Sunday, 3 November 2019

‘নবীদিবস' ও আলীমুশ শান জুশনে জুলুস এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়ের প্রমাণে ‘সূরা ইউনুস’-এর ৫৮ নং আয়াত এবং কিছু কথাঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সীরাত বিষয়ক আলোচনা :
নবীদিবস' ও আলীমুশ শান জুশনে জুলুস এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়ের প্রমাণে 
‘সূরা ইউনুস’-এর ৫৮ নং আয়াত এবং কিছু কথাঃ
সংকলনে, আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
 
০১. ভূমিকাঃ
জ্ঞানপাপীদের কুরআন অপব্যখ্যার নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত, তথাকথিত স্বঘোষিত-উদ্ভাবিত নব আবিস্কৃত ‘নবীদিবস' ও আলীমুশ শান জুশনে জুলুস এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়ের প্রমাণে ‘সূরা ইউনুস’-এর ৫৮ নং আয়াতটি উপস্থাপন করা হয়।

তাই উক্ত আয়াতের কয়েকটি তাফসীর নিম্নে পেশ করা হলো। যথা :

০২. আয়াতঃ
﴿قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَخَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ
০৩. অনুবাদঃ
তুমি বলে দাও, ‘এ হল তাঁরই অনুগ্রহ ও করুণায়; সুতরাং এ নিয়েই তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত; এটা তারা যা (পার্থিব সম্পদ) সঞ্চয় করছে তা হতে অধিক উত্তম’ [সূরা ইউনুস : ৫৮]।

০৪. তাফসীর / ব্যখ্যাঃ
ক. তাফসীল ইবন কাছীর (বাংলা ড. মুজীবুর রহমান), ৩/৮৬৮
কুরআন হচ্ছে উপদেশ, আরোগ্যদানকারী এবং সুসংবাদদাতা
 বান্দার উপর স্বীয় ইহসানের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন : يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ  হে লোক সকলতোমাদেরকে যে পবিত্র গ্রন্থটি (কুরআনুল কারীম) দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে নাসীহাতের একটি ভান্ডার যা তোমাদের রাব্ব আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِএটা তোমাদের অন্তরের সমস্ত রোগের আরোগ্য দানকারী وَهُدًى وَرَحْمَةٌ এটা তোমাদের অন্তরের সন্দেহ, সংশয়, কালিমা ও অপবিত্রতা দূরকারীআরও দূরকারী অন্তরের কালিমা ও শিরকএর মাধ্যমে তোমরা মহান আল্লাহর হিদায়াত ও রাহমাত লাভ করেত পারবে

কিন্তু এটা লাভ করবে একমাত্র তারাই যারা এর উপর এবং এতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার উপর বিশ্বাস রাখেআল্লাহ বলেন : وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا আমি অবতীর্ণ করেছি কুরআন, যা বিশ্বাসীদের জন্য সুচিকিৎসা ও দয়া, কিন্তু তা সীমা লঙ্গনকারীদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে। [সূরা ইসরা : ৮২]

قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ  বলঃ মুমিনদের জন্য ইহা পথ নির্দেশ ব্যধির প্রতিকার। [সূরা ফুসসিলাত : ৪৪]

قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا সুতরাং এটা নিয়ে তোমরা খুশি হয়ে যাও هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ আর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী যেসব ভোগ্য তোমরা লাভ করেছ সেগুলো অপক্ষো কুরআনই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম ও উৎকৃষ্টতম বস্তু। [তাফসীল ইবন কাছীর (বাংলা ড. মুজীবুর রহমান), ৩/৮৬৮]

খ. তাফসীর আহসানুল বয়ান :
'আনন্দ' বা 'খুশি' বলা হয় ঐ অবস্থাকে যা কোন আকাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জনের ফলে মানুষ নিজ মনে অনুভব করেমু'মিনগণকে বলা হচ্ছে যে, এই কুরআন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ অনুগ্রহ লাভ করে মু'মিনগণের আনন্দিত হওয়া উচিতএর অর্থ এই নয় যে, আনন্দ প্রকাশ করার জন্য জালসা-জলুস করে, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনরূপ অপচয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করবেযেমন বর্তমানের বিদআতীরা উক্ত আয়াত দ্বারা 'নবীদিবস' ইত্যাদি অভিনব বিদআতী অনুষ্ঠান বৈধ হওয়ার কথা প্রমাণ করতে চায়। [তাফসীর আহসানুল বয়ান]।

গ. তাফসীর যাকারিয়া, ড. আবু বকর যাকরিয়া :
অর্থাৎ মানুষের কর্তব্য হলো আল্লাহ তা'আলার রহমত ও অনুগ্রহকেই প্রকৃত আনন্দের বিষয় মনে করা এবং একমাত্র তাতেই আনন্দিত হওয়া দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ ও মান-সন্ত্রম কোনটাই প্রকৃতপক্ষে আনন্দের বিষয় নয়। কারণ, একে তো কেউ যত অধিক পরিমাণেই তা অর্জন করুক না কেন, সবই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে; পরিপূর্ণ হয় না। দ্বিতীয়তঃ সর্বদাই তার পতনাশঙ্কা লেগেই থাকে।

তাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে : ﴿هُوَخَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ অর্থাৎ আল্লাহর করুণা-অনুগ্রহ সে সমস্ত ধন-সম্পদ ও সম্মান-সাম্রাজ্য অপেক্ষা উত্তম, যেগুলোকে মানুষ নিজেদের সমগ্র জীবনের ভরসা বিবেচনা করে সংগ্রহ করে। এ আয়াতে দুটি বিষয়কে আনন্দ-হর্ষের বিষয় সাব্যস্ত করা হয়েছে।

একটি হলো (فضل) ফদল’, অপরটি হলো –( رحمة) ‘রহমত। আবু সাঈদ খুদরী ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাসহ অনেক মুফাসসির বলেছেন যে, ‘ফদলঅর্থ কুরআন; আর রহমত অর্থ ইসলাম। [কুরতুবী] অন্য বর্ণনায় ইবন আব্বাস বলেন, ‘ফদলহচ্ছে, কুরআন, আর তার রহমত হচ্ছে এই যে, তিনি আমাদেরকে কুরআনের অনুসারী করেছেন। হাসান, দাহহাক, মুজাহিদ, কাতাদা বলেন, এখানে ফদলহচ্ছে ঈমান, আর তার রহমত হচ্ছে, কুরআন। [তাবারী; কুরতুবী] বস্তুতঃ রহমতের মর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে কুরআনের শিক্ষা দান করেছেন এবং এর উপর আমল করার সামর্থ্য দিয়েছেন। কারণ, ইসলামও এ তথ্যেরই শিরোনাম। যখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট ইরাকের খারাজ নিয়ে আসা হলো তখন তিনি তা গুনছিলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। তখন তার এক কর্মচারী বললঃ এগুলো আল্লাহর দান ও রহমত। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ তোমার উদ্দেশ্য সঠিক নয়। আল্লাহর কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে যে, “বল তোমরা আল্লাহর দান ও রহমত পেয়ে খুশী হও যা তোমরা যা জমা করছ তার থেকে উত্তমএ আয়াত দ্বারা দুনিয়ার কোন ধন-সম্পদ বুঝানো হয়নি। কারণ আল্লাহ তা'আলা জমা করা যায় এমন সম্পদ থেকে অন্য বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তা উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদই জমা করা যায়। সুতরাং আয়াত দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। [ইবনে আবী হাতিম] বরং ঈমান, ইসলাম ও কুরআনই এখানে উদ্দেশ্য। আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক দ্বারাও এ অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। সুতরাং এ জাতীয় দ্বীনী কোন সুসংবাদ যদি কারো হাসিল হয় তিনিও এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবযা তার পিতা থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি উবাই ইবনে কা'ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেনঃ আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে এবং আমাকে তা তোমাকে পড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে"। তিনি বললেন, আমি বললামঃ আমার নাম নেয়া হয়েছে? রাসূল বললেনঃ হ্যা। বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি আমার পিতা (উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে বললামঃ হে আবুল মুনযির! আপনি কি তাতে খুশী হয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমাকে খুশী হতে কিসে নিষেধ করল অথচ আল্লাহ তা'আলা বলছেনঃ বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তারই রহমতের উপর তোমরা খুশী হও” [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৩/৩০৪, আবুদাউদঃ ৩৯৮০] [তাফসীর যাকারিয়া. ড. আবু বকর যাকরিয়া]।

ঘ. তাফসীর ফাতহুল মাজীদ :
আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রতি নিজ অনুগ্রহ ও দয়া এবং কুরআনের দিকে ধাবিত হবার প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেন, হে মানুষ সকল! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি উপদেশ বাণী এসেছে। এ উপদেশ বাণী হল কুরআন। সুতরাং কুরআন থেকে উপদেশ ও নসীহত গ্রহণ করে নিজেদের ঈমান ও আমলকে সংশোধন করে নাও। প্রকৃতপক্ষে তারাই এ কুরআন থেকে উপদেশ নিতে পারবে যারা উপদেশ নেয়ার মানসিকতা নিয়ে তা পাঠ করবে এবং বুঝে শুনে পাঠ করবে, আর কুরআন যে দিকনির্দেশনা প্রদান করে তা মেনে চলবে। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করতে হবে তিনি যেন হিদায়াত দান করেন এবং তার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আর এ কুরআন হল অন্তরের রোগের আরোগ্য। অন্তরের রোগ দুধরণের-
  (ক) কুপ্রবৃত্তির রোগ, মন চায় অন্যায় ও খারাপ কাজ করতে।
  (খ) সংশয় ও সন্দেহের রোগ।
কুরআন এ দুপ্রকার রোগেরই চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন: (وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَا۬ءٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ لا وَلَا يَزِيْدُ الظَّالِمِيْنَ إِلَّا خَسَارًا) “আমি কুরআনের এমন আয়াত অবতীর্ণ করি, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু সেটা জালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” (সূরা ইসরা ১৭:৮২)

এরূপ সূরা হা-মীম-সিজদাহর ৪৪ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। তবে কুপ্রবৃত্তি রোগের চিকিৎসা- উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সমাধান হয় কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের চিকিৎসা সবাই পায় না। যাদের অন্তরে তাওহীদ ও রিসালাতের এবং সঠিক ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয়ের রোগ রয়েছে, তাদের অন্তরে যদি আল্লাহ তাআলা সচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার মনোভাব দেখতে পান তাহলেই তাদের অন্তরে এ কুরআন বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং তা পাপকে দূরীভূত করে এবং হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করে দেয়। আর এই কুরআন সকল মানুষের জন্য রহমত কিন্তু যেহেতু মুমিনরা এর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করে তাই এখানে মুমিনদের কথাই বলা হয়েছে।

পক্ষান্তরে মুমিনদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই কুরআন আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত, এ অনুগ্রহ লাভ করে মুমিনদের আনন্দিত হওয়া উচিত। এর অর্থ এই নয় যে, আনন্দ করার জন্য জশনে জুলুস করে, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনরূপ অপচয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করবে। যেমন বর্তমানের বিদআতীরা উক্ত আয়াত দ্বারা নাবীদিবসএই ধরনের অভিনব বিদআতী অনুষ্ঠান বৈধ হবার কথা প্রমাণ করতে চায়। যা আদৌ ঠিক নয়, বরং আনন্দ প্রকাশ করতে হবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে।

0৫. আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যে ব্যক্তি কুরআন ভালভাবে ধারণ করবে তাকে কুরআন উপদেশ দেবে, রোগ থেকে মুক্তি দেবে এবং আলো দান করবে।
২. আল্লাহ তাআলার নেয়ামত পেয়ে মুমিনরা আনন্দিত হবে তবে তা অবশ্যই শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায়।
৩. আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রতি খুবই অনুগ্রহপরায়ণ, তাই তিনি হিদায়াতের জন্য কিতাব দিয়েছেন।
[তাফসীর ফাতহুল মাজীদ]।

1 comment: