Friday, 22 November 2019

সীরাতুর রাসূল (সাঃ)। পর্ব : সাত। রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাত পাঠ করাঃ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সীরাতুর রাসূল (সাঃ)। পর্ব : সাত
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাত পাঠ করাঃ
সংকলনে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী

০১. ভূমিকাঃ
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাত পাঠ করা মুসলিমের জন্য নবী প্রেমিকের বহিঃপ্রকাশ এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত-বরকত ও ক্ষমা পাওয়া এবং সম্মান বৃদ্ধির মাধ্যমও বটে।

০২. আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন :
﴿إِنَّ اللَّهَ وَمَلٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِىِّ ۚ يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
আল্লাহ নাবীর প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর মালাইকারাও নাবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেহে মুমিনগণ! তোমরাও নাবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও [সূরা আহযাব : ৫৬]।

০৩. হাদীস :
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিততিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً وَاحِدَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ
যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার উপর দশবার রহমত নাযিল করবেন, তার দশটি শুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং তাঁর জন্য দশটি মর্যাদা উন্নীত করা হবে[সুনান নাসাঈ ১৩০০ (ই. ফা)]।

 ০৪. ব্যাখ্যা :
৩/১. তাফসীর আহসানুল বায়ান :
এই আয়াতে নবী (সাঃ)-এর ঐ সম্মান ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যা আসমানে উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ফিরিশতাগণের নিকট বিদ্যমানতা এই যে আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাগণের নিকট নবী (সাঃ)-এর সুনাম ও প্রশংসা করেন এবং তাঁর উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশতাগণও নবী (সাঃ) এর উচ্চমর্যাদার জন্য দু'আ করেনতার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা বিশ্ববাসীদেরকেও আদেশ করেছেন, যেন তারাও নবী (সাঃ)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করেযাতে নবী (সাঃ)-এর প্রশংসায় ঊর্ধ্ব ও নিম্ন দুই বিশ্ব একত্রিত হয়ে যায়হাদীসে বর্ণনা হয়েছে যে, সাহাবায়ে কিরামগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সালামের নিয়ম তো আমাদের জানা আছে (অর্থাৎ তাশাহহুদে 'আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবিয়্যু' পড়ি) কিন্তু আমরা দরূদ কিভাবে পড়ব? এর উত্তরে তিনি দরূদে ইবরাহিমী -- যা নামাযে পাঠ করা হয় তা বর্ণনা করলেন [বুখারীঃ তাফসীর সূরা আহ্যাব]।

এ ছাড়া হাদীসে দরূদের আরো অন্য শব্দ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলিও পাঠ করা চলবেসংক্ষেপে (صَلَّى اللهُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ وَسَلَّم) পাঠ করা যাবেপক্ষান্তরে (اَلصَّلَوةُ وَالسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ) পাঠ করা এই জন্য ঠিক নয় যে, এতে নবী (সাঃ)-কে সরাসরি সম্বোধন করা হয় এবং এই শব্দগুচ্ছ সাধারণ দরূদে নবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়নিআর যেহেতু তাশাহহুদে 'اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ اَيُّهَا النَّبِيُّ' শব্দ নবী (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে সেহেতু (তাশাহহুদে তা পাঠ করাতে কোন দোষ নেইতা ছাড়া (اَلصَّلَوةُ وَالسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ) পাঠকারী এই বাতিল বিশ্বাস নিয়ে পাঠ করে যে, নবী (সাঃ) তা সরাসরি শ্রবণ করেনএই বাতিল বিশ্বাস কুরআন ও হাদীসের পরিপন্থীসুতরাং এই আকীদা নিয়েও নিজেদের মনগড়া দরূদ পাঠ করা ঠিক নয়অনুরূপ আযানের পূর্বে তা পাঠ করাও বিদআত, যাতে সওয়াব নয়; বরং গুনাহ হয়হাদীসে দরূদের বড় গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছেনামাযে তা পাঠ করা ওয়াজেব না সুন্নত? অধিকাংশ উলামাগণ বলেছেন সুন্নত এবং ইমাম শাফেয়ী ও আরো অনেকে তা ওয়াজেব বলেছেনতবে একাধিক হাদীসে তার ওয়াজেব হওয়ারই সমর্থন পাওয়া যায়অনুরূপ হাদীস দ্বারা এটাও বোঝা যায় যে, যেমন শেষ তাশাহহুদে দরূদ পড়া ওয়াজেব তেমনই প্রথম তাশাহহুদেও দরূদ পাঠ করা ওয়াজেব

নিম্নে তার কতিপয় দলীল দেওয়া হলঃ-
প্রথম প্রমাণ এই যে, মুসনাদে আহমাদে সহীহ সানাদে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সালামের নিয়ম তো আমাদের জানা আছে (অর্থাৎ তাশাহহুদে 'আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবিয়্যু' পড়ি) কিন্তু আমরা নামাযে দরূদ কিভাবে পড়ব? এর উত্তরে তিনি দরূদে ইবরাহিমী শিক্ষা দিলেন [আল ফাতহুর রাববানী ৪/২০-২১]।

মুসনাদে আহমাদ ছাড়াও উক্ত হাদীস সহীহ ইবনে হিববান, সুনানে কুবরা বায়হাকী, মুস্তাদরাক হাকেম এবং ইবনে খুযায়মাতে বর্ণিত হয়েছেএতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, যেমন তাশাহহুদে সালাম পড়া হয় অনুরূপ উক্ত প্রশ্নও নামাযের ভিতরে দরূদ পাঠ সম্পর্কে ছিল, উত্তরে নবী (সাঃ) দরূদে ইবরাহিমী পড়ার আদেশ দিয়েছিলেনযাতে বোঝা যাচ্ছে যে, সালামের সাথে দরূদও পড়া দরকার এবং তা পড়ার স্থান হল তাশাহহুদআর হাদীসে তা সাধারণভাবে বর্ণনা হয়েছেপ্রথম বা দ্বিতীয় তাশাহহুদের সাথে নির্দিষ্ট করা হয়নিযার ফলে বলা যায় যে, প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় তাশাহহুদেই সালাম ও দরূদ পড়তে হবে

যে বর্ণনাগুলিতে প্রথম তাশাহহুদ দরূদ ছাড়া উল্লেখ হয়েছে সেগুলিকে সূরা আহযাবের আয়াত 'صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا' অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বের ধরা হবেকিন্তু উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ পঞ্চম হিজরীর পর যখন নবী (সাঃ) সাহাবায়ে কিরামগণের প্রশ্নের উত্তরে দরূদের শব্দও বর্ণনা করে দিলেন, তখন নামাযে সালামের সাথে দরূদ পড়াও জরুরী হয়ে গেল, চাহে তা প্রথম তাশাহহুদ হোক বা দ্বিতীয়

আরো একটি প্রমাণ হল, আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, "নবী (সাঃ) কখনো কখনো রাত্রে নয় রাকআত নামায পড়তেন, আট রাকআতে যখন তাশাহহুদে বসতেন, তখন তাতে তাঁর প্রভুর নিকট দু'আ করতেন এবং তাঁর পয়গম্বরের উপর দরূদ পড়তেন তারপর সালাম না ফিরে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং নয় রাকআত পূর্ণ করে পুনরায় তাশাহহুদে বসতেন, তাঁর প্রভুর নিকট দু'আ করতেন এবং তাঁর পয়গম্বরের উপর দরূদ পড়তেন এবং পুনরায় দু'আ করতেন, তারপর সালাম ফিরতেন [বায়হাকী ২/৭০৪, নাসাঈ ১/২০২, বিস্তারিত দেখুনঃ আল্লামা আলবানীর সিফাতু সালাতিন্নাবী ১৪৫ পৃষ্ঠা]।

উক্ত বর্ণনায় পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে, নবী (সাঃ) তাঁর রাত্রের নামাযে প্রথম ও শেষ উভয় তাশাহহুদে দরূদ পড়েছেনএটা যদিও নফল নামাযের কথা ছিল; তবুও নবী (সাঃ)-এর উক্ত আমল দ্বারা উল্লিখিত ব্যাপক দলীলসমূহের সমর্থন হয়যার ফলে তা শুধু নফল নামাযের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়

৪/২. তাফসীর যাকারিয়া :
আরবী ভাষায় সালাত শব্দের অর্থ রহমত, দো'আ প্রশংসাঅধিকাংশ আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে তাঁর নবীর প্রতি যে সালাত সম্পৃক্ত করা হয়েছে এর অর্থ, আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেনতার কাজে বরকত দেনতার নাম বুলন্দ করেনতার প্রতি নিজের রহমতের বারি বর্ষণ করেনফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তার উপর সালাত প্রেরণের অর্থ হচ্ছে, তারা তাকে চরমভাবে ভালোবাসেন এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে দো'আ করেন, আল্লাহ যেন তাকে সর্বাধিক উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তার শরীয়াতকে প্রসার ও বিস্তৃতি দান করেন এবং তাকে সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থানে পৌঁছিয়ে দেনতার উপর রহমত নাযিল করেনআর সাধারণ মুমিনদের তরফ থেকে সালাতের অর্থ দো'আ ও প্রশংসার সমষ্টিএ আয়াতের তাফসীরে আবুল আলিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন: আল্লাহ তা'আলার সালাতের অর্থ আল্লাহ কর্তৃক ফিরিশতাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্মান ও প্রশংসা করা[সহীহ বুখারী, কিতাবুত্তাফসীর]

আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান দুনিয়াতে এই যে, তিনি ফিরিশতাদের কাছে তার কথা আলোচনা করেনতাছাড়া তার নামকে সমুন্নত করেনতিনি পূর্ব থেকেই তার নাম সমুন্নত করেছেনফলে আযান, ইকামত ইত্যাদিতে আল্লাহর নামের সাথে সাথে তার নামও শামিল করে দিয়েছেন, তার দ্বীন পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, প্রবল করেছেন; তার শরীয়তের কাজ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছেন এবং তার শরীয়তের হেফাযতের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেনপক্ষান্তরে আখেরাতে তার সম্মান এই যে, তার স্থান সমগ্র সৃষ্টির উর্ধে রেখেছেন এবং যে সময় কোন নবী ও ফেরেশতার সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে না, তখনও তাকে সুপারিশের ক্ষমতা দিয়েছেন, যাকে মাকামে-মাহমুদবলা হয়মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাসূলের উপর সালাত প্রেরণের ক্ষেত্রে সালাত শব্দ দ্বারা একই সময়ে একাধিক অর্থ (রহমত, দো'আ ও প্রশংসা) নেয়ার পরিবর্তে সালাত শব্দের এক অর্থ নেয়াই সঙ্গত অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান, প্রশংসা ও শুভেচ্ছা[ইবনুল কাইয়্যেম, জালাউল আফহাম]

আয়াতের আসল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করার আদেশ দান করাকিন্তু তা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রথমে আল্লাহ স্বয়ং নিজের ও তাঁর ফেরেশতাগণের দরূদ পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেনঅতঃপর সাধারণ মুমিনগণকে দরূদ প্রেরণ করার আদেশ দিয়েছেন

অধিকাংশ ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উল্লেখ করলে অথবা শুনলে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব হয়ে যায়[কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

কেননা, হাদীসে এরূপ ক্ষেত্রে দরূদ পাঠ করা ওয়াজিব হওয়া বর্ণিত আছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: সেই ব্যক্তি অপমানিত হোক যার সামনে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে সালাত পাঠ করে না[তিরমিয়ী: ৩৫৪৫] অন্য এক হাদীসে আছে- সেই ব্যক্তি কৃপণ, যার কাছে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে দরূদ পাঠ করে না' [তিরমিয়ী: ৩৫৪৬]

নবী সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্যের জন্য সালাতপেশ করা জায়েয কিনা, এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছেএকটি দল, কাযী ঈয়াদের নাম এ দলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, একে সাধারণভাবে জায়েয মনে করেএদের যুক্তি হচ্ছে, কুরআনে আল্লাহ নিজেই অ-নবীদের ওপর একাধিক জায়গায় সালাতের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেনএভাবে নবী সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লামও একাধিকবার অ-নবীদের জন্য সালাত শব্দ সহকারে দো'আ করেনযেমন একজন সাহাবীর জন্য তিনি দো'আ করেন, হে আল্লাহ! আবু আওফার পরিজনদের ওপর সালাত পাঠাওজাবের ইবনে আবদুল্লাহর রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রীর আবেদনের জবাবে বলেন, আল্লাহ তোমার ও তোমার স্বামীর ওপর সালাত পাঠানযারা যাকাত নিয়ে আসতেন তাদের পক্ষে তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! ওদের উপর সালাত পাঠাওসা'দ ইবনে উবাদার পক্ষে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! সা'দ ইবন উবাদার পরিজনদের ওপর তোমার সালাত ও রহমত পাঠাওআবার মুমিনের রূহ সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর দিয়েছেন যে, ফেরেশতারা তার জন্য সালাত পাঠ করেকিন্তু মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের মতে এমনটি করা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য তো সঠিক ছিলকিন্তু আমাদের জন্য সঠিক নয়তারা বলেন, সালাত ও সালামকে মুসলিমরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছেএটি বর্তমানে তাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছেতাই নবীদের ছাড়া অন্যদের জন্য এগুলো ব্যবহার না করা উচিতএ জন্যই উমর ইবনে আবদুল আযীয একবার নিজের একজন শাসনকর্তকে লিখেছিলেন, “আমি শুনেছি কিছু বক্তা এ নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করেছেন যে, তারা আস-সালাতু আলান নাবী'-এর মতো নিজেদের পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারীদের জন্যও সালাতশব্দ ব্যবহার করেছেনআমার এ পত্র পৌঁছে যাবার পরপরই তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং সালাতকে একমাত্র নবীদের জন্য নির্দিষ্ট করে অন্য মুসলিমদের জন্য দো'আ করেই ক্ষান্ত হবার নির্দেশ দাও[রূহুল-মা'আনী]

এ হুকুমটি নাযিল হবার পর বহু সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সালামের পদ্ধতি তো আপনি আমাদের বলে দিয়েছেন। (অর্থাৎ নামাযে "আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান নাবীইয়্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহএবং দেখা সাক্ষাত হলে "আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ" বলা।) কিন্তু আপনার প্রতি সালাত পাঠাবার পদ্ধতিটা কি? [দেখুন,তাবারী,কুরতুবী,তাহরীর ওয়া তানওয়ীর] এর জবাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন সময় যেসব সালাত বা দরূদ শিখিয়েছেন তা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছেযেমন :

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَأَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
[বুখারীঃ ৩৩৬৯, ৬৩৬০, ৯৭৯]

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
[বুখারীঃ ৩৩৭০]


اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ
[বুখারীঃ ৪৭৯৮]

اللّٰهُمَّ صَلِّ عَلٰى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ وَعَلٰى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَآلِ إِبْرَاهِيْمَ وَبَرِكْ عَلٰى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلٰى آلِإِبْرَاهِيْمَ اِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ
[মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১১৯]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি দরূদ পড়ার ফযীলত সংক্রান্ত অনেক হাদীস রয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে ফেরেশতারা তার প্রতি দরূদ পাঠ করে যতক্ষণ সে দরূদ পাঠ করতে থাকে[মুসনাদে আহমাদ:৩/৪৪৫, ইবনে মাজাহ: ৯০৭] আরো বলেছেন, “যে আমার ওপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার ওপর দশবার দরূদ পড়েন” [মুসলিম: ৩৮৪] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার সাথে থাকার সবচেয়ে বেশী হকদার হবে সেই ব্যক্তি যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশী দরূদ পড়বে[তিরমিয়ী: ৪৮৪] আরো বলেছেন, আমার কথা যে ব্যক্তির সামনে আলোচনা করা হয় এবং সে আমার ওপর দরূদ পাঠ করে না সে কৃপণ[তিরমিযী: ৩৫৪৬]।

৪/৩. তাফসীর ফাতহুল মাজীদ :
বলেন: (নাবীর প্রতি) আল্লাহ তাআলার সালাত হলো: ফেরেশতাদের কাছে তাঁর প্রশংসা করাআর ফেরেশতাদের সালাত হলো: নাবীর জন্য দুআ করা। (সহীহ বূখারী, অত্র আয়াতের তাফসীর).এ আয়াতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঐ সম্মান ও মর্যাদার কথা বর্ণনা করা হয়েছে যা আসমানে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের নিকট বিদ্যমানতা এই যে, আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের নিকট নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সম্মান ও প্রশংসা করেন এবং তাঁর ওপর রহমত বর্ষণ করেনআর ফেরেশতাগণও নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মর্যাদার জন্য দুআ করেনতার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা বিশ্ববাসীকে আদেশ করছেন তারাও যেন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করেযাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসায় ঊর্ধ্ব ও নিম্ন উভয় জগৎ একত্রিত হয়ে যায়আবুল আলিয়া (রা.) বলেন: (নাবীর প্রতি) আল্লাহ তাআলার সালাত হলো: ফেরেশতাদের কাছে তাঁর প্রশংসা করাআর ফেরেশতাদের সালাত হলো: নাবীর জন্য দুআ করা[সহীহ বূখারী, অত্র আয়াতের তাফসীর]।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পড়ার জন্য উম্মাতের প্রতি তাঁর নির্দেশ ও পদ্ধতি:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মাতকে দরূদ পড়ার ব্যাপারে অনেক জায়গায় নির্দেশ প্রদান করেছেনএ ব্যাপারে মুতাওতির হাদীস বর্ণিত হয়েছেতার মধ্যে অন্যতম হলো কাব বিন উজরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: বলা হলো হে আল্লাহ তাআলার রাসূল! আপনাকে কিভাবে সালাম দেব তা জানতে পারলামকিন্তু সালাত কিভাবে পড়ব? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দরূদে ইবরাহীমের কথা বললেন[সহীহ বুখারী হা: ৪৭৯৭]।

এছাড়াও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাতে শব্দের একটু ভিন্নতা পাওয়া যায়তবে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার উত্তম শব্দ ও দরূদ হলো দরূদে ইবরাহীমতবে আমাদের সমাজে প্রচলিত কিছু কিছু দরূদ পাওয়া যায় যেমন :
يا نبي سلام عليك يا حبيب سلام عليك
এগুলোর কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা নেইএগুলো একশ্রেণির নামধারী তথাকথিত আলেম নামক ধর্মব্যবসায়ীদের তৈরি করা কথাতাই চার রাকাতবিশিষ্ট সালাতের উভয় বৈঠকে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা ওয়াজিবআবার কেউ সুন্নাত বলেছেন[ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর]।

তাছাড়া আযান শেষে, মসজিদে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার পূর্বে, জানাযার সালাতে, ঈদের সালাতে, আল্লাহ তাআলার কাছে কিছু চেয়ে দুআ করার শেষে ও কবর যিয়ারতের সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব। [ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর]।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার পদ্ধতি:
পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা যায় এবং সে দরূদ আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের মাধ্যমে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পৌঁছে দেনযেমন নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন ; তোমরা আমার কবরকে অনুষ্ঠানের জায়গা বানিয়ে নিও না এবং তোমাদের বাড়ি ঘরকে কবর বানিয়ে নিও না, আর তোমরা আমার প্রতি দরূদ প্রেরণ করতোমরা যেখান থেকেই আমার প্রতি দরূদ পাঠ কর তা আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়[আবূ দাঊদ হা: ২০৪২, সনদ সহীহ]।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: জমিনে আল্লাহ তাআলার কতগুলো ভ্রাম্যমান ফেরেশতা রয়েছে, তারা আমার উম্মাতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়[আহমাদ ১/৪৪১, নাসায়ী হা: ১২৮১, সনদ সহীহ]।

অতএব নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম ও তাঁর প্রতি দরূদ প্রেরণের জন্য পাখি হয়ে মদীনাতে যেতে হবে না এবং কোন হাজী সাহেবকেও বলে দিতে হবে না যে, আমার সালাম নাবীর রওজায় পৌঁছে দেবেনবরং পৃথিবীর যেখান থেকেই দরূদ পাঠ করা হোক না কেন তা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে পৌঁছে যাবে

নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার ফযীলত ও না পাঠ করলে অপরাধ:
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন[সহীহ মুসলিম ১/৩০৬, আবূ দাঊদ হা: ১৫৩০]।

তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন: ঐ ব্যক্তির নাক ধূলোয় ধূসরিত হোক, যে ব্যক্তির নিকট আমার নাম উচ্চারণ করা হলো কিন্তু আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল নারাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
الْبَخِيلُ مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ، ثُمَّ لَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ
সে ব্যক্তি কৃপণ যার কাছে আমার নাম উচ্চারণ করা হলে দরূদ পাঠ করে না[মুসনাদ আহমাদ হা: ১৭৩৬, সহীহ]।

সুতরাং যে কোন আমল সুন্নাতী তরীকায় আদায় করলে তার নেকীর আশা করা যায়, অন্যথায় তার কোন নেকী পাওয়ার আশা করা যায় না বরং পাপের ভাগী হতে হবে

৫. আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
ক. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করার ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল
খ. স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এবং ফেরেশতারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করেন
গ. যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর দরূদ পাঠ করে না সে হল বড় কৃপণ
ঘ. সুন্নাতী দরূদ পাঠ করতে হবে, কোন প্রকার বিদআতী দরূপ পাঠ করা যাবে না

৬. রাসূল (সাঃ)-এর সম্মানে কাসীদা (কবিতা) :
قَصِيْدَةُ فِيْ مَدْحِ رَسُوْلِ اللهِ صَلّٰى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রসংশায় আরবি কবিতা
 مُحَمَّدٌ سَيِّدُ الْكَوْنَيْنِ وَالثَّقَلَيْنِ # وَالْفَرِيْقَيْنِ مِنْ عَرَبٍ وَمِنْ عَجَمِ
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, দু’জাহানের মহান নেতা
আরব-আজম অধিপতি, বিশ্বগুরু জগত জেতা।
هُوَ الْحَبِيْبُ الَّذِيْ تُرْجٰى شَفَاعَتُهُ # لِكُلِّ هَوْلٍ مِّنَ الْأَهْوَالِ مُقْتَحِمِ
প্রিয় সখা খোদ এলাহির, পরকালের কান্ডারী সে
কঠোর কঠিন বিপদকালে, মুক্তি দয়ার ভান্ডারী সে।
بُشْرٰى لَنَا مَعْشَرَ الإِسْلَامِ إِنَّ لَنَا # مِنَ الْعِنَايَةِ رُكْنًا غَيْرَ مُنْهَدَمِ
ভাগ্য দারাজ এ মিল্লাতের, আল্লাহর প্রিয় রাসূল আল-আমীন
করলো কায়েম এমন খুঁটি, ধ্বংস যাহার নেই কোনো দিন। [তথ্যসূত্র : কাসীদা-ই বুরদা]।

০৭. উপসংহারঃ
রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাত পাঠের মাধ্যমে সম্মান বৃদ্ধি, গুণাহ মাফসহ আরো অন্যান্য উপকারিতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সদা-সর্বদা সচেষ্ট হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন, আমীন।

1 comment: