মানব জীবনে ইখলাস
(আন্তরিকতা) ;
-এর গুরুত্ব-তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তাঃ
@ আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
শিক্ষক, বাসীরাহ
ইন্টরন্যাশনাল মাদরাসা, উত্তরা, ঢাকা।
০১. অবতরণিকা / সূচনা / প্রারম্ভিকা / ভূমিকাঃ
সমস্ত স্তুতি ও ভূয়ুশী প্রশংসা
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের
সমূদয় কর্ম-কান্ডে ইখলাছ (আন্তরিকতা)-কে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। আর সালাত, সালাম ও শান্তি বর্ষিত
হোক সমস্ত নবী ও রাসূলদের সরদার আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর প্রতি, যিনি
নিজের গোটা জীবনকে ইখলাছ (আন্তরিকতা)-এর সুনীপন কারুকার্যে সজ্জিত করেছেন এবং
উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
পৃথিবী নামক এ বসুন্ধরার আলো আভার
গোধূলী ও উষা লগ্নের প্রতিটি মূহুর্তের প্রতিটি কর্ম-কান্ডে ইখলাছ
(আন্তরিকতা)-এর কোন বিকল্প নেই। মানব
দেহের জন্য রূহ (আত্মা) যেমন অপরিহার্য, মৎস্যের জন্য পানি
যেমন গুরুত্বপূর্ণ, গৃহ/বিল্ডিং-এর জন্য
স্তম্ভ/খুঁটির প্রয়োজনীয়তা যেমন অনুস্বীকার্য ঠিত তদ্রুপ ইখলাছ (একাগ্রতা, আন্তরিকতা)-এর
উপস্থিতিও শিরধার্য। তাই অদ্যকার সংক্ষিপ্ত
এই পরিসরে ‘মানব জীবনে ইখলাছ (আন্তরিকতা)-এর গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক বিষয়ে আলোকপাত
করার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ। যাতে
আমাদের ইহ-লৌকিক ও পার-লৌকিকের অনাগত জীবনে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি-সাচ্ছ্যন্দ, মঙ্গল-কল্যাণ, সফলতা ও মুক্তির
ঝিরঝির আব-হাওয়ায় সিক্ত হতে সচেষ্ট হওয়া যায়।
০২. ইখলাছ-এর শাব্দিক
বিশ্লেষণ ও মুখলিছের সংজ্ঞাঃ
ক. ইখলাছ শব্দের শাব্দিক অর্থ :
কোন কিছূকে অন্যান্য
বিষয় সমূহ থেকে নিরেট-নির্ভেজাল, নিরঙ্কুষ, খাঁটি ও খালি করা। এটিকে খাঁটি বলা হবে তখন, যখন তাহার সকল
দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত হবে এবং এটি সংরক্ষণ করা হবে এবং কোন কিছুর সাথে সংমিশ্রণ
হওয়া থেকে বিরত থাকবে। [লিসানুল আরব ২৬/৭; তাজুল আরূস, পৃ. ৪৪৩৭]।
ð নিরেট-নির্ভেজাল, নিরঙ্কুষ, খাঁটি ও খালি করা সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَإِنَّ لَكُمْ فِى الْأَنْعٰمِ لَعِبْرَةً نُّسْقِيكُم مِّمَّا فِى بُطُونِهِ مِن بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَّبَنًا خَالِصًا سَآئِغًا لِّلشّٰرِبِينَ﴾
অবশ্যই (গৃহপালিত) চতুস্পদ জন্তুর মধ্যে তোমাদের জন্য
শিক্ষা রয়েছে; ওগুলির
উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য হতে তোমাদেরকে আমি পান করাই বিশুদ্ধ দুগ্ধ, যা
পানকারীদের জন্য সুস্বাদু। [সূরা নাহল : ৬৬]। এখানে দুধ খাটি হওয়ার অর্থ তার মধ্যে রক্ত ও গোবর ইত্যাদির
কোনো প্রকার সংমিশ্রণ থাকার অবকাশ না থাকা। [তা‘রীফাত : ২৮]।
খ. ইখলাছ শব্দের পারিভার্ষিক অর্থ :
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নিকট ইবাদতের সাওয়াবের ক্ষেত্রে
বিশুদ্ধ, নিরঙ্কুষ ও খাঁটি হওয়ার ভিত্তিতে কাজ-কর্ম সম্পাদন করা। আল্লামা ইবনুল
কাইয়্যেম (রহ.) বলেন, “ইবাদতের দ্বারা
একমাত্র এক আল্লাহর উদ্দেশ্য নেওয়া। [মাদারেজুস সালেকীন ২/৯১]।
গ. ইখলাছ সম্পর্কে
সালফে-সালিহীনের উল্লেখযোগ্য বক্তব্যঃ
C আমলকে সৃষ্টিকুলের
সবার পর্যবেক্ষণ মুক্ত করে স্বচ্ছ করা (কেবল আল্লাহর পর্যবেক্ষণে রাখা)।
C আমলকে যাবতীয় (শির্ক, রিয়া ইত্যাদির) মিশ্রণ থেকে স্বচ্ছ রাখা’। [মাদারেজুস সালেকীন, ২/৯১-৯২]
ঘ. মুখলিসের সংজ্ঞা :
মুখলিস সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর সাথে তার আত্মা খাটি ও সংশোধিত হওয়ায়, মানুষের অন্তর থেকে তার মান-মর্যাদা পুরোপুরি বের হওয়াতে
কোনো প্রকার পরওয়া করে না। তার আমলের একটি কণা বা বিন্দু পরিমাণ বিষয়েও মানুষ অবগত হোক, তা সে পছন্দ করে না।
অনেক সময় দেখা যায়, মানুষের কথায় ও শরীয়তের ভাষায়, ‘নিয়্যত’ শব্দটি ‘ইখলাস’ এর স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ফিকহবিদদের মতে নিয়্যতের মূল
হচ্ছে, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে ইবাদতকে পৃথক করা এবং এক ইবাদতকে
অপর ইবাদত থেকে আলাদা করা। [জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম: ১/১১]।
০৩. মানব জীবনে ইখলাছের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও তার অবস্থানঃ
ক. মানব জীবনে ইখলাছের গুরুত্ব, তাৎপর্য :
মানব জীবনে ইখলাছের গুরুত্ব অপরিসীম। ইখলাছ হলো দুনিয়া ও আখেরাতের
সাফল্য ও বিজয়ের মূল ভিত্তি। সুতরাং এটা আমলের ক্ষেত্রে গৃহের খুটির ন্যায় এবং দেহের
ক্ষেত্রে রুহের ন্যায়। আর ইখলাছ হলো ইবাদাহ কবুলের মহান দু’টি রুকনের অন্যতম একটি রুকন।
খ. ইখলাছের মহল
(অবস্থান) হলো ; ক্বলব (হৃদয়) :
অন্তর বা হৃদয় পরিশুদ্ধ হলে সমস্ত শরীর সুস্থ
হয়ে যায়। আর অন্তর বা
হৃদয় রুগ্ন হলে সমস্ত শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : নুমান ইবনু বশীর (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে
শুনেছি যে,
أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ. أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ
জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা
যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা
শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা
শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল অন্তর। [সহীহ বুখারী ৫২ (তা. পা), ৫০ (ই. ফা) এবং আ. প্র), সহীহ মুসলিম ১৫৯৯, আহমাদ ১৮৩৯৬, ১৮৪০২]।
গ. অনুরূপভাবে প্রখ্যাত
তাবিয়ী আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহ.) হতে
বর্ণিত। আমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-কে মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে বলতে
শুনেছি, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি :
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ
আমল / কাজ-এর (সাওয়াব বা প্রতিদান প্রাপ্য হবে) নিয়্যাত অনুযায়ী। আর মানুষ তার নিয়্যাত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। তাই যার হিজরাত হবে ইহকাল লাভের অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ
করার উদ্দেশে- তবে তার হিজরাত সে উদ্দেশেই হবে, যে জন্যে, সে হিজরাত করেছে। [সহীহ বুখারী ০১ (ই. ফা, তা. পা. ও আ. প্র) সহীহ মুসলিম ১৯০৭, আহমাদ ১৬৮]।
০৪. বাস্তব জীবনে ইখলাছের প্রয়োজনীয়তা, বাধ্যবাদকতা ও ইখলাছ অর্জনের আদেশঃ
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কর্তৃক আবশ্যকীয়
সকল কর্মগত ও মৌখিক ইবাদত তথা সালাত, যাকাত ও সিয়ামসহ সকল ইবাদতে ইখলাছের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন।
ক. মুখলিছ ; একাগ্রতা,
একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা অবলম্বনের নির্দেশঃ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿إِنَّآ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ ◌ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ﴾
আমি তোমার নিকট এই কিতাব সত্যসহ অবতীর্ণ করেছি; সুতরাং
আল্লাহর ইবাদাত কর তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে। জেনে রেখ, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। [সূরা যমার : ০২ - ০৩]।
খ. সকল ইবাদাহ আল্লাহর
জন্য নিবেদিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়ঃ আল্লাহ সুবহানাহু
তায়ালা বলেন :
﴿قُلْ إِنَّ صَلَاتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلَّهِ رَبِّ الْعٰلَمِينَ ◌ لَا شَرِيكَ لَهُۥ وَبِذٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ﴾
তুমি বলে দাওঃ আমার
সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছু সারা জাহানের রাব্ব আল্লাহর
জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই, আমি এর জন্য আদিষ্ট
হয়েছি, আর মুসলিমদের মধ্যে আমিই হলাম
প্রথম। [সূরা আন‘আম : ১৬২ – ১৬৩]।
গ. পরকালে আল্লাহর সান্নিধ্য ও সাক্ষাৎ প্রার্থির
করণীয় হলো সৎকর্ম সম্পাদন করাঃ আল্লাহ
সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿فَمَن كَانَ يَرْجُوا لِقَآءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صٰلِحًا﴾
সুতরাং যে তার রবের সাথে সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎ কাজ
করে। [সূরা কাহাফ : ১১০]।
ঘ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি ব্যাতীত
সুনাম-সুখ্যাতীর উদ্দেশ্যে ইবাদাহ পালনকারীর জন্য পরকালে কোন কিছুই অবশিষ্ঠ থাকবে নাঃ
আবু উমামা বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললোঃ
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَرَأَيْتَ رَجُلاً غَزَا يَلْتَمِسُ الأَجْرَ وَالذِّكْرَ مَا لَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِصلى الله عليه وسلم : لاَ شَىْءَ لَهُ، فَأَعَادَهَا ثَلاَثَ مَرَّاتٍ يَقُولُ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : لاَ شَىْءَ لَهُ، ثُمَّ قَالَ " إِنَّ اللَّهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি কি বলেন, যে ব্যক্তি সম্পদ এবং সুনামের
জন্য জিহাদ করে, তার জন্য কি রয়েছে? রাসূল (সাঃ) বললেন : তার জন্য কিছুই নেই। তিনি তা তিনবার বললেন। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। তারপর তিনি বললেনঃ আল্লাহ তাআলা
খালেস আমল ব্যতীত, যা দ্বারা আল্লাহর
সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই উদ্দেশ্য না হয়, আর কিছুই কবুল করেন না। [হাসানঃ সুনান নাসঈ ৩১৪৪ (ই. ফা), ৩১৪০ (শামিলা), সহীহাহ ৫২, সহীহ আত-তারগীব
ওয়াত তারহীব ৬/৬/১]।
ঙ. ইবাদাহসহ সকল ক্ষেত্রে
বাহ্যিক বিত্ত-বৈভবের পরিবর্তে অন্তঃকরণ ও আমালের দিকটিই বিবেচ্যঃ আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও বিত্ত-বৈভবের
প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দৃষ্টি দিয়ে থাকেন তোমাদের অন্তর ও আমালের প্রতি। [সহীহ মুসলিম ৬৩১১ (ই. ফা), ৬৩৬০ ( ই. সে.), ২৫৬৪ (শামিলা)]।
চ. যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া
থাকবে না সেদিন তাঁর ছায়ার নীচে যারা আশ্রয় পাবেঃ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে
বর্ণিত। তিনি
বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إلَّا ظِلُّهُ : إِمامٌ عادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ تَعَالٰى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِيْ الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلانِ تَحَابَّا في اللهِ : اجتَمَعا عَلَيهِ، وتَفَرَّقَا عَلَيهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ، وَجَمَالٍ فَقَالَ : إِنِّيْ أَخَافُ اللهَ، ورَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فأَخْفَاهَا، حَتّٰى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِيْنهُ، ورَجُلٌ ذَكَرَ اللهُ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
সাত
ধরনের মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা সেদিন (কিয়ামতের দিন) তাঁর ছায়ার নীচে আশ্রয় দিবেন
যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে নাঃ (০১) ন্যায়পরায়ণ শাসক। (০২) সেই যুবক যে যৌবন বয়সে আল্লাহর ‘ইবাদাতে কাটিয়েছে। (০৩) যে
ব্যক্তি মাসজিদ থেকে বের হয়ে এসে আবার সেখানে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত মাসজিদেই তার
মন পড়ে থাকে। (০৪) সেই দুই ব্যক্তি, যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে। যদি তারা একত্রিত হয় আল্লাহর জন্য হয়, আর
যদি পৃথক হয় তাও আল্লাহর জন্যই হয়। (০৫) সে ব্যক্তি, যে একাকী অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে আর
আল্লাহর ভয়ে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে। (০৬) সে ব্যক্তি, যাকে
কোন উচ্চ বংশীয় সুন্দরী যুবতী কু-কাজ করার জন্য আহবান জানায়। এর উত্তরে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। (০৭) সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর পথে গোপনে দান করে। যার বাম হাতও বলতে পারে না যে, তার
ডান হতে কী খরচ করেছে। [সহীহ বুখারী ৬৬০, সহীহ মুসলিম ১০৩১, সহীহ
ইবন হিব্বান ৪৪৮৬, ইরওয়া ৮৮৭, নাসায়ী ৫৩৮০, তিরমিযী ২৩৯১, আহমাদ ৯৬৬৫]।
সুতরাং ইখলাছ হলো সকল বিষয় ও বস্তু থেকে নিরঙ্কুষ, খাঁটি ও খালি করা। যখন নিরঙ্কুষ, খাঁটি ও খালি করা অসম্ভব হয়ে যাবে তখন ইখলাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
০৫. ইসলামী শরীয়তে ‘রিয়া’ লৌকিকতা (প্রদর্শনেচ্ছা)-এর কোন অবকাশ নেইঃ
ইসলামী শরীয়তে ‘রিয়া’ লৌকিকতা
(প্রদর্শনেচ্ছা)-এর কোন অবকাশ নেই ; বরং ঘৃণার সাথে এটাকে নিষেধ করা হয়েছে। যদিও মানবজাতি ‘রিয়া’ লৌকিকতা
(প্রদর্শনেচ্ছা)-এর জন্য আকাঙ্খী তাই এটা নিষিদ্ধ ও গর্হিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন :
﴿فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ﴾
সুতরাং পরিতাপ সেই
সালাত আদায়কারীদের জন্য। [সূরা মাউন : ০৪]।
ক.
ইসলামী শরীয়ত মানবজাতিকে অবগত করিয়েছে যে, ‘রিয়া’ লৌকিকতা (প্রদর্শনেচ্ছা) এটা মুনাফিক (কপটতার) নিদর্শন। যা পরিত্যায্য ও প্রত্যাখ্যাত। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন :
﴿وَإِذَا قَامُوٓا إِلَى الصَّلٰوةِ قَامُوا كُسَالٰى يُرَآءُونَ النَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلَّا قَلِيلًا﴾
আর
যখন তারা সালাতের জন্য দাঁড়ায় তখন লোকদেরকে দেখানোর জন্য আলস্যভরে দাঁড়ায় এবং
আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে। [সূরা নিসা : ১৪২]।
খ. ইসলামী শরীয়ত ‘রিয়া’ লৌকিকতা (প্রদর্শনেচ্ছা)-কে ছোট / গুপ্ত শিরকের সাথে
সাদৃশ্য করে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের নিকট রাসূল (সাঃ) বের হয়ে আসলেন, আমরা তখন মসীহ দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি রাসূল (সাঃ) বলেন :
أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِي مِنَ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ قَالَ قُلْنَا بَلَى : فَقَالَ الشِّرْكُ الْخَفِيُّ أَنْ يَقُومَ الرَّجُلُ يُصَلِّي فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ رَجُلٍ
আমি কি তোমাদের এমন বিষয় অবহিত করবো না, যা
আমার মতে তোমাদের জন্য মসীহ দাজ্জালের চেয়েও ভয়ংকর? রাবী বলেন, আমরা বললাম, হাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন : গুপ্ত শেরেক। মানুষ সালাতে আদায় করতে দাঁড়ায় এবং লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের
জন্য সুন্দরভাবে সালাত আদায় করে। [তাহকীক আলবানীঃ হাসান। সুনার ইবনু মাযাহ ৪২০৪ (ই. ফা), আহমাদ ১০৮৫৯, মিশকাত ৫৩৩৩, সহীহ আয়-তারগীব ওয়াত তারহীব ২৭]।
গ. যে উদ্দেশ্য সাধনে
ইবাদাহ পালন করবে সে তা প্রাপ্ত হবে। যেমন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم : مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِهِ
যে ব্যক্তি লোক শোনানো ‘ইবাদাত করে
আল্লাহ্ এর বিনিময়ে তার ‘লোক-শোনানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন’। আর যে ব্যক্তি লোক-দেখানো ‘ইবাদাত
করবে আল্লাহর এর বিনিময়ে তার ‘লোক দেখানোর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেবেন’। [সহীহ বুখারী ৬৪৯৯ (শামিলা ও তা. পা), ৬০৫৫ (ই. ফা), ৬০৪৯ (আ. প্র), সহীহ মুসলিম ২৯৮৬]।
ঘ. ‘রিয়া’ লৌকিকতা (প্রদর্শনেচ্ছা)-এর ভয়াবহতাঃ মাহমুদ ইবনে লাবীদ আনছারী (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
إنَّ أخْوَفَ مَا أخَافُ عَلَيْكُمْ اَلشِّرْكُ الأصَغَرُ، قَالُوْا: وَمَا الشِّرْكُ الأصْغَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: اَلرِّيَاءُ، يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، إِذَا جُزِيَ الَّناسُ بِأعْمَالِهِمْ، اِذْهَبُوْا إلٰى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاؤُوْنَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً
আমি তোমাদের উপর যে
জিনিষটিকে বেশি ভয় করি, তা হল, ছোট শিরক। সাহাবীরা বলল, হে আল্লাহর
রাসূল! ছোট শিরক কি? তিনি উত্তর দিলেন, রিয়া। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের
দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেবেন, তখন রিয়াকারীকে বলবেন, যাও দুনিয়াতে যাদেরকে তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে, দেখ তাদের নিকট কোন সাওয়াব পাও কিনা? [সহীহঃ আহমাদ ২৩৬৮১, ২৩৬৩০, সহীহুত তারগীব ৩২, মিশকাতুল মাসাবীহ ৫২৬৩]।
০৬. ইখলাছবিহীন আমলের ভয়াবহতা ও অপূরণীয় ক্ষতিসমূহঃ
ক. যে দুনিয়ার উদ্দেশ্যে ইবাদত করে তার জন্য আখেরাতে কোন
প্রতিদান নেইঃ আল্লাহ
সুবহানাহু তা‘আলা বলেন :
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْءَاخِرَةِ نَزِدْ لَهُۥ فِى حَرْثِهِ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُۥ فِى الْءَاخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ﴾
যে কেহ আখিরাতের প্রতিদান কামনা করে তার জন্য আমি তার ফসল
বর্ধিত করে দিই এবং যে দুনিয়ার প্রতিদান কামনা করে আমি তাকে ওরই কিছু দিই। কিন্তু আখিরাতে তার জন্য
কিছুই থাকবেনা। [সূরা শুরা : ২০]।
খ. ইখলাছবিহীন আমল প্রত্যাখাত ও পরিত্যাক্তঃ যেমন আবূ হুরাইরা (রাযি.) থেকে
বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ فَمَنْ عَمِلَ لِي عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ غَيْرِي فَأَنَا مِنْهُ بَرِيءٌ وَهُوَ لِلَّذِي أَشْرَكَ
মহামহিম আল্লাহ বলেন, আমি শরীকদের (মুশরিকদের) শেরেক হতে মুক্ত। যে ব্যক্তি আমার জন্য কোন কাজ
করলো এবং তাতে আমি ব্যতীত অন্য কিছুকে শরীক করলো, আমি তা থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত। সে কাজ তার জন্য যাকে সে শরীক
করেছে। [তাহকীক
আলবানীঃ সহীহ। সহীহ মুসলিম ২৯৮৫, আহমাদ ৭৯৩৯, ৯৩৩৬, সুনান ইবনে মাযাহ ৪২০২]।
গ. যে ব্যক্তি আমলের বিনিময় দুনিয়াতেই পাওয়ার আকাঙ্খা করবে
সে পরকালে কিছুই পাবে নাঃ
যেমন উবাই ইবনে কা‘ব
(রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ বলেছেন :
بَشِّرْ هٰذِهِ الْأُمَّةَ بِالنَّصْرِ وَالسَّنَاءَ وَالتَّمْكِيْنَ، فَمَنْ عَمِلَ مِنْهُمْ عَمَلُ الْآخِرَةَ لِلدُّنْيَا، لَمْ يَكُنْ لَهُ فِيْ الْآخِرَةِ نَصِيْبٌ
এ জাতিকে সুসংবাদ দাও সাহায্য, আলো, উচ্চমর্যাদার। তবে এ উম্মতের মধ্যে যে কেউ আখেরাতের কাজ দুনিয়া হাসিলের
জন্য করবে, আখেরাতে সে কিছুই পাবে না। [সহীহ ইবনে হিব্বান ৪০৫, সহীহুত
তারগীব , আহমাদ ১২২৫৮, হাকিম ৭৮৬২]।
ঘ. কিয়ামতের দিন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে
ইখলাছ বিহীন আমলের কারণে কঠিন ও ভয়াবহ শাস্তির সম্মূখীণ করা হবেঃ যেমন আবূ হুরায়রা
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন :
إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ قَاتَلْتُ فِيكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لأَنْ يُقَالَ جَرِيءٌ، فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيكَ الْقُرْآنَ، قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْمَالِ كُلِّهِ فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا قَالَ فَمَا عَمِلْتَ فِيهَا قَالَ مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ قَالَ كَذَبْتَ وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ فَقَدْ قِيلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ ثُمَّ أُلْقِيَ فِي النَّارِ
কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে শহীদ হয়েছিল। তাঁকে হাযির
করা হবে এবং আল্লাহ তাঁর নিয়ামত রাশির কথা তাকে বলবেন এবং সে তাঁর সবটাই চিনতে
পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে।) তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ এর বিনিময়ে কি আমল করেছিলে? সে বলবে, আমি আপনার (সন্তুষ্টির) জন্য যুদ্ধ করেছি এমন কি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি বরং এ
জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকে তোমাকে বলে তুমি বীর। তা তো বলা
হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেওয়া হবে। সে মতে তাকে
উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার করা হবে-যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কুরআন
অধ্যায়ন করেছে। তখন তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তা’আলা তার প্রদত্ত নিয়ামতের কথা তাকে বলবেন এবং সে তা চিনতে
পারবে (এবং যথারীতি তার স্বীকারোক্তিও করবে) তখন আল্লাহ তা'আলা বলবেনঃ এত (বড় নিয়ামত পেয়ে বিনিময়ে) তুমি কি করলে? জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি এবং তা শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনারই (সন্তুষ্টি লাভের)
উদ্দেশ্যে কুরআন অধ্যায়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ তায়ালা
বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি তো জ্ঞান অর্জন
করেছিলে এজন্যে যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কুরআন
তিলাওয়াত করেছিলে এ জন্যে-যাতে লোকে বলে সে একজন ক্বারী। তা বলা হয়েছে। তারপর আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং
জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক
ব্যক্তির বিচার হবে যাকে আল্লাহ তা’আলা স্বচ্ছলতা
এবং সর্ববিধ সম্পদ দান করেছেন। তাকে হাযির করা হবে
এবং তাকে প্রদত্ত নিয়ামত সমূহের কথা তাঁকে বলবেন। সে তা চিনতে
পারবে (স্বীকারোক্তি করবে।) তখন তিনি (আল্লাহ
তায়ালা) বলবেনঃ এর বিনিময়ে তুমি কি আমল করেছো? জবাবে সে বলবে, সম্পদ ব্যয়ের এমন কোন খাত নেই যাতে সস্পদ ব্যয় আপনি পছন্দ করেন অথচ আমি সে
খাতে আপনার (সন্তুষ্টির) জন্যে করিনি। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলছো। তুমি বরং এ
জন্যে তা করেছিলে-যাতে লোকে তোমাকে “দানাবীর” বলে অবিহিত করে। তা বলা হয়েছে। তারপর নির্দেশ
দেওয়া হবে, সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়িয়ে
নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সহীহ মুসলিম ৪৭৭০ (ই. ফা), ১৯০৫ (শামিলা), সহীহুল জামি ২০১৪, নাসাঈ ৩১৩৭]।
ঙ. মুয়াবিয়া (রাযি.)-এর নিকট যখন
এ হাদীসটি পৌছলো তখন তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। এমনকি কান্নায় হত-বিহ্বল হয়ে পড়লেন। অতঃপর শান্ত হলে
বললেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) যথার্থই বলেছেন। তারপর তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়
তিলাওয়াত করলেন :
﴿مَن كَانَ يُرِيدُ الْحَيٰوةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمٰلَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ ◌ ولٰٓئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِى الْءَاخِرَةِ إِلَّا النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبٰطِلٌ مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾
যারা শুধু পার্থিব জীবন এবং ওর জাকজমকতা
কামনা করে, আমি তাদের কৃতকর্মগুলির ফল দুনিয়ায়ই দিয়ে দিই, তাদের জন্য কিছুই কম করা হয়না। এরা এমন লোক যে, তাদের জন্য আখিরাতে জাহান্নাম ছাড়া আর
কিছুই নেই; আর তারা যা কিছু করছে তাও বিফল হবে। [সূরা হুদ : ১৫ – ১৬]।
এখানে
বর্ণনা করা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি আমল করে আর সে আমলের বিনিময়ে দুনিয়া হাসিল করা বা দুনিয়ার সুনাম
ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য পাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে দুনিয়াতেই তার কর্মের পূর্ণ
প্রতিদান দিয়ে দেবেন, তাতে কম করে দেয়া হবে না। কিন্তু আখিরাতে তাদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া
কিছুই থাকবে না, তারা দুনিয়াতে যা আমল করেছে সব বাতিল হয়ে যাবে, আখিরাতে কোন উপকারে আসবে না।
০৭. ইখলাছযুক্ত আমলের
পুরস্কার ; তথা ইখলাছ নামক দৌলত অর্জিত হলে যে
সব শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হবেঃ
ক. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَوَهَبْنَا لِدَاوُۥدَ سُلَيْمٰنَ نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ﴾
আমি দাঊদকে দান করলাম
সুলাইমান। সে ছিল উত্তম বান্দা এবং সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী। [সূরা সওয়াদ : ৩০]।
খ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿إِنَّا وَجَدْنٰهُ
صَابِرًا نِّعْمَ الْعَبْدُ
إِنَّهُ أَوَّابٌ﴾
নিশ্চয়ই
আমি তাকে পেলাম ধৈর্যশীল। কত উত্তম বান্দা সে! সে ছিল আমার অভিমুখী। [সূরা সওয়াদ : ৪৪]।
গ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ
مِلَّةَ إِبْرٰهِيمَ
حَنِيفًا وَاتَّخَذَ
اللَّهُ إِبْرٰهِيمَ
خَلِيلًا﴾
আর
যে আল্লাহর উদ্দেশে আত্মসমর্পণ করেছে ও সৎকার্য করে এবং ইবরাহীমের সুদৃঢ় ধর্মের
অনুসরণ করে, তার অপেক্ষা কার ধর্ম উৎকৃষ্ট? এবং আল্লাহ ইবরাহীমকে স্বীয় বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছিলেন। [সূরা নিসা : ১২৫]।
ঘ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسٰى تَكْلِيمًا﴾
আল্লাহ
মূসার সাথে প্রত্যক্ষ কথা বলেছেন। [সূরা নিসা : ১৬৪]।
ঙ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَوْ ءَامَنَ أَهْلُ الْكِتٰبِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفٰسِقُونَ﴾
তোমরাই
সর্বোত্তম উম্মাত, মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব
ঘটানো হয়েছে, তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ
করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে; আর
যদি গ্রন্থ প্রাপ্তরা বিশ্বাস স্থাপন করত তাহলে অবশ্যই তাদের জন্য মঙ্গল হত; তাদের মধ্যে কেহ কেহ মু’মিন এবং তাদের অধিকাংশই দুস্কার্যকারী। [সূরা আল-ইমরান : ১১০]।
চ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرْجُوا اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْءَاخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا﴾
তোমাদের
মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে
তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। [সূরা আহযাব : ২১]।
ছ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَآ إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صٰلِحًا وَقَالَ إِنَّنِى مِنَ الْمُسْلِمِينَ﴾
ঐ
ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎ কাজ করে এবং বলেঃ আমিতো আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা ফুসসিলাত : ৩৩]।
জ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ
عَلَى الْكُفَّارِ
رُحَمَآءُ
بَيْنَهُمْ
تَرٰىهُمْ
رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ
فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوٰنًا
سِيمَاهُمْ
فِى وُجُوهِهِم
مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ﴾
মুহাম্মাদ
আল্লাহর রাসূল; তার সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং
নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর
অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সাজদাহয় অবনত দেখবে। তাদের
মুখে সাজদাহর চিহ্ন থাকবে। [সূরা ফাতহ : ২৯]।
ঝ. আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন :
﴿وَإِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِيمٍ﴾
তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। [সূরা আল-কলম : ০৪]।
০৮. ইখলাছ (আন্তরিকতা)-এর
গুণে গুণান্বিত মুখলিছ ব্যব্তিবর্গ আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এবং রাসূল (সাঃ)-এর প্রিয় পাত্র হিসেবে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশঃ
ক.
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন তখন সকলকে ভালবাসার আহ্বান
করা হয়ঃ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন :
إِنَّ اللَّهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِذَا أَحَبَّ عَبْدًا نَادَى
جِبْرِيلَ إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّ فُلاَنًا فَأَحِبَّهُ فَيُحِبُّهُ
جِبْرِيلُ، ثُمَّ يُنَادِي جِبْرِيلُ فِي السَّمَاءِ إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَبَّ
فُلاَنًا فَأَحِبُّوهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ وَيُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ
فِي أَهْلِ الأَرْضِ
আল্লাহ্
যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন
তিনি জিবরীলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ্
অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তাই
তুমিও তাকে ভালবাস। কাজেই জিব্রীল (আঃ) তাকে ভালবাসেন। অতঃপর জিবরীল (আঃ) আসমানে এ ঘোষণা করে দেন
যে, আল্লাহ্ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তোমরাও তাকে ভালবাস। তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালবাসে এবং পৃথিবীবাসীদের মধ্যেও
তাকে গ্রহণীয় করা হয়। [সহীহ বুখারী ৬৯৭৭ (ই. ফা), ৬৯৬৭ (আ. প্র), ৭৪৮৫ (তা. পা)]।
খ.
আল্লাহ সুবহানাহু বান্দার ধারণা ও বিশ্বাস মতইঃ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা
ঘোষনা করেন :
يَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا
مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي،
وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ
تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ
إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي
أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
আমি
সেইরূপই, যেরূপ
বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি তার সাথে থাকি যখন সে
আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে আমিও তাকে
নিজে স্মরণ
করি। আর যদি সে লোক-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে
তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তবে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই, যদি
সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু হাত অগ্রসর হই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি
তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হই। [সহীহ বুখারী ৬৯০১ (ই.
ফা)]।
গ.
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার অলীর সাথে দুশমনি করা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সাথে
যুদ্ধের নামান্তরঃ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন :
مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ، وَمَا
تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِي بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ،
وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ،
فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِي
يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِي يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِي يَمْشِي
بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِي لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِي لأُعِيذَنَّهُ،
وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِي عَنْ نَفْسِ
الْمُؤْمِنِ، يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ
যে
ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, তা
দ্বারাই কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত
দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার
এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা
দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা
দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা
দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে
অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা
করতে কোন দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে
থাকাকে অপছন্দ করি। [সহীহ বুখারী ৬০৫৮ (ই. ফা), ৬০৫২ (আ. প্র), ৬৫০২ (তা. পা.)]।
ঘ.
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য আমল করা সত্বেও মানুষ যদি তার প্রসংশা
করে তাহলে সেটা তার জন্য নগদ প্রাপ্ত সুসংবাদঃ
আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ)-এর নিকট আরয করা হল, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে কি অভিমত,
أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْخَيْرِ
وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ : تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْمُؤْمِنِ
যে
নেক আমল করে এবং লোকেরা তার প্রশংসা করে? তিনি বললেন, এতো মুমিন ব্যক্তির জন্য তাৎক্ষণিক (আগাম)
সুসংবাদ। [সহীহ মুসলিম ৬৪৮০ (ই. ফা), ৬৬১৪ (হা. এ), ৬৫৩২ (ই. সে.)]।
০৯. উপসংহার / যবণিকা / সমপনীঃ
পরিশেষে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কৃপা, অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি
অর্জন করত; জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
ইসলামের যথাযথ বাস্তবায়ন পূর্বক শয়তানের ও মানবরূপী শয়তানের অনুরসরণ থেকে সকল
প্রকার ধোঁকা ও প্রবঞ্চনামুক্ত হয়ে চির অশান্তির স্থান জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা
ও চির শান্তির স্থান জান্নাত লাভের জন্য মহান আল্লাহ আমাকে, আপনাকে, সকল পাঠক/পাঠিকা, কর্তৃপক্ষসহ তাওহীদি
জনতাকে তাওফীকসহ এবং ইখলাছের বলয়ে বলিয়ান হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
১০. নির্ঘন্ট / তথ্যপঞ্জী / সহায়কগ্রন্থাবলীঃ
ক. আল-কুরআনুল কারীম।
খ. নূরুল ইখলাছ, সায়ীদ আল-কাহতান।
গ. উন্মুক্ত ভার্চুয়াল গ্রন্থাগার ; মাকতাবাতুশ শামিলা।
ঘ. ইন্টারনেট ভিত্তিক মুক্তবিশ্বকোষ ; উইকিপিডিয়া।
ঙ. আমালুল কুলুব ; আল-ইখলাছ, ড. সালেহ আল-মুনজ্জিদ।
চ. লিমান আরাদ ইখলাছ, সুলতান শারী।
ছ. সিলসিলা আমাল কুলুব, শাইখ খালেদ উছমান আস-সাবত।
জ. অন্যান্য সাময়িকী ও গ্রন্থাবলী।
1. ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে
বর্ণিত যে, আইয়ুব (আঃ)-এর
অসুস্থতার সময় একদা শয়তান চিকিৎসকের বেশে আইয়ুব (আঃ)-এর পত্নীর সাথে সাক্ষাত
করেছিল। তিনি ওকে চিকিৎসক মনে করে স্বামীর চিকিৎসা করতে অনুরোধ করেন। ‘শয়তান বলল, এই শর্তে চিকিৎসা করতে পারি যে, আরোগ্য লাভ করলে একথার স্বীকৃতি দিতে হবে যে, আমিই তাকে আরোগ্য দান করেছি।’ এ স্বীকৃতিটুকু ছাড়া আমি আর কোন পারিশ্রমিক চাই না। স্ত্রী আইয়ূব (আঃ)-কে একথা বললে, তিনি বললেন, তোমার সরলতা দেখে সত্যই দুঃখ হয়। ওতো শয়তান ছিল। এ ঘটনার বিশেষতঃ তার স্ত্রীর মুখ দিয়ে
শয়তান কর্তৃক এমন একটা প্রস্তাব তার সামনে উচ্চারিত করানোর বিষয়টা তিনি
স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। তিনি খুব
দুঃখ পেলেন। কারণ, প্রস্তাবটা ছিল শেরেকীতে লিপ্ত করার একটা সূক্ষ্ম অপপ্রয়াস। তাই তিনি শপথ করে বসলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে সুস্থ করে তুললে স্ত্রীর এ অপরাধের জন্য তাকে একশত
বেত্ৰাঘাত করব। সে ঘটনার
প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, শপথ ভঙ্গ করো না, বরং হাতে এক মুঠে তৃণশলাকা নিয়ে তদ্বারা
স্ত্রীকে একশত বেত্ৰাঘাত করে শপথ পূর্ণ কর। তবে কোন অসমীচীন কাজের প্রতিজ্ঞা করলে তা ভেঙ্গে কাফফারা
আদায় করাই শরীআতের বিধান। এক
হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি কোন প্রতিজ্ঞা করে, অতঃপর দেখে যে, এ প্রতিজ্ঞার বিপরীত কাজ করাই উত্তম, তবে তার উচিত উত্তম কাজটি করা এবং প্রতিজ্ঞার কাফফারা আদায় করা। [মুসলিম: ১৬৫০]
2. রাসূল (সাঃ) বলেন : মনে রেখ, আমি প্রত্যেক অন্তরঙ্গ বন্ধুর অন্তরঙ্গতা থেকে বিমুক্ত ঘোষণা করছি, যদি আমি কাউকে ‘খলীল’ বা অন্তরঙ্গ বন্ধু গ্রহণ করতাম, তবে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম। তোমাদের সঙ্গী (অর্থাৎ রাসূল
(সাঃ) তিনি নিজেই) আল্লাহর খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু। মূলতঃ খলীল বলা হয়, এমন বন্ধুত্বকে যার বন্ধুত্ব অন্তরের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছে। অন্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
প্রবেশ করেছে। ইবরাহীম ‘আঃ) যেভাবে আল্লাহর খলীল, তেমনিভাবে মুহাম্মাদ (সাঃ)ও আল্লাহর খলীল। [মুসলিম: ২৩৮৩]
3. এ আয়াতে নূহ (আঃ)-এর পরে যেসব নবী-রাসূল আগমন করেছেন, তাদের সম্পর্কে প্রথমে সাধারণভাবে বলার পর তন্মধ্যে বিশিষ্ট ও মর্যাদাসম্পন্ন
কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে যে, এরা সবাই আল্লাহর রাসূল এবং তাদের নিকটও বিভিন্ন পন্থায় ওহী প্রেরিত হয়েছে। কখনো ফিরিশতাদের মাধ্যমে ওহী পৌছেছে, কখনো লিপিবদ্ধ কিতাব আকারে এসেছে, আবার কখনো আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলের সাথে পর্দার আড়াল থেকে কথোপকথন করেছেন। যে কোন পন্থায়ই ওহী পৌঁছুক না কেন, তদানুযায়ী আমল করা মানুষের একান্ত কর্তব্য। অতএব, ইয়াহুদীদের এরূপ
আবদার করা যে, তাওরাতের মত
লিখিত কিতাব নাযিল হলে আমরা মান্য করবো, অন্যথায় নয় -সম্পূর্ণ আহম্মকী ও স্পষ্ট কুফরী। আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা এক লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, যাদের মধ্যে স্বতন্ত্র শরীআতের অধিকারী রাসূলের সংখ্যা ছিল
তিনশ’ তের জন’। [সিহীহ ইবন হিব্বানঃ ৩৬১]
4. উম্মাতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠত্ব ও তৎসংক্রান্তঃ
ক. মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উম্মাত
সমস্ত উম্মাতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) এ আয়াতের
তাফসীরে বলেনঃ
خَيْرَ النَّاسِ لِلنَّاسِ، تَأْتُونَ بِهِمْ فِي السَّلاَسِلِ فِي أَعْنَاقِهِمْ حَتَّى يَدْخُلُوا فِي الإِسْلاَمِ
‘তোমরা অন্যান্যদের তুলনায়
সর্বোত্তম উম্মাত। তোমরা মানুষের ঘাড় ধরে ধরে
তাদেরকে ইসলামের সুশীতল ছায়ার দিকে আকৃষ্ট করছো এবং অতঃপর তারা ইসলাম কবূল করছে। [সহীহুল বুখারী ৪৫৫৭]।
খ. আনাস (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘তোমরা মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ লোক।’ [মুসনাদ ইবনু আবী হাতিম ২/৪৭২, ৪৭৩]।
গ. রাসূল (সাঃ) মিম্বরের ওপর ছিলেন এমন
সময় একজন লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনার নিকট কোন ব্যক্তি উত্তম? তিনি বলেনঃ ‘মানুষের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী কুর’আন কারীমের পাঠক, সবচেয়ে বেশী ধর্মভীরু, সবচেয়ে বেশী
সৎকার্যের আদেশ দানকারী, সর্বাপেক্ষা
অধিক মন্দকার্যে বাধাদানকারী এবং সর্বাপেক্ষা বেশী আত্মীয়তার বন্ধন সংযুক্তকারী।’ [মুসনাদ আহমাদ-৬/৪৩২, এাজমাউয যাওয়ায়িদ-৭/২৬৩]।
ঘ. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ
خَيْرُ الْقُرُوْنِ قَرْنِيْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ
‘সর্বোত্তম যুগ হচ্ছে আমার যুগ, তারপরে তার নিকটবর্তী যুগ এবং তারপরে তার পরবর্তী যুগ’। [সহীহুল বুখারী-২৫০৯, সহীহ মুসলিম-৬৬৩৩]।
ঙ. আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ)
থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
أُعْطِيْتُ مَا لَمْ يُعْطَ أَحَدٌ مِنْ الأنْبِيَاءِ، فَقُلْنَا : يَا رَسُوْلَ اللهِ، مَا هُوَ؟ قَالَ : نُصِرْتُ بِالرُّعْبِ وَأُعْطِيتُ مَفَاتِيحَ الأرْضِ، وَسُمِّيتُ أَحْمَدَ، وَجُعِلَ التُّرَابُ لِي طَهُورًا، وَجُعِلَتْ أُمَّتِي خَيْرَ الأمَمِ
‘আমি ঐ নি‘য়ামত প্রাপ্ত হয়েছি যা আমার পূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি।’ জনগণ জিজ্ঞেস করেনঃ ‘ঐ নি‘য়ামতগুলো কি?’ তিনি বলেনঃ (১) ‘আমাকে প্রভাব প্রদান দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে। (২) আমাকে পৃথিবীর চাবি প্রদান
করা হয়েছে। (৩) আমার নাম আহমাদ রাখা হয়েছে। (৪) আমার জন্য মাটিকে পবিত্র করা হয়েছে। (৫) আমার উম্মাতকে সমস্ত উম্মাত অপেক্ষা বেশী শ্রেষ্ঠত্ব দান
করা হয়েছে।’ [হাদীসটি হাসানঃ মুসনাদ আহমাদ ১/৯৮/৭৬৩, এাজমাউয যাওয়ায়িদ-১/২৬০, ২৬১]।
5. অকপট ও খাঁটি মুসলিমগণের
বর্ণনা প্রসঙ্গে এদের অসম দৃঢ়তার প্রশংসা করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণ
অনুকরণের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্যতাকে মূলনীতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম অনুপম আদর্শ
রয়েছে’। এদ্বারা রাসূল (সাঃ)-এর বাণীসমূহ ও কার্যাবলী উভয়ই
অনুসরণের হুকুম রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। [তাফসীর মুয়াস্সার]।
6. হাদীসটিতে
খাঁটি বান্দার গুণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে যার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আল্লাহর
নির্দেশের বাহিরে তিল পরিমাণও অগ্রসর হয় না। বান্দা
মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর ওদিকে আল্লাহ বলেন : ‘ওহে
প্রশান্তিময় আত্মা! চলে এসো তোমার প্রতিপালকের কাছে সন্তুষ্টি সহকারে এবং সন্তোষের
পাত্র হয়ে আমার (সম্মানিত) বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ কর আর প্রবেশ কর আমার জান্নাতে’। [সূরা
আল-ফজর : ২৯ – ৩০]।