্যীন’ বা ‘মাহদী রাশিদ
খলীফা’ বলে
আখ্যায়িত করেছেন। এ থেকে আমরা জানি যে, খুলাফায়ে
রাশিদীন সকলেই ‘মাহদী’ বা ‘হেদায়াতপ্রাপ্ত’ ছিলেন। তবে
শেষ যুগে আরো একজন ‘মাহদী
রাষ্ট্রপ্রধান’ ক্ষমতাগ্রহণ
করবেন বলে বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মাহদীর কথা
উল্লেখ করে কোনো হাদীস সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই। অন্যান্য
হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো সংকলিত। এ বিষয়ে কিছু
সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ হাদীস বিদ্যমান এবং অগণিত জাল হাদীস এ বিষয়ে
প্রচারিত হয়েছে। এখানে এ বিষয়ক কয়েকটি গ্রহণযোগ্য হাদীস
উল্লেখ করছি।
) বলেন:rপ্রথম হাদীস: আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ বলেন, রাসূলুল্লাহ (
لَوْ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ يَوْمٌ لَطَوَّلَ اللَّهُ ذَلِكَ الْيَوْمَ حَتَّى يَبْعَثَ فِيهِ رَجُلاً مِنِّى أو مِنْ أَهْلِ بَيْتِى (يَمْلِكَ الْعَرَبَ/ يلي رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِى) يُوَاطِئُ اسْمُهُ اسْمِى وَاسْمُ أَبِيهِ اسْمَ أَبِى يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ ظُلْمًا وَجَوْرًا.
“দুনিয়ার
যদি একটি দিনও বাকি থাকে তবে আল্লাহ সে দিনটিকে দীর্ঘায়িত করে আমার বংশধর থেকে এক
ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যার নাম ও পিতার নাম আমার নাম ও আমার পিতার নামের মতই হবে
তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করবেন, আরবদের উপর রাজত্ব গ্রহণ করবেন জুলুম পূর্ণ পৃথিবীকে ইনসাফে
পূর্ণ করবেন।”
হাদীসটি সহীহ।
দ্বিতীয় হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْمَهْدِىُّ مِنِّى أَجْلَى الْجَبْهَةِ أَقْنَى الأَنْفِ يَمْلأُ الأَرْضَ قِسْطًا وَعَدْلاً كَمَا مُلِئَتْ جَوْرًا وَظُلْمًا يَمْلِكُ سَبْعَ سِنِينَ
“মাহদী
আমার (বংশধর) থেকে, তার
কপাল চুলমুক্ত (মাথার সম্মুখভাগে চুল থাকবে না) এবং নাক চিকন। সে
অত্যাচারে পরিপূর্ণ দুনিয়াকে ন্যায়পরায়ণতায় পূর্ণ করবে। সে সাত
(অন্য বর্ণনায়: নয়) বছর রাজত্ব করবে।” হাদীসটি সহীহ।
তৃতীয় হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَكُونُ اخْتِلاَفٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ وَيُبْعَثُ إِلَيْهِ بَعْثٌ مِنَ الشَّامِ فَيُخْسَفُ بِهِمْ بِالْبَيْدَاءِ بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَإِذَا رَأَى النَّاسُ ذَلِكَ أَتَاهُ أَبْدَالُ الشَّامِ وَعَصَائِبُ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ ثُمَّ يَنْشَأُ رَجُلٌ مِنْ قُرَيْشٍ أَخْوَالُهُ كَلْبٌ فَيَبْعَثُ إِلَيْهِمْ بَعْثًا فَيَظْهَرُونَ عَلَيْهِمْ وَذَلِكَ بَعْثُ كَلْبٍ وَالْخَيْبَةُ لِمَنْ لَمْ يَشْهَدْ غَنِيمَةَ كَلْبٍ فَيَقْسِمُ الْمَالَ وَيَعْمَلُ فِى النَّاسِ بِسُنَّةِ نَبِيِّهِمْ -صلى الله عليه وسلم- وَيُلْقِى الإِسْلاَمُ بِجِرَانِهِ إِلَى الأَرْضِ فَيَلْبَثُ سَبْعَ سِنِينَ/ تِسْعَ سِنِينَ، ثُمَّ يُتَوَفَّى وَيُصَلِّى عَلَيْهِ الْمُسْلِمُونَ
“একজন
খলীফার মৃত্যুর সময় মতভেদ হবে। তখন মদীনার একজন মানুষ পালিয়ে
মক্কায় চলে আসবে। তখন মক্কার কিছু মানুষ তার কাছে এসে তাকে বের
করে আনবে। তার অনিচ্ছা ও অপছন্দ সত্ত্বেও তারা হাজার
আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার বাইয়াত করবে। সিরিয়া
থেকে একটি বাহিনী তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হবে। মক্কা
ও মদীনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে এ বাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবে। যখন
মানুষেরা তা দেখবে তখন সিরিয়া থেকে আবদালগণ এবং ইরাক থেকে দলেদলে মানুষ এসে হাজার
আসওয়াদ ও মাকাম ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবে। এরপর
কুরাইশ বংশ থেকে একব্যক্তি তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, যার মাতুল হবে
কালব বংশের। এ ব্যক্তি একটি বাহিনী তার (মাহদীর) বিরুদ্ধে
প্রেরণ করবে। কিন্তু মাহদীর বাহিনী কালব গোত্রের বাহিনীকে
পরাজিত করবে। কালব গোত্রের গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) বণ্টনে
যে উপস্থিত থাকবে না সে দুর্ভাগা। তখন সে (মাহদী) সম্পদ বণ্টন করবে
এবং মানুষদের মধ্যে তাদের নবীর (সা.) সুন্নাত অনুসারে কর্ম করবে। আর
পৃথিবীর বুকে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সে সাত (অন্য
বর্ণনায়: নয়) বৎসর এভাবে থাকবে। এরপর সে মৃত্যুবরণ করবে এবং
মুসলিমগণ তার সালাতুল জানাযা আদায় করবে।”
হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। আল্লামা
ইবনুল কাইয়িম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে হাসান এবং সহীহ পর্যায়ের বলে উল্লেখ
করেছেন। পক্ষান্তরে শাইখ আলবানী হাদীসটিকে যয়ীফ বলে
উল্লেখ করেছেন।
চতুর্থ হাদীস: আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَكُونُ فِي أُمَّتِي الْمَهْدِيُّ إِنْ قُصِرَ فَسَبْعٌ وَإِلَّا فَتِسْعٌ فَتَنْعَمُ فِيهِ أُمَّتِي نِعْمَةً لَمْ يَنْعَمُوا مِثْلَهَا قَطُّ تُؤْتَى أُكُلَهَا وَلَا تَدَّخِرُ مِنْهُمْ شَيْئًا وَالْمَالُ يَوْمَئِذٍ كُدُوسٌ فَيَقُومُ الرَّجُلُ فَيَقُولُ يَا مَهْدِيُّ أَعْطِنِي فَيَقُولُ خُذْ
“আমার
উম্মাতের মধ্যে মাহদী আসবে। কম হলে সাত (বছর), না হলে নয় (বছর)।তখন
আমার উম্মাতের মধ্যে নিয়ামত সর্বজনীন হবে। তারা এমনভবে
প্রাচুর্য ও নিয়ামত ভোগ করবে যা তারা ইতোপূর্বে কখনোই ভোগ করে নি। উম্মাতকে
সকল প্রাচুর্য দেওয়া হবে এবং মাহদী তাদেরকে না দিয়ে কিছুই সঞ্চিত করে রাখবে না। তখন
সম্পদ হবে অফুরন্ত। কোনো ব্যক্তি যদি বলে, হে মাহদী, আমাকে প্রদান
করুন তবে মাহদী বলবে: তুমি নিয়ে যাও।” হাদীসটি হাসান।
পঞ্চম হাদীস: উম্মু সালামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْمَهْدِيُّ مِنْ عِتْرَتِي مِنْ وَلَدِ فَاطِمَةَ
“মাহদী
আমার বংশের, ফাতিমার
বংশধর থেকে।”
হাদীসটি সহীহ।
ষষ্ঠ হাদীস: সাওবান (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَقْتَتِلُ عِنْدَ كَنْزِكُمْ ثَلَاثَةٌ كُلُّهُمْ ابْنُ خَلِيفَةٍ ثُمَّ لَا يَصِيرُ إِلَى وَاحِدٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَطْلُعُ الرَّايَاتُ السُّودُ مِنْ قِبَلِ الْمَشْرِقِ فَيَقْتُلُونَكُمْ قَتْلًا لَمْ يُقْتَلْهُ قَوْمٌ ثُمَّ ذَكَرَ شَيْئًا لَا أَحْفَظُهُ فَقَالَ فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَبَايِعُوهُ وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الثَّلْجِ فَإِنَّهُ خَلِيفَةُ اللَّهِ الْمَهْدِيُّ
“তোমাদের
সংরক্ষিত সম্পদ নিয়ে তিন ব্যক্তি লড়াই করবে, তিনজনই খলীফার সন্তান। তাদের
তিনজনের একজনও তা অধিকার করতে পারবে না। এরপর পূর্ব দিক
থেকে কাল পতাকাসমূহের উদয় হবে, তখন তারা তোমাদেরকে এমনভাবে হত্যা করবে যেভাবে ইতোপূর্বে
কেউ করে নি। এরপর তিনি কিছু বললেন, যা আমি মনে
রাখতে পারি নি। এরপর বলেন: যখন তোমরা তা দেখবে তখন তার বাইয়াত করবে। বরফের
উপরে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও বাইয়াত করবে; কারণ সেই আল্লাহর খলীফা মাহদী।” ইমাম বাযযার, হাকিম
নাইসাপূরী, যাহাবী, বূসীরী, সুয়ূতী ও
অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আলবানী হাদীসটি
শেষ বাক্যটিকে যয়ীফ বলেছেন।
বুখারী ও মুসলিম সংকলিত কয়েকটি হাদীস ইমাম মাহদী প্রাসঙ্গিক বলে গণ্য করেছেন
আলিমগণ। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)
বলেন:
كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا نَزَلَ ابْنُ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَإِمَامُكُمْ مِنْكُمْ
“তোমরা
কি জান তোমাদের কী অবস্থা হবে যখন মরিয়মের পুত্র ঈসা যখন তোমাদের মধ্যে অবতরণ
করবেন আর তখন তোমাদের ‘ইমাম’ হবেন তোমাদেরই
মধ্যকার একজন।”
অন্য হাদীসে জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ – قَالَ – فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ -صلى الله عليه وسلم- فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ لَنَا. فَيَقُولُ لاَ. إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ. تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الأُمَّةَ.
“আমার
উম্মাতের কিছু মানুষ হক্কের উপরে বিজয়ী থেকে লড়াই করে চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। তিনি
বলেন: অতঃপর মরিয়মের পুত্র ঈসা (আ) অবতরণ করবেন তখন তাদের আমীর বলবে: আসুন আমাদের
জন্য ইমাম হয়ে সালাত আদায় করুন। তিনি বলবেন: না, আপনারা একে
অপরের উপর আমীর, এটি এ
উম্মাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্মাননা।”
এ সকল হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেন যে, ইমাম মাহদীর সময়েই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন এবং তাঁরই ইমামতিতে
তিনি সালাত আদায় করবেন।
উপরের হাদীসগুলো থেকে আমরা নিম্নের বিষয়গুলো জানতে পারি:
(ক) ‘ইমাম মাহদী’ বলতে একজন
হেদায়াতপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান বুঝানো হয়েছে। যিনি
রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে বিশ্বে প্রাচুর্য, শান্তি, ইনসাফ ও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।
(খ) তিনি
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বংশধর এবং ৭ বা ৯ বৎসর রাজত্ব করবেন।
(গ) তার
রাজত্বকালেই ঈসা (আ) অবতরণ করবেন।
(ঘ) তার
ইমামত, খিলাফত
বা শাসন আরবদেশ কেন্দ্রিক হবে।
(ঙ) তার
ক্ষমতাগ্রহণের পূর্বে ক্ষমতা নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ হবে। বাইতুল্লাহর
পাশে তার বাইয়াত হবে। সিরিয়া, ইরাক ও
পূর্বদিক থেকে তার পক্ষে যোদ্ধারা আসবে।
) জানিয়েছেন। তবে
যখন তার বিরোধী সৈন্যবাহিনী ভূমিধ্বসে ধ্বংস হবে, সিরিয়া, ইরাক ও পূর্ব দিকের সেনাবাহিনী তাঁর বাহিনীতে যোগ দিবে এবং
সামগ্রিকভাবে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে বা মুসলিম উম্মাহ তাঁকে স্বীকার করে
নিবে, তখন
মুমিনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর বাইয়াত করা। এজন্য
ইমাম মাহদী প্রসঙ্গে ইমাম সুফিয়ান সাওরী বলেন:r(চ) এ
রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতাগ্রহণ, বাইয়াত ইত্যাদি বিষয়ে মুমিনের কোনো দায়িত্ব নেই। এগুলো
ঘটবে বলে রাসূলুল্লাহ (
لو مر ببابك فلا تبايعه حتى يجتمع الناس عليه
যদি তিনি তোমার দরজা দিয়ে গমন করেন তবুও তুমি তাঁর বাইয়াত করবে না; যতক্ষণ না সকল
মানুষ তাঁর বিষয়ে একমত হয়।
ইমাম মাহদী দাবিদারগণ
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি যে, যুগে যুগে অনেক মানুষ নিজেকে ইমাম মাহদী বলে
দাবি করেছেন এবং দ্রুত জুলুম-অনাচার দূর করে ইনসাফপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
আবেগে অথবা স্বপ্ন ও কাশফের গল্পে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। সব
স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে। অকারণে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত
হয়েছেন বা রক্ত দিয়েছেন। ইতিহাসের বইগুলো ঘাটলে এরূপ কয়েক
হাজার প্রসিদ্ধ ‘ইমাম
মাহদী’-র
পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি।
(১) মুহাম্মাদ
ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান হাসানী: আন- নাফসুস যাকিয়্যাহ (৯৩-১৪৫ হি)।তিনি
আলী-বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, আবিদ ও বীর ছিলেন। আব্বাসী খিলাফত
প্রতিষ্ঠার আগে নবী-বংশের খিলাফতের নামে আব্বাসী নেতৃবৃন্দ তাঁর হাতেই বাইয়াত করেন। কিন্তু
১৩২ হিজরীতে উমাইয়াগণের পতনের পর আব্বাসীগণ ক্ষমতা দখল করেন। দ্বিতীয়
আব্বাসী খলীফা মানসূর (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন। তিনি
লুকিয়ে থাকার কারণে খলীফার বাহিনী তাঁর পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করে এবং
নির্যাতন করে হত্যা করেন। এ পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ করেন। মদীনা, বসরা ও
অন্যান্য স্থানে তাঁকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু
আব্বাসী সেনাবাহিনী ১৪৫ হিজরীতে তাকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন
অনেক নেককার বুজুর্গ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম তাকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস
করেছিলেন এবং তাঁর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন।
(২) তৃতীয়
আব্বাসী খলীফা মাহদী (জন্ম: ১২৭, খিলাফাত: ১৫৮-১৬৯ হি)।তিনি
দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর মানসূরের পুত্র। মনসূরের
মূল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি পুত্রের নাম রাখেন মুহাম্মাদ। মানসূরের
মৃত্যুর পর মাহদী খলীফা হন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি
করতেন। তার এ দাবীর পক্ষে কিছু দুর্বল হাদীসও
বিদ্যমান, যেগুলোতে
বলা হয়েছে যে, ইমাম
মাহদী আব্বাসের বংশধর হবেন।
(৩) হুসাইন
ইবন যাকরাওয়াইহি ইবন মাহরাওয়াইহি (২৯১ হি)।তিনি নিজেকে
ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে
লুটপাট ও গণহত্যা চালান। সর্বশেষ আব্বাসী খলীফা মুকতাফী
বিল্লাহ নিজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই ইমাম মাহদীর বাহিনীকে পরাজিত করেন ও তাকে
মৃত্যুদ- প্রদান করেন।
(৪) উবাইদুল্লাহ
ইবন মাইমূন কাদ্দাহ (২৫৯-৩২২ হি)।তৃতীয় হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে ২৯৬
হিজরী সালে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে প্রচার করেন। কাইরোয়ানে
২৯৭ হিজরীতে তাঁর অনুসারীরা ইমাম মাহদী ও ইমামে যামান হিসেবে তার হাতে বাইয়াত
গ্রহণ করে। দ্রুত তারা মরক্কোয় তাদের ‘ফাতিমী’ রাজত্ব
প্রতিষ্ঠা করেন। ৩৫৮ হিজরীতে তার বংশধর মিসর দখল করেন। প্রায়
দুই শতাব্দী পর ৫৬৭ হিজরী সালে সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে মিসরের ফাতিমী শীয়া মাহদী
রাজত্বের পতন ঘটে।
(৫) হুসাইন
ইবন মানসূর হাল্লাজ (৩০৯ হি)।তিনি সূফী ও দার্শনিক হিসেবে
প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর মধ্যে ফানাপ্রাপ্ত ও
বাকা প্রাপ্ত ওলী, অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী, নতুন
শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইমাম
মাহদী ইত্যাদি দাবি করেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁর বহু অলৌকিক
ক্ষমতার কথা প্রচার করে। ৩০৯ হি. সালে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান
করা হয়। তবে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন
নি, বরং
তাঁর একজন শত্রুকে তার আকৃতি প্রদান করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।
(৬) আল-মুয়িয্য
ইবনুল মানসূর: মাআদ ইবন ইসমাঈল ইবন উবাইদুল্লাহ ফাতিমী (৩৬৫ হি)।পূর্বোক্ত
উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন-এর পৌত্র। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবি
করেন। তিনি কয়েক দিন নির্জনে থাকেন এবং দাবি করেন যে, তিনি এ সময়ে
আরশে আল্লাহর সাথে ছিলেন। তার অনুসারীরা তার অগণিত কারামত
প্রচার করতেন। এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গভীর প্রভাব
পড়ে। তিনি ক্রমান্বয়ে মিসর দখল করে কাইরো শহর প্রতিষ্ঠা করেন।
(৭) বালিয়া
(৪৮৪ হি)।এ ব্যক্তি শয়তান-সাধক ও জ্যোতিষী (ধংঃৎড়ষড়মবৎ)
ছিল। মানুষদেরকে অনেক ভেল্কি দেখিয়ে ৪৮৩ হি. সালে দাবি করে যে, সেই ইমাম মাহদী। তাকে
যে অবিশ্বাস করবে সে কাফির। সাধারণ মানুষেরা অনেকেই তাকে
বিশ্বাস করে তার দলে যোগ দেয়। সে বসরা অঞ্চলে অনেক শহর ও গ্রাম
দখল করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ বছরেরই শেষ প্রান্তে সে ধৃত ও
নিহত হয়।
(৮) মুহাম্মাদ
ইবন আব্দুল্লাহ ইবন তাওমারত (৪৮৫-৫২৪ হি)।৬ষ্ঠ হিজরী
শতকের শুরুতে মরোক্কোয় তিনি আলিম, আবিদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রসিদ্ধি
লাভ করেন। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর ও ইমাম মাহদী বলে
দাবি ও প্রচার করেন। দ্রুত তাঁর অনুসারী বাড়তে থাকে। মরোক্কোর
শাসক ইবন তাশফীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘বিশুদ্ধ’ ইসলামী রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ
করতে থাকেন। রাষ্ট্র দখলের আগেই তার মৃত্যু হয়। তার
সাথী ও খলীফা আব্দুল মুমিন মরক্কোর শাসনক্ষমতা দখল করে নতুন রাজবংশের রাজত্ব
প্রতিষ্ঠা করেন।
(৯) আহমদ
ইবন আব্দুল্লাহ ইবন হাশিম মুলাস্সাম (৬৫৮-৭৪০ হি)।মিসরে
ফকীহ, আবিদ, সূফী ও ওলী
হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। একপর্যায়ে ৬৮৯ সালে তিনি নিজেকে
মাহদী হিসেবে দাবি করেন। তিনি তার কারামত ও হাল সম্পর্কে
আল্লাহর নামে শপথ করে অনেক দাবি-দাওয়া করেন। তিনি দাবি করেন
যে, তিনি
মহান আল্লাহকে স্বপ্নে দেখেন ও তাঁর সাথে কথা বলেন, তাকে মহান আল্লাহর কাছে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়
এবং তিনি তাকে মাহদী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক
দাবি-দাওয়া তিনি ও তার অনুসারীরা করেন। তাকে কয়েকবার
কারারুদ্ধ করা হয়।
(১০) শাইখ
আবুল আব্বাস আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ সালজামাসী, ইবন মহাল্লী (৯৬৭-১০২২ হি)।মরক্কোর
সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও সূফী ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি ফিকহে পারদর্শিতা
অর্জন করেন। এরপর তিনি তাসাউফের বিভিন্ন তরীকায় অনুশীলন
করে কাশফ-কারামত সম্পন্ন সূফী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার
কারামত ও ইবাদতের প্রসিদ্ধির কারণে দলেদলে মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায়। তিনি সমাজে প্রচলিত
অন্যায়, জুলুম
ও পাপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী
বলে দাবি করেন। তিনি পাপী ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের
মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেন। মরোক্কোর
তৎকালীন শাসকের বাহিনীকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি সালজামাসা শহর অধিকার
করেন এবং তথায় তিন বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১০২২ হিজরীতে
এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মরক্কো শহরের প্রাচীরে তার ও তার
কয়েকজন ঘনিষ্ট ভক্তের কর্তিত মাথা প্রায় ১২ বৎসর ঝুলানো ছিল। তার
অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে,
তিনি নিহত হন নি, বরং
তিনি লুকিয়ে রয়েছেন এবং যথাসময়ে প্রকাশিত হবেন। পরবর্তী
কয়েকশত বৎসর পর্যন্ত অনেক মানুষ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন।
(১১) মুহাম্মাদ
আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ (১২৫৯-১৩০২হি/১৮৮৫খৃ)।সুদানের
সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও ইমাম মাহদী। সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর
প্রভাব সুদূর প্রসারী। ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানে
পারদর্শিতা অর্জনের পর তিনি তাসাউফের অনুশীলন, ইবাদত-বন্দেগি এবং শিক্ষা প্রচারে মনোনিবেশে
করেন। ক্রমান্বয়ে তার ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি
শাসকদের অনাচার থেকে দেশকে পবিত্র করার দাওয়াত দিতে থাকেন। ১২৯৮ হি/১৮৮১
খৃস্টাব্দে তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। সুদানের
আলিমদের পত্র লিখে তাকে সহযোগিতা করতে আহ্বান জানান। তিনি ‘দরবেশ’ উপাধিতে
আখ্যায়িত তাঁর অনুসারীদেরকে সুদানের সকল অঞ্চলে জিহাদের দাওয়াত দিতে প্রেরণ করেন। মিসর-সুদানের
সরকারী বাহিনী ও বৃটিশ বাহিনী অনেকবার মাহদীর বাহিনীকে নির্মূল করতে চেষ্টা করে। কিন্তু
মূলত এ সকল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। সমগ্র সুদান
মাহদীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে অল্প কিছুৃ দিনের মধ্যেই তিনি
বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার
স্থলাভিষিক্ত ও অনুসারীরা তাদের রাজত্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। তবে
অল্প সময়েই তারা পরাজিত হন এবং সুদান ও মিসর বৃটিশের অধীনে চলে যায়।
(১২) আলী
মুহাম্মাদ ইবন মিরযা রিদা শীরাযী (১২৬৬ হি/ ১৮৫০খৃ)।বাবিয়্যা
বাহায়ী মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা। ইরানের শীরায প্রদেশে তার জন্ম। সংসার
ত্যাগ, সাধনা, ঘণ্টার পর
ঘণ্টা রৌদ্রে অবস্থান ইত্যাদি দ্বারা তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি
নিজেকে প্রথমে ‘আল-বাব’ অর্থাৎ দরজা
উপাধিতে আখ্যায়িত করেন। এরপর তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে
দাবি করেন। স্বভাবতই অনেক মানুষ তার অনুসারী ও ভক্ত হয়ে
যায়। সর্বশেষ তিনি সকল ধর্মের সমন্বয়ে নতুন এক ধর্মের উদ্ভাবন
করেন। তার এ নতুন ধর্ম সমাজে অনেক হানাহানি সৃষ্টি করে। ১৮৫০ খৃস্টাব্দে
তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়।
(১৩) মির্যা গোলাম
আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮খৃ)।কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সে
প্রথম দিকে সূফী দরবেশ ও কাশফ-কারামতের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ইসলামের
পক্ষে হিন্দু ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও বইপত্র লিখে বৃটিশ শাসিত মুসলিমদের
মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হিন্দু ও খৃস্টানদের প্রতিবাদের
নামে ১৮৮০ সালে বারাহীন আহমাদিয়া নামক গ্রন্থটির প্রথম খ- প্রকাশ করে। গ্রন্থটি
মূলত তার নিজের কাশফ ও কারামতের দাবি-দাওয়ায় পরির্পূণ। ক্রমান্বয়ে
তার দাবি-দাওয়া বাড়তে থাকে। ১৩০২ হিজর সালে (১৮৮৫খৃ) সে নিজেকে
চতুর্দশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে। ১৮৯১ সালে
সে নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করে। এরপর নিজেকে ঈসা মাসীহ বলে দাবী
করে। এরপর নিজেকে ওহী-প্রাপ্ত ছায়া নবী বলে দাবি করে। সর্বশেষ
১৯০১ সালে সে নিজেকে তিন লক্ষ মুজিযা প্রাপ্ত পূর্ণ নবী বলে দাবি করে। ১৯০৮ খৃস্টাব্দে
কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।
(১৪) মুহাম্মাদ
ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানী (১৪০০ হি/১৯৭৯ খৃ)।১৪০০ হিজরী
সালের প্রথম দিনে (১৯/১১/৭৯) এ মাহদীর আবির্ভাব। জুহাইমান
উতাইবী নামক একজন সৌদি ধার্মিক যুবক সমাজের অন্যায় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার
ছিলেন। সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলিমগণ তাকে ভালবাসতেন। ক্রমান্বয়ে
জুহাইমানের আন্দোলনে অনেক শিক্ষিত ও ধার্মিক যুবক অংশ গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে
জুহাইমানের একজন আত্মীয় মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানীকে তিনি প্রতিশ্রুত ইমাম
মাহদী হিসেবে ঘোষণা করেন। কাহতানী নিজে এবং তার অনেক অনুসারী
স্বপ্নে দেখতে থাকেন যে,
রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং কাহতানীকে ‘ইমাম মাহদী’ বলে জানাচ্ছেন। এভাবে স্বপ্নের
মাধ্যমে তারা সুনিশ্চিত হন যে কাহতানীই ইমাম মাহদী। যেহেতু
কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কাবা শরীফের পাশে হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের
মধ্যবর্তী স্থানে মাহদীর বাইয়াত হবে, এজন্য তারা ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিনে এ বাইয়াত সম্পন্ন করার
সিদ্ধান্ত নেন। অনেকগুলো লাশের কফিনের মধ্যে অস্ত্র ভরে ১/১/১৪০০
(১৯/১১/৭৯) ফজরের সময় তারা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। সালাতের
পর তারা মসজিদ অবরোধ করেন এবং ইমাম ও মুসল্লীদেরকে ইমাম মাহদীর বাইয়াত গ্রহণ করতে
বাধ্য করেন। সৌদি সরকারী বাহিনী দীর্ঘ ১৫ দিন প্রাণান্ত
প্রচেষ্টার পর অবরুদ্ধ মাসাজিদুল হারাম মুক্ত করেন। ইমাম
মাহদী ও তার অনেক অনুচর নিহত হয়। এছাড়া অনেক হাজী ও মুসল্লীও উভয়
পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হন।
(১৫) হুসাইন
ইবন মূসা হুসাইন আল-লুহাইদী। বর্তমান যুগের ‘ইমাম মাহদীগণের’ একজন। তিনি
কুয়েতের অধিবাসী। যুবক বয়সে পাপাচারের পথে ছিলেন। এরপর
তিনি ইবাদত-বন্দেগি ও নির্জনতার মধ্যে বাস করতে থাকেন। সমাজের
অবক্ষয়ের অজুহাতে মসজিদে সালাত আদায় বর্জন করেন। একপর্যায়ে
তিনি দাবি করেন যে তিনি ইমাম মাহদী, তার কাছে আল্লাহর ওহী ও ইলহাম আসে। নষ্ট
সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেন। ফলে অনেকেই তার
ভক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা দেখেছি যে, সহীহ
হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে,
প্রতিশ্রুত মাহদীর নাম ও পিতার নাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মতই হবে। এ
বিষয়টি প্রমাণ করে যে, লুহাইদী
মাহদী নয়। এজন্য এর ব্যাখ্যায় লুহাইদী প্রচার করে যে, এ সকল হাদীসে
মূলত রাসূলুল্লাহ সা.- এর পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছে। তিনি
পুনরুজ্জীবিত হয়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসবেন। বর্তমানে
মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক ভক্ত অনুসারী বিদ্যমান। পাশাপাশি
মধ্যপ্রাচ্যের আলিমগণ তার বিভ্রান্তিগুলো প্রকাশ করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
৯. ৭. বিভ্রান্তির কারণ ও প্রতিকার
ইতিহাসে এ জাতীয় শত শত ‘ইমাম
মাহদী’-র
সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা
নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেন। মাহদী দাবিদার
ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভ- ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার
মানুষও ছিলেন। তাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ
কার্যকর বলে আমরা দেখি:
(১) সমাজ
পরিবর্তনের অন্ধ আবেগ। সকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমান। পাপাচারী, জালিম ও
ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আবেগী
ধার্মিক মানুষ, বিশেষত
যুবক, এ সকল অন্যায়
দূর করে ‘আদর্শ’ সমাজ
প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও
দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ‘কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ’ ও ‘অসম্ভব’ বলে মনে হয়। এজন্য ‘জিহাদ’ বা ‘ইমাম মাহদী’ বিষয়টি খুবই
আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষ। ফলে এ
জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা।
অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান
ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা
প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর
ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। সকলেই
অপেক্ষা করেন, এই তো
মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ,
জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন। এগুলো সবই
পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশ। ফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও
প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজ। দুনিয়ায়
ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত
ও মর্যাদা লাভ করেন। মাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের
নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান।
(২) স্বপ্ন-কাশফের
উপর নির্ভর করা। মাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার
অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে
স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন। আর
রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েন। অথচ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে
জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নি। স্বপ্নে যদি
তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবে। তারপরও
স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এছাড়া
স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) দাবি করে মিথ্যা বলতে
পারে। বস্তুত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম
ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত
রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু
নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর
পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে ‘মাহদী’ বলে বিশ্বাস
করার কোনোরূপ দলীল নেই। কারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য
থাকবে, কিন্তু
এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন।
কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে
তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। কাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা
মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিত। তিনি
কিভাবে জানলেন যে, তিনি
মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র
ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়। নবীগণ
ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেন। এ সকল
দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?
)-এর পরে
কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা।rসাধারণত
তারা ওহীর দাবি করেন না;
কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভ- নবী বলে গণ্য হবেন। এজন্য
তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেন। সরলপ্রাণ
মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হন। অথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো
মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একই। কারণ
যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে
নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের
বলে দাবি করেছেন। অনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার
স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (
মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেন। মাহদী
ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলক। ভূমিধ্বস
হবে, পাহাড়
স্থানচ্যুত হবে… অন্যান্য
বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবে। কিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার
দায়িত্ব মুমিনের নয়। অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার
পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি
প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল
আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই
মুমিন তাকে মেনে নিবেন।
মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। চিন্তাটি
ভিত্তিহীন। যদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে
নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদী। আর যদি দাবি-দাওয়া
ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে
দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট
আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত। কারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন
তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায়
পৌঁছে দেবেন। সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত
বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত
করা।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল
অর্থ পরিত্যাগ। আকীদার
অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। উপরে আলোচিত
মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ
প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় না। তারপরও হাজার হাজার
মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন। হাদীসের স্পষ্ট
বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেন। কারো বিষয়ে একবার সুধারণা
প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়। এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া
পেশ করে। ফলে
তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেন। ঈমানী দুর্বলতার
কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়। আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর
রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব না। প্রত্যেকের প্রতিটি
কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করব। আর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ।