বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সফর (ভ্রমণ) ও মুক্বীম (নিজ এলাকায় অবস্থানকারী) উভয় অবস্থায় একক ও যৌথ মালিকানায় কুরবানী ও তার সমাধান
সংগ্রহে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
সংগ্রহে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
আমাদের সমাজে
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভাগে কোরবানি দেয়ার প্রচলন অত্যান্ত বেশি। নিয়ম কানুন না জানার কারণে
অনেক সময় অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি দিতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা
বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। মূলত ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা এক পরিবারের পক্ষ থেকে একটা পশু কোরবানি করতে
পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের নামে
সাতটি কোরবানি করা যাবে। তবে অংশীদারি ভিত্তিতে কোরবানি করার দুটি পদ্ধতি হতে পারে। যথা :
১. সওয়াবের
ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন : কয়েক জন মুসলিম মিলে একটি বকরি
ক্রয় করল। অত:পর একজনকে ঐ বকরির মালিক বানিয়ে দিল। বকরির মালিক বকরিটি কোরবানি করল। যে কজন মিলে বকরি খরিদ
করেছিল সকলে সওয়াবের অংশীদার হলো।
২। মালিকানার অংশীদারির
ভিত্তিতে কোরবানি। দুজন বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সকলেই মালিকানার অংশীদার হিসেবে
কোরবানি করল। এ অবস্থায়
কোরবানি শুদ্ধ হবে না। অবশ্য উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ
পদ্ধতি জায়েয কি নাজায়েয অর্থাৎ উট বা গরুর এক সপ্তাংশ একটি পরিবারের তরফ থেকে
যথেষ্ট হবে কি?
উত্তর : সে ব্যাপারে
উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন, যথেষ্ট নয়। কারণ, তাতে ৭ জনের অধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া পরিবারের তরফ থেকে
একটি পূর্ণ দম (জান) যথেষ্ট হবে। আর ৭ ভাগের ১ ভাগ পূর্ণ দম নয়। (ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম, ৬/১৪৯)।
অনেকের মতে একটি মেষ বা ছাগের মতই এক
সপ্তাংশ উট বা গরু যথেষ্ট হবে। (শুমাইমিরী, মাজালিসু আশরি যিলহাজ্জাহ, পৃ. ২৬; আল-মুমতে ইবনে উসাইমীন, ৭/৪৬২-৪৬৩)।
মূলত এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে উলামাগণ
দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন :
১ম পক্ষ: মুসাফির ও মুক্বীম উভয় অবস্থায়
১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭ জন বা ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে
করেন।
২য় পক্ষ: মুসাফির
অবস্থায় উট বা গরু বা মহিষে ৭ জন বা ৭জনের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে
করেন। কিন্তু এ পক্ষ
মুক্বীম উভয় অবস্থায় ১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি
করাকে যথেষ্ট মনে করেন না।
এদের
মতানুযায়ী, মুক্বীম অবস্থায় একটি
পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশুই কোরবানি করতে হবে। কোরবানিতে অংশগ্রহণ ও সাত
ভাগা প্রসংগে প্রথম পক্ষের প্রমাণাদি ও বক্তব্য অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় কোরবানিকেও আল্লাহ বিভিন্নভাবে
আদায় করার বিধান দান করেছেন। ফলে আমরা উট, গরু, ছাগল ,ভেড়া, দুম্বার যেকোন একটা কোরবানি করতে পারি, আবার সবগুলো একসাথেও করতে পারি। আবার এককভাবে উট, গরু, মহিষ কোরবানি করতে না
পারলেও সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারি। কিন্তু একটি জন্তুতে সাত জনের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টি
হয়েছে। যেমন বলা হয়ে
থাকে,
শুধু সফরের অবস্থায় সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারবে, তবে তাদের একই পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, বিভিন্ন পরিবারের হলে নয়।
এ বিষয়টিকে
বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই- ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে
এক সফরে ছিলাম । এমতাবস্থায়
কোরবানির ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (তিরমিযী নাসাঈ, ইবনু মাজাহ)। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি গরু সাতজনের পক্ষ
কোরবানি করা যাবে...। (তিরমিযী)
হাদিসে বর্ণিত
সাতজনে একটি গরুতে শরীক হয়েছিলাম এ সাতজন শব্দের অর্থ বুঝতেই অনেকে ভূল করেছেন
এবং মনে করেছেন একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতের অধিক হলে সেই পরিবারের জন্য একটি
গরু বা উট যথেষ্ট নয়; অথচ একটি গরু বা উট শুধু এক
পরিবার নয়, বরং সাতটি পরিবারের জন্য
যথেষ্ট । আর সেই
পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। কারণ হাদিসে সাতজন বলতে সাতজন কর্তা ব্যক্তিকে বুঝানো
হয়েছে যাদের প্রত্যেকে একেকটা পরিবারের মালিক। যেমন- আপনি এক পরিবারের কর্তা, সুতরাং আপনার উপরই কোরবানির বিধান বলবৎ হবে ।আপনার সন্তান ও স্ত্রীর উপর এ বিধান বলবৎ হবে না। তবে হ্যাঁ তাদের কারো নামে যদি এ পরিমাণ
সম্পদ থাকে যে, তারা কোরবানি দেয়ার
সমর্থ্য রাখে।
তবে কারো কারো
মতে তাদের উপর কোরবানির বিধান বলবৎ হয়ে যাবে। তিরমিযী শরীফে লিখিত আবু আইয়ুব হতে
বর্ণিত সহিহ হাদিস দ্বারা এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, যা নিম্নরূপ:
আতা বিন
ইয়াসার বলেন, আমি আবু আইয়ুব (রা.) কে
প্রশ্ন করলাম যে, নবী (সা.) এর যুগে কোরবানি
কিভাবে করা হতো? তখন তিনি বললেন, এক ব্যক্তি তার ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি একটি ছাগল
কুরবনী করত, সেখান থেকে তারা খেত এবং
অন্যদের খাওয়াত, আর মানুষ এভাবে আনন্দিত হতো
ও গর্ববোধ করত। আর সে প্রথা
বর্তমানকাল পর্যন্ত চলে আসছে।
ইমাম শাওকানী (রাহ.)
নায়লুল আওতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সঠিক কথা হচ্ছে যে, একটি ছাগল একটি পরিবারের থেকে যথেষ্ট হবে যদিও তারা ১০০ জনের
পরিবার অথবা ততধিক হয়। নবী (সা.) এর সুন্নাতের এটাই ফায়সালা। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯২)। ইবনুল কাইয়িম (রাহ.) বলেন, নবী (সা.) এর তরীক্বা হচ্ছে যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেকে
যথেষ্ট হবে যদি তাদের সংখ্যা অনেক হয়। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯১)। নবী (সা.) এর যুগে এক
ব্যক্তি যেহেতু একটি ছাগলের কোরবানিতে অংশগ্রহণ করত ও সাত ব্যক্তি একটি গরু কিংবা
উটে অংশগ্রহণ করত, সুতরাং সাধারণ ভাবেই বুঝা
যায় যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য
যখন যথেষ্ট ছিল, তখন সাত ব্যক্তি ও তাদের
পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু কেন যথেষ্ট হবে না।
ইবনে আববাস (রা.)
এর হাদিসে বর্ণিত যে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামগণ সাতজন করে একটি গরুতে অংশগ্রহণ
করেছিলেন, তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোক
ছিলেন। জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, গরু সাত জনের পক্ষ হতে এবং উট সাত জনের পক্ষ হতে কোরবানি
করা যাবে। (মুসলিম, আবূ দাউদ)। ভারতবর্ষের মুহাদ্দিস
আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, অবশ্যই উট এবং গরুর কোরবানিতে বিভিন্ন পরিবারের অংশগ্রহণ প্রমাণিত যেমন ছাগলে
একই পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ প্রমাণিত। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯৩)।
No comments:
Post a Comment