বিসমিল্লাহির
রাহমানির রাহীম
জুম‘আর দিন (শুক্রবারে) বা বিশেষ কোন দিন মারা গেলে
কবরের শাস্তি মাফ করা হবে কী?
সংগ্রহে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
الحمد لله الذي هدانا إلى الإسلام – والصلاة والسلام على محمد صلى
الله عليه وسلم – أما بعد!
০১. প্রারম্ভিকাঃ
লোক সমাজে বহুল প্রচলিত ও ব্যাপকভাবে প্রচারিত, কথিত রয়েছে
যে, জুমুআর দিনে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব (শাস্তি) মাফ করে দেওয়া হয়। একারণেই
যে কোনো ফাসেক-ফাজের,
সুদখোর, ঘুষ-খোর
মোটকথা যত বড় অপরাধীই হোক-না কেন, শুক্রবার দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করলে
সাধারণ মানুষ দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে যে, মৃত ব্যক্তির কবরে কোনো আযাব হবে না; আর এ ধারা
অব্যহত থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। এর ব্যতিক্রমে কেউ বিশ্বাস করে
না।
আসুন জেনে নিই এসবের বাস্তবতা কতটুকু?
০২. বহুল প্রচলিত ও ব্যাপক প্রচারিত, কথিত কথার ভিত্তি
স্বরূপ কেউ কেউ এ হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। যথা :
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণিত
হয়েছে যে, রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
مَا
مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلَّا
وَقَاهُ اللهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ
‘কোন মুসলমান জুমুআর দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ
করলে, আল্লাহ
তা‘আলা তাকে কবরের ফিৎনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন’। [মুসনাদে
আহমদ হা/নং ৬৫৮২, তিরমিযি হা/নং
1074]।
০৩. বিবেকের প্রশ্ন :
উপরোক্ত
হাদীসের আলোকে পর্যালোর মাধ্যমে আমরা বাস্তবতার নিরিখে সমাধানে আসব ইনশা-আল্লাহ। বাস্তবেই
কি জুমুআর দিনে অথবা রাতে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যায়? উপরিউক্ত
হাদিসটি কোন পর্যায়ের?
হাদিসটি কি সহিহ?
বিষয়টি একটি পর্যালোচনার দাবী রাখে। প্রথমেই
আমরা হাদিসটি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো এরপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা
করবো, ইনশাআল্লাহ।
০৪. হাদীসের পর্যালোচনা :
হাদিসটি ইমাম তিরমিযি (রহঃ) নিম্নোক্ত সনদে
বর্ণনা করেছেন :
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ
بْنُ بَشَّارٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ، وَأَبُو عَامِرٍ
الْعَقَدِيُّ، قَالَا: حَدَّثَنَا هِشَامُ بْنُ سَعْدٍ، عَنْ سَعِيدِ بْن أَبِي
هِلَالٍ، عَنْ رَبِيعَةَ بْنِ سَيْفٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو
ইমাম তিরমিযি (রহঃ) বলেনে : হাদিসটি গরিব। এটি
এমন একটি হাদিস যার সনদ মুত্তাসিল নয়। রাবিয়া ইবনে
সাইফ (সরাসরি) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে শুনেছেন বলে আমাদের জানা নেই। ইমাম
তিরমিযি (রহঃ)-এর কথা থেকে বুঝা গেল যে, হাদিসটি মুত্তাসিল নয় অর্থাৎ এর সনদে
বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ এর মধ্যে
কোনো রাবী বাদ পড়েছে। কিন্তু রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ
ইবনে আমর (রাঃ)-এর মাঝে বাদ পড়া সেই রাবী কে?
বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ শরহু মুশকিলিল আসার (1/250) এ ইমাম
তাহাবী (রহঃ)-এর একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। তাঁর
রেওয়ায়েতে রাবিয়া এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ)-এর মধ্যখানে তিনজন রাবির কথা
এসেছে। এরা হচ্ছেন, ‘আব্দুর রহমান ইবনে ক্বাহযাম, ইয়ায ইবনে উকবা, সদফ’-এর এক
ব্যক্তি।
ইয়ায ইবনে উকবা একজন্ তাবেয়ী ছিলেন। (রিয়াযুন
নুফুস, আবু
বকর আব্দুল্লা ইবনে মুহাম্মদ আল মালেকী, পৃষ্ঠা 132) আর ‘ইবনে ক্বাহযাম’ সম্পর্কে
শায়েখ শুআইব আল আরনাউত (রহঃ) বলেন, তিনি ‘মাজহুলুল
হাল’। ইবনে মাকুলা
তার আল ইকমাল: 7/101-102 এর উল্লেখ করেছেন। আর ‘সদফী’ সম্পর্কে
বলেন, লোকটি
‘মুবহাম’
(অস্পষ্ট)। [মুসনাদে
আহমদ: 11/150]।
অবশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদিসটি
উপরিউক্ত সনদ ছাড়াও ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। যেমন
মুসনাদেন আহমদে 11/225 নিম্নোক্ত সনদে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে :
حَدَّثَنَا
إِبْرَاهِيمُ بْنُ أَبِي الْعَبَّاسِ حَدَّثَنَا بَقِيَّةُ حَدَّثَنِي مُعَاوِيَةُ
بْنُ سَعِيدٍ التُّجِيبِيُّ سَمِعْتُ أَبَا قَبِيلٍ الْمِصْرِيَّ يَقُولُ سَمِعْتُ
عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى
اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ مَاتَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ
الْجُمُعَةِ وُقِيَ فِتْنَةَ الْقَبْرِ
সনদের রাবি مُعَاوِيَةُ بْنُ سَعِيدٍ
التُّجِيبِيُّ ইবনে হিব্বান ছাড়া কেউ
তাঁর তাওসিক করেন নি। أَبو قَبِيلٍ
الْمِصْرِيَّ কে হাফেজ ইবেন হাজার
রহ. তাঁর তা‘জিলুল
মানফাআহ গ্রন্থে দুর্বল বলেছেন।
হাদিসটি ইমাম বাইহাকি (রহঃ) তাঁর ‘ইসবাতু
আযাবিল কাবর’ গ্রন্থে (82) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর থেকে নিম্নোক্ত
সনদে ‘মওকুফান’
অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।
أَخْبَرَنَا أَبُو عَبْدِ
اللَّهِ، وَأَبُو سَعِيدٍ قَالا: ثَنَا أَبُو الْعَبَّاسِ، نَا مُحَمَّدٌ، نَا
عُثْمَانُ بْنُ صَالِحٍ، ثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، أَخْبَرَنِي ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنْ
سِنَانِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الصَّدَفِيِّ، أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرِو
بْنِ الْعَاصِ، كَانَ يَقُولُ: " مَنْ تُوُفِّيَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ
لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ وُقِيَ الْفَتَّانَ ". وَرُوِيَ ذَلِكَ عَنْ أَنَسِ
بْنِ مَالِكٍ مَرْفُوعًا
এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের উপরিউক্ত
হাদিসটির ‘শাহিদ’
তথা সমার্থক আরো কয়েকটি হাদিস রয়েছে:
০১. আনাস (রাঃ)-এর হাদিস : হাদিসটি মুসনাদে
আবু ইয়া‘লাতে
নিম্নোক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে :
حَدَّثَنَا
أَبُو مَعْمَرٍ إِسْمَاعِيلُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ
جَعْفَرٍ، عَنْ وَاقِدِ بْنِ سَلامَةَ، عَنْ يَزِيدَ الرَّقَاشِيِّ، عَنْ أَنَسٍ،
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: " مَنْ مَاتَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وُقِيَ عَذَابَ
الْقَبْر
সনদের রাবি ‘ওয়াকিদ
ইবনে সালামাহ’ এবং ‘ইয়াযিদ
আর রাকাশি’ দু’জনই
দুর্বল রাবী।
০২. জাবির (রাঃ)-এর এর হাদিস : হাদিসটি ‘হিলইয়াতুল
আউলিয়া’ গ্রন্থে 3/155 নিম্নোক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে :
حدثنا عبد الرحمن بن العباس الوراق ثنا أحمد بن داود السجستاني ثنا
الحسن بن سوار أبو العلاء ثنا عمر بن موسى بن الوجيه عن محمد بن المنكدر عن جابر
قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من مات يوم الجمعة أو ليلة الجمعة أجير من
عذاب القبر وجاء يوم القيامة عليه طابع الشهداء
হাদিসের সনদে উমর ইবনে মুসা নামক রাবী, হাদিস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত। [বিস্তারিত
দেখুন, লিসানুল
মিযান: 6/148]।
প্রশ্ন হলো উপরিউক্ত তাখরিজকে সামনে রেখে আমরা কোন
সিদ্ধান্তে উপনিত হবো?
হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এবং এর কয়েকটি শাওয়াহিদ তথা
সমার্থক হাদিস থাকার কারণে এটাকে সহিহ কিংবা হাসান বলবো? নাকি একথা
বলবো যে, যদিও
অনেক সনদ এবং শাওয়াহিদ রয়েছে কিন্তু এই সকল সনদ এবং শাওয়াহিদগুলো এই পর্যায়ের নয়
যে সবগুলো মিলে হাদিসটি হাসান কিংবা সহিহের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে?
০৫. মুহাদ্দিসীনে কেরামের মতানৈক্য :
কেউ কেউ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে এটাকে ‘হাসান’ কিংবা ‘সহিহ’ মনে করেন। যেমন
মুনযিরি রহ. তাঁর আততারগী: (পৃ. 1286) গ্রন্থে সুয়তি রহ. ‘আল জামিউস সগির’
গ্রন্থে (ফয়জুল কাদির 5/499) হাদিসটিকে হাসান বলেছেন। এছাড়াও
সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী রহ. তাঁর ‘আহকামুল জানাইয’
গ্রন্থে পৃ. 50 হাদিসটিকে ‘হাসান’
অথবা ‘সহিহ’
বলেছেন। এর বিপরিত অনেক মুহাদ্দিস উক্ত হাদিসকে সহিহ
মনে করেন না। যেমন:
০১. ইমাম
তাহাবি (রহঃ) তিনি তাঁর শরহু মুশকিলিল আসার গ্রন্থে (1/250) প্রথমে হযরত আয়েশা রা.
থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিস- إنَّ لِلْقَبْرِ لَضَغْطَةً لَوْ كَانَ
أَحَدٌ نَاجِيًا مِنْهَا، نَجَا مِنْهَا سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ উল্লেখ করেন। এরপর বলেন, কেউ কেউ
বলেন, এই
হাদিসটি কি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিস مَا مِنْ
مُسْلِمٍ يَمُوتُ فِي يَوْمِ الْجُمُعَةِ، أَوْ لَيْلَةِ الْجُمُعَةِ إِلا بَرِئَ
مِنْ فِتْنَةِ الْقَبْرِ এর বিরোধী হয়ে গেল? এরপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবন আমরের হাদিসের
সনদের দুর্বলতা তুলে ধরে বলেন, এর দ্বারা (এই আলোচনার মাধ্যমে) হাদিসের সনদ
যে সঠিক নয়, এসম্পর্কে
আমরা অবগতি লাভ করতে পারলাম। আরো জানতে পারলাম যে তাঁর
(রাবিয়া, হাদিসের
রাবি) জন্য এমন কোনো কিছু রেওয়ায়েত করা বৈধ নয় যার মধ্যে আয়েশার হাদিস অন্তর্ভুক্ত
হয়ে যায়। (অর্থাৎ রাবিয়ার জন্যে এমন কিছু বর্ণনা করা
বৈধ নয় যা হযরত আয়েশা রা. এর পূর্বোক্ত হাদিসের বিরোধী হয়। ইমাম
তাহাবি রহ. এর কথার সারাংশ হচ্ছে-জুমুঅা বারে মৃত্যুর ফযিলত সংক্রান্ত হাদিসটি
অায়েশা রা. এর হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।
০২. হাফেয যাহাবি (রহঃ) তিনি তাঁর মিযানুল ই‘তিদাল
গ্রন্থে (7/81) এটিকে ‘মুনকার’
তথা আপত্তিজনক (এমন হাদিস যা ফাযায়েলের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য নয়) বলেছেন।
০৩. আল্লামা কাশমিরি (রহঃ) তিনি তিরমিযির ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল আরফুশ শাযী’ 2/351
তে বলেন : ما صح الحديث في فضل موت يوم الجعة
‘জুমুআর দিনে মৃত্য বরণের ফযিলত-সংক্রান্ত
হাদিস সঠিক নয়।’
০৪. সমসামিয়ক আলেম শায়খ শুআইব আল আরনাউত (রহঃ) মুসনাদে আহমদ
(11/150)-এর টীকায় আব্দুল্লাহ ইবনে আমরের হাদিসের ‘শাওয়াহিদ’
তথা সমার্থক কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, এসকল ‘শাওয়াহিদ’
হাদিসকে শক্তিশালি করার যোগ্যতা রাখে না। শায়খ
আলবানী তাঁর ‘আল জানাইয’
গ্রন্থে (পৃ. 35) মুকারকপুরির ‘তুহফাতুল
আহওয়াযী’ এর অনুসরণে হাদিসটিকে ‘হাসান’ কিংবা ‘সহিহ’ বলে ভুল
করেছেন।
০৬. আলোচনার সমাধান :
উপরিউক্ত আলোচনায় দেখা গেলো হাদিসটি সহিহ কি সহিহ নয়, এ ব্যাপারে
মুহাদ্দিসীনে কেরাম একমত নয়। তাহলে বিষয়টি সমাধান কীভাবে হবে? যেসকল
মুহাদ্দিস হাদিসটিকে হাসান কিংবা সহিহ মনে করেন, তাদের মতানুযায়ী কি একথা বলবো, হাদিসটি
যেহেতু সহিহ, সুতরাং
একথা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ
হয়ে যাবে। নাকি যে সকল মুহাদ্দিস উক্ত হাদিসটিকে সহিহ
এবং গ্রহণযোগ্য মনে করেন না তাদের কথানুযায়ী বলবো যে হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়; সুতরাং
শুক্রবারে মৃত্যু বরণ করলে কবরের আযাব মাফ হয়ে যায়, এমন কথা ভিত্তিহীন?
কি সিদ্ধান্তে উপনিত হবো? এবিষয়ে সমাধানে পৌঁছার জন্য কয়েকটি বিষয় জানা
প্রয়োজন:
ক. কবরের
আযাব সত্য। কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই
আযাব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত ঈমান। দ্বিতীয় শর্ত ঈমানের দাবি
অনুযায়ী জীবন যাপন,
বিশেষত যেসব গুনাহর কারণে কবরে আযাবের কথা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে সর্বোতভাবে
বেঁচে থাকা এবং যেসব আমলের দ্বারা কবরের আযাব থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি বর্ণিত
হয়েছে সেসব আমল গুরুত্বসহকারে করা। আর কবর ও আখিরাতকে সর্বোচ্চ
সুন্দর বানানোর চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকা উচিত।
খ. আল্লাহ
তাআলা পরকালে নাজাত এবং শাস্তি থেকে মুক্তির বিষয়টি আমলের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। বিশেষ
কোনো দিনে বা রাতে মৃত্যুর সাথে সম্পৃক্ত করেন নি। তাছাড়া
এটি একটি গায়রে এখতিয়ারি ফে‘ল। সুতরাং এর
সাথে আযাবে কবর মাফ হওয়ার বিষয়টি বাহ্যত অযৌক্তিক।
গ. যদি
বিশেষ কোনো দিনে মৃত্যু বরণ করা ফযিলতপূর্ণ হয়ে থাকে এবং একারণেই আযাবে কবর মাফ
হয়ে থাকে তবে সেই দিনটি সোমবার হওয়াই বেশি যুক্তিসংগত। কেননা
সোমবার এমন একটি দিন,
সহিহ হাদিসের আলোকে যে দিন আল্লাহ তাআলা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, যেদিন
জান্নাতের দরজাসমূহ খোলে দেওয়া হয়। সহিহ মুসলিমে (2566) হযরত আবু হুরায়রা রা.
থেকে বর্ণিত, রাসুল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সোমবার এবং বৃহস্পতিবারে জান্নাতে দরজাসমূহ
খোলে দেওয়া হয়, অত:পর
মুশরিক ব্যতীত সকল বান্দাকেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়। তবে
ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হয় না যার অপর ভাইয়ের সাথে বিদ্বেষ রয়েছে...
সোমবার এমন একটি দিন যেদিন আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহর
রাসুলের সাহাবিগণও শুক্রবারে মৃত্যুর কামনা করতেন। কিন্তু
আমরা একটি হাদিস কিংবা আছারেও একথা পাই নি যে আল্লাহর রাসুলের একজন সাহাবিও
শুক্রবারে মৃত্যুর কামনা করেছেন; অথচ ঐসকল সাহাবায়ে সব সময় আল্লাহর ভয়ে
কম্পমান থাকতেন এবং জাহান্নাম এবং কবরের শাস্তি থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই
চিন্তায় বিভোর থাকতেন। যদি এতো সহজে আযাবে কবর থেকে
মুক্তি পাওয়া যেত, তাহলে
সেই কামনা তারা করতেন। কিন্তু কেউ-ই শুক্রবারে মৃত্যুর
কামনা করেন নি। বরং এর বিপরিত আমরা দেখি আল্লাহর রাসুলের
সবচেয়ে প্রিয় সাহাবি হযরত আবু বকর রা. আল্লাহর রাসুলের মৃত্যুর দিন অর্থাৎ
সোমবারে মৃত্যুর কামনা করেছেন। হয়েছেও তাই। দেখুন, সহিহ বুখারি, হাদিস 3/252
ঘ. ইমাম
তাহাবি রহ. জুমুআর দিনে মৃত্যু বরণের ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিসটিকে হযতর আয়েশা রা.
থেকে বর্ণিত হাদিস-
لِلْقَبْرِ ضَغْطَةٌ لَوْ نَجَا مِنْهَا أَحَدٌ، لَنَجَا مِنْهَا
سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ
‘কবরের একটি চাপ রয়েছে। কারো
পক্ষে যদি সেই চাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো, তাহলে অবশ্যই সা‘দ ইবেন মুআয
সেই চাঁপ থেকে বাঁচতেন’
এই হাদিসের বিরোধী মনে করেন। আর এই হাদিসের কারণেই তিনি
জুমুআর ফযিলত-সংক্রান্ত হাদিসকে সহিহ মনে করেন।
‘যাগতা’ হচ্ছে : কবরের দু’পাশ মৃত ব্যক্তির শরিরের সাথে মিলে যাওয়া। সা’দ ইবনে মুআযের আযাবের কারণ কি? এসম্পর্কে
হাকিম তিরমিযি রহ. বলেন,
প্রত্যেকের কিছু-না কিছু গোনাহ তো আছেই। তাই কবরের
এই ‘যাগতা’
তথা চাপের মাধ্যমে সেই অপরাধ মাফ হয়। এটি হবে
অপরাধের প্রতিদান হিসেবে। ঠিক তেমনিভাবেই হযরত সা’দ ইবনে মুআযেরও কবরের চাপ হয়েছে, প্রশ্রাব
থেকে বেঁচে থাকার মধ্যে ত্রুটির কারণে। দেখুন, শরহুস
সুয়ুতী আলান নাসায়ী,
বাব, যাম্মাতুল
কাবরি ওয়া আযাবুহু।
০৭. লক্ষ্য করুনঃ
সা’দ ইবনে
মুআযের মতো সাহাবি, সুনানে
নাসায়ি (2055) এর বর্ণনা অনুযায়ী যার মৃত্যুতে আরশ কেঁপেছে, আসমানের
দরজাসমূহ খোলে দেওয়া হয়েছে, সত্তর হাজার ফেরেশতা যার জানাযায় শরিক হয়েছেন; সহিহ ইবনে
হিব্বানের বর্ণনা অনুযায়ী (3112) যার সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেছেন- কারো পক্ষে যদি কবরের চাপ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হতো, তাহলে
অবশ্যই সা’দ ইবেন মুআয
তা থেকে বাঁচতেন; এমন
সাহাবিও যখন কবরের আযাব থেকে মুক্তি থেকে পান নি; সুতরাং যে লোকটি সারাটি জীবন সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, এবং নেশার
মধ্যে কাটিয়েছে, যেই
লোকটি সারাটি জীবন হারামের উপর কাটিয়েছে; শুধু একটি গায়রে এখতিয়ারি (অনিচ্ছাকৃত) আমল
অর্থাৎ শুক্রবারে মৃত্যুর কারণে আযাবে কবর থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, বিষয়টি কি
যৌক্তিক মনে হয়?
ঙ. গোনাহগারের জন্য কবরের আযাবের বিষয়টি কুরআন হাদিসের অকাট্য
দলিল দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং এর বিপরিত কারো জন্য যদি
আযাবে কবর মাফ হওয়ার দাবী করতে হয় তাহলে এর স্বপক্ষে অকাট্য দলিল থাকতে হবে। এসম্পর্কে
মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি
ফিকহুল আকবারের ব্যাখ্যা গ্রন্থে আবু মুয়িনের রমযান এবং শুক্রবারে কবরের আযাব মাফ
সংক্রান্ত আলোচনাটি উল্লেখ করে বলেন : এটা সুস্পষ্ট বিষয় যে আকিদার ব্যাপারে
গ্রহণযোগ্য হল, ইয়াকিনি
তথা সুনিশ্চিত দলিল। ‘হাদিসে
আহাদ’ (যে হাদিসটি মুতাওয়াতির পর্যায় পৌঁছায়নি) যদি
প্রমাণিত হয় তবে তা জন্নি তথা সুনিশ্চিত দলিল নয়। তবে
হাদিসটি যদি একাধিক সনদের কারনে মুতাওতিরে মানবি (এমন দলিল যা এত সুত্রে বর্ণিত
হয়েছে যে যাকে যৌক্তির নিরিখে মিথ্যা বলা অসম্ভব হয়) হয় তখন সেটা কাতয়ী (সুদৃঢ়
দলিল) হয়ে যাবে। [মিনাহুর
রওদিল আযহার ফি শরহে ফিকহুল আকবার-২৯৫-২৯৬]।
উপরর্যুক্ত দীর্ঘ অালোচনার ভিত্তিতে বলতে চাই, শুক্রবারে
মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত কবরের অাযাব মাফ হয়ে যাবে (যেমনটি লোকমুখে
প্রসিদ্ধ) একথা বলার কোনো সুযোগ নেই। হ্যাঁ, শুক্রবারে মৃত্যু বরণের ফযিলত সংক্রান্ত
হাদিসটি যেহেতু বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত তাই যতদূর মনে হয়, হাদিসটি
হাসান পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাই উক্ত হাদিসের আলোকে এতটুকু
বলা যেতে পারে যে, শুক্রবারে
মৃত্যু হলে শুধু ঐ দিন কবরে আযাব হবে না। (হয়তো ঐ
দিনের বিশেষ ফযিলতের কারণে) কিন্তু এই হাদিস থেকে একথা কোনো ক্রমেই বলা যায় না যে, শুক্রবারে
মৃত্যু বরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত আযাব মাফ হয়ে যায়! অথচ মানুষের বিশ্বাস এমনি। [ওয়াল্লাহু ‘আলাম]।
একথার কোনোই ভিত্তি নেই। মুল্লা
আলী কারী (রহঃ) তাঁর ‘মিনাহুর
রওদিল আযহার ফি শরহে ফিকহুল আকবার (পৃ. ২৯৫-২৯৬) এ একথাটিই বলেছেন। তিনি
বলেন : ثبت في الجملة ان من مات يوم الجمعة او ليلة الجمعة يرفع العذاب
عنه الا أنه لا يعود اليه الي يوم القيامة فلا اعرف له اصلا
‘জুমার দিনে বা জুমার রাতে যে
মারা যাবে তার থেকে কবরের আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে, এটা মোটামুটি প্রমাণিত। তবে
কিয়ামত পর্যন্ত আর (আজাব) ফিরে আসবে না একথার কোন ভিত্তি আমার জানা নেই।’
০৮. উপসংহার :
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সকলের কবরের আযাব থেকে
মুক্তি দান করুন, আমিন।