Tuesday, 26 February 2019

শাহাদাহ্, ঈমান ও ইসলাম বিধ্বংস বা বিনষ্টের কারণ সমূহঃ (সংক্ষিপ্তাকারে) نَوَاقِضُ الشَّهَادَة وَالْإِيْمَان وَالْإِسْلَام (مُخْتَصِرًا)


بسم الله الرحمن الرحيم
نَوَاقِضُ الشَّهَادَة وَالْإِيْمَان وَالْإِسْلَام (مُخْتَصِرًا)
শাহাদাহ্, ঈমান ও ইসলাম বিধ্বংস বা বিনষ্টের কারণ সমূহঃ (সংক্ষিপ্তাকারে)
The reasons for the destruction or destruction of Shahadah, Iman & Islam (Shortly)
রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী

نَحْمَدُهُ وَنُصَلِّى عَلَى رَسُوْلِهِ الْكَرِيْمِ – أَمَّا بَعْدُ!



১. অবতরণিকাঃ
যে সকল কথা ও কাজের মাধ্যমে একজন মুসলিম কাফির ও মুরতাদ হয়ে যায় সেগুলোকেই ঈমান ও ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয় বলেআমরা অযূ ও নামায ভঙ্গের কারণ জানি কিন্তু শাহাদাহ্, ঈমান ও ইসলাম বিধ্বংসী বা বিনষ্টকারী এমন কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যার কারণে মুসলিম ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়সেগুলো কি আমরা জানি?

২. ঐতিহাসিক ও প্রসিদ্ধ মতে শাহাদাহ, ঈমান ও ইসলাম বিধ্বংসী বা বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ হলো দশটিযথা:
২/১. اَلشِّرْكُ بِاللهِ বা আল্লাহর সাথে র্শিরক করাঃ
র্শিক বলা হয় : যে সকল অধিকার আল্লাহ্ তায়ালার সাথে খাস, সেগুলোতে অন্য কিছুকে তাঁর সমকক্ষ বানানোআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ﴾ যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে র্শিক করবে আল্লাহ্ তায়ালা তার উপর জান্নাত হারাম করে দিবেন, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। [সূরা মায়িদা : ৭২]

রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন : أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهْوَ خَلَقَكَ আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, অথচ তিনি তোমাকে সুষ্টি করেছেন। [সহীহ বুখারী হা/নং ৪৪৭৭, মুসলিম হা/নং ৮৬, ১৫৬ ও ১৬৫]

২/২. مَنْ جَعَلَ بَيْنَهُ وَ بَيْنَ اللهِ وَسَائِطَ يَدْعُوْهُمْ وَيَسْأَلُهُمْ الشَّفَاعَةَ وَيَتَوَكَّلُ عَلَيْهِمْ বা আল্লাহ্ তায়ালা ও বান্দার মাঝে অন্য কাউকে মাধ্যম বানানোঃ
যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলা ও বান্দার মাঝে কাউকে মাধ্যম নির্ধারণ করে, তাদের কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করে এবং তাদের উপর ভরসা করে, সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেমহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন :  ﴿وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى﴾ যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবক রূপে গ্রহন করে তারা বলে, আমরা তাদের ঈবাদত করি এ জন্যই যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দিবে। [সূরা যুমার : ৩]

২/৩. مَنْ لَمْ يُكَفِّرُ الْمُشْرِكِيْنَ أَوْ شَكَّ فِىْ كُفْرِهِمْ أَوْ صَحَّ مَذْهَبُهُمْ অর্থাৎ মুশরিকদের কাফির না বলা অথবা তাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ করা, কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক মনে করাঃ
এটা কুফরিআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ﴾ হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মুশরিকরা অপবিত্র’ [সূরা তাওবাহ্ : ২৭]

২/৪. مَنْ إِعْتَقَدَ أَنَّ غَيْرَ هُدَى النَّبِّىْ أَكْمَلُ مِنْ هَدْيِهِ أَوْ أَنَّ حُكْمَ غَيْرَهُ أَحْسَنُ مِنْ حُكْمِهِ অর্থাৎ রাসূল (সা:) কর্তৃক আনীত আদর্শের চেয়ে অন্যের আদর্শকে পূর্ণাঙ্গ ও রাসূলের (সা:) নির্দেশনাবলীর চেয়ে অন্যের নির্দেশনাবলীকে ভালো মনে করাঃ
মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলামতোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পরিপূর্ণ করলাম, আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম। [সূরা মায়িদাহ্ : ৩]

২/৫. مَنْ أَبْغَضَ شَيْئًا مِمَّا جَاءَ بِهِ الرَّسُوْلُ وَلَوْ عَمِلَ بِهِ অর্থাৎ রাসূল (সা:) কর্তৃক আনীত কোন বিষয় অপছন্দ করা, যদিও সে তদানুযায়ী আমল করেঃ
মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন :
 ﴿وَالَّذِينَ كَفَرُوا فَتَعْسًا لَهُمْ وَأَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ ۞ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ﴾
যারা কুফরি করেছে তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেনএটা এজন্য যে, আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা অপছন্দ করেসুতরাং আল্লাহ্ তাদের কর্ম নিষ্ফল করে দিবেন। [সূরা মুহাম্মাদ : ৮-৯]

২/৬. مَنْ إِسْتَهْزَأَ بِشَىْءٍ مِّنْ دِيْنِ الرَّسُوْلِ أَوْ ثَوَابِهِ أَوْ عِقَابِهِ অর্থাৎ রাসূলের (সা:) কর্তৃক আনীত দ্বীনের কোন বিষয় বা ঘোষিত সাওয়াব বা শস্তি সম্পর্কে ঠাট্রা বিদ্রুপ করাঃ
মহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿قل أبالله وآياته ورسوله كنتم تستهزئون﴾ আপনি বলুন, তবে কি তোমরা আল্লাহ্, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্রা করেছিলে? [সূরা তাওবা : ৬৫]

২/৭. اَلسِّحْرُ যাদুঃ
اَلسِّحْرُ বা যাদুর আভিধানিক অর্থ : গোপনীয় বা সুক্ষ্মপারিভাষিক অর্থ : ফুঁক বা গিরা দেয়ার শাধ্যমে শয়তানের সাহায্যে যাদুকৃত ব্যক্তির ক্ষতি করামহান আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ﴾ বরং শয়তানরাই কুফরী করেছেতারা মানুষদের যাদু শিক্ষা দিয়েছে। [সূরা বাক্বারা : ১০২]

২/৮. مُظَاهِرَةُ الْمُشْرِكِيْنَ وَمُعَاوَنَتُهُمْ عَلَى الْمُسْلِمِيْنَ অর্থাৎ মুসলিমদের বিপক্ষে বা মুসলিমদের উপর মুশরিকদের সাহায্য-সহযোগিতা করাঃ
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾  আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবেনিশ্চয়ই সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবেঅবশ্যই আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়েত দেন না। [সূরা মায়িদা : ৫১]

২/৯. مَنْ إِعْتَقَدَ أَنَّ بَعْضَ النَّاسِ يَسَعَهُ الْخُرُوْجُ عَنْ شَرِيْعَةِ مُحَمَّدٍ অর্থাৎ কোন ব্যক্তিকে মুহাম্মাদ (সা:)-এর শরীয়তের ঊর্ধ্বে মনে করাঃ
এমন ধারণা পেষণকারী কাফিরআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾ আর যে, লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [সূরা আল-ইমরান : ৮৫]

রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন : وَلَوْ كَانَ مُوْسَى حَيًّا وَاتَّبَعْتُمُوْهُ وَتَرَكْتُمُوْنِىْ لَضَلَلْتُمْযদি মুসা (আ:) জীবিত থাকতেন, আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তার অনুসরণ করতে, তাহলে অবশ্যই তোমরা গোমরাহ্ হয়ে যেতে। [নাসাঈ]

রাসূলুল্লাহ (সা:) অন্যত্র ইরশাদ করেছেন : وَلَوْ كَانَ مُوْسَى حَيًّا مَا وَسَعَهُ إِلَّا إِتِّبَاعِىْযদি মুসা (আ:) জীবিত থাকতেন, তাহলে আমার অনুসরণ ছাড়া তার অন্য কোন পথ থাকত না। [নাসাঈ, মিশকাত হা/নং ১৩৬]

২/১০. اَلْإِعْرَاضُ عَنْ دِيْنِ اللهِ অর্থাৎ আল্লাহ্র দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা বা হওয়াঃ
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : ﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآَيَاتِ رَبِّهِ ثُمَّ أَعْرَضَ عَنْهَا إِنَّا مِنَ الْمُجْرِمِينَ مُنْتَقِمُونَ﴾ যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী দ্বারা উপদেশপ্রাপ্ত হওয়ার পর তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে? আমি অবশ্যই অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে থাকি। [সূরা আস-সাজ্দা : ২২]

৩. উপসংহারঃ
উপরোক্ত কোন একটি বিষয় কারো মাঝে পাওয়া গেলে সে ইসলাম থেকে খারেজ (বের) হয়ে যাবেতাই আমাদেরকে উক্ত বিষয়গুলি থেকে বেঁচে থাকতে হবেআল্লাহ্ সকলকে তাওফিক দান করুন

Sunday, 24 February 2019

شروط لا إله إلا الله Condition’s of the La-Ila-ha Illallah লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্-এর শর্তসমূহঃ

شروط لا إله إلا الله
Condition’s of the La-Ila-ha Illallah

লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্-এর শর্তসমূহঃ

রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী

لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ  (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) -এর অর্থ, রুকন ও শর্তসমূহঃ
তাওহীদের মূলভিত্তি হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ করাঅতঃপর মুখে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ -এর স্বীকৃতি দেয়া, অন্তরে তা বিশ্বাস করা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তা বাস্তবায়ন ও একমাত্র তাঁরই ঈবাদত করা

০১.  لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ  (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) -এর অর্থ হলো : আল্লাহ্ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেইঅর্থাৎ: আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকলের ঈবাদতের যোগ্যতাকে অস্বীকার করা এবং যাবতীয় ঈবাদতকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা

০২.  لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ  (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) -এর রুকন হলো : দুইটিযথা :
  (ক) نفى বা নেতিবাচকযেমন, لا إله কোন মাবুদ নেই
  (খ) إثبات বা ইতিবাচকযেমন, إلا الله আল্লাহ্ ব্যতীত

০৩. لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ  (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) -এর শর্তসমূহঃ
ঐতিহাসিক মতে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ  (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্) -এর ৭টি। কেহ কেহ ৮টি বলেছেন।
وقد جمع بعض أهل العلم هذه الشروط (المشهور) السبعة فى بيت واحد فقال :
কতিপয় বিদ্যানগণ প্রসিদ্ধ ৭টি শর্তকে একটি কবিতায় একত্রিত করেছেন। যথা :
عِلْمٌ يَقِيْنٌ وَإِخْلَاصٌ وَصِدْقُكَ مَعَ # مَحَبَّةٍ وَإِنْقِيَادٍ وَالْقُبُوْلُ لَهَا
বিদ্যা, বিশ্বাস এবং একনিষ্ঠতা আর বিশ্বস্ততা
ভালবাসা, আনুগত্য করা এবং গ্রহন করা।

কোন ব্যক্তি لا إله إلا الله -এর স্বীকৃতি দিলেই তাকে মুসলিম বলা যাবে নাবরং কয়েকটি শর্তসহ এ স্বীকৃতি পাওয়া গেলেই সে একজন খাঁটি মুসলিম হিসেবে গণ্য হবেلا إله إلا الله -এর শর্ত হলো ৮টিযথা :
 
১. اَلْعِلْمُ বা জ্ঞান অর্থাৎ لا إله إلا الله -এর অর্থ ও রুকন সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করাআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿فاعلم أنه لا إله إلا الله﴾  অর্থাৎ : জেনে রাখ, আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ্ নেই। [সূরা মুহাম্মাদ : ১৯]

উছমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন : مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ  যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই জেনে মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [সহীহ্ মুসলিম হাদীছ ৪৩]

২. اَلْيَقِيْنُ বা দৃঢ় বিশ্বাস অর্থাৎ لا إله إلا الله -এর জ্ঞান অর্জনের পর তা মনেপ্রাণে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করাআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ﴾  অর্থাৎ : মুমিন তারাই যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সাঃ) উপর ঈমান আনে, অতঃপর কোনরূপ সন্দেহ করে না, আর তাদের মাল দিয়ে ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে; তারাই সত্যবাদী। [সূরা হুজরাত : ১৫]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন : أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ لاَ يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ্ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূলযে বান্দাই সন্দেহমুক্ত অবস্থায় এ দুটি (সাক্ষ্য) নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। [সহীহ্ মুসলিম হাদীছ ৪৪]

৩. اَلْاِنْقِيَادُ বা আনুগত্য করা অর্থাৎ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ -এর উপর বিশ্বাস স্থাপনের পর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া সমস্ত আদেশ ও নিষেধের প্রতি আন্তরিক ও বাহ্যিকভাবে আনুগত্য প্রকাশ করাআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿ وَمَنْ يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى﴾  অর্থাৎ : যে কেউ আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করে আর সে সৎকর্মশীল, সে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক শক্ত হাতল’ [সূরা লুক্বমান : ২২]

নাবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন : لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত বিষয়ের অনুগত হবে। [মিশকাতুল মাসাবীহ্, ইমাম নাবাবীর চল্লিশ হাদীছ, আল-বানী -কিতাবুল ঈমান]

৪. اَلْقُبُوْلُ বা গ্রহন করা অর্থাৎ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ -এর সমস্ত দাবী মনেপ্রাণে গ্রহন করা ও তা প্রত্যাখ্যান না করাআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ (35) وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آَلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَجْنُونٍ﴾ অর্থাৎ : তাদেরকে যখন বলা হত, আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকারের কোন ইলাহ্ নেই, তখন তারা অহঙ্কার করত আর বলত : আমরা কি এক পাগলা কবির কথা মেনে আমাদের ইলাহগুলোকে ত্যাগ করব?’ [সূরা আস-সফ্ফাত : ৩৫-৩৬]

৫. اَلْاِخْلَاصُ বা নিষ্ঠা অর্থাৎ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ বলার পর সকল ঈবাদাত নিষ্ঠার সাথে পালন করারিয়া বা লৌকিকতার জন্য নয়আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ অর্থাৎ : তাদেরকে নির্ভেজালচিত্তে শুধু আল্লাহর ঈবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে’ [সূরা বাইয়্যিনাহ্ : ০৫]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন : أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ আমার সুপারিশ লাভে সবচেয়ে ধন্য ব্যক্তি হচ্ছে সে, যে একনিষ্ঠচিত্তে বলে আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার আর কোন ইলাহ্ নেই। [সহীহ্ বুখারী হা/ নং ৯৯]।

৬. اَلصِّدْقُ বা সত্য ও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করা অর্থাৎ শুধু মুখে স্বীকার করলেই চলবে নাবরং তা সত্য হিসাবে মেনে নিতে হবেআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَঅর্থাৎ : তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; অতঃপর আল্লাহ্ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী’ [সূরা আনকাবূত : ০৩]

মুয়াজ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন : مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ الله، صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ، إِلَّا حَرَّمَهُ الله عَلىَ النَّارِ যে ব্যক্তি মনের বিশ্বাস নিয়ে এ সাক্ষী দিবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্যিকার ইলাহ্ নেই, আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন। [সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম]

৭. اَلْمَحَبَّةُ বা মুহাব্বাত (ভালবাসা) করা অর্থাৎ এ কালিমায় বিশ্বাসীকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য মুহাব্বাত করা, অপর দিকে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যই কাউকে অপছন্দ করাআল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন : ﴿ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ অর্থাৎ : আর মানবমন্ডলীর মধ্যে এরূপ আছে- যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে সদৃশ স্থির করে, আল্লাহ্কে ভালবাসার ন্যায় তারা তাদেরকে ভালবেসে থাকে এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে- আল্লাহর প্রতি তাদের প্রেম দৃঢ়তর’ [সূরা বাক্বারা : ১৬৫]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন : ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ مَنْ كَانَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إِلاَّ لِلَّهِ وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ بَعْدَ أَنْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ مِنْهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ যার মধ্যে তিনটি গুণ আছে সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছেআল্লাহ্ এবং তদ্বীয় রাসূল তার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় হবেসে মানুষকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ভালবাসবে এবং আল্লাহ কর্তৃক কুফরী থেকে রক্ষা পাওয়ার পর সে তাতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে ঘৃণা করে যেমন- আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে ঘৃণা করে। [সহীহ্ বুখারী ও মুসলিম]

৮. اَلْكُفْرُ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُوْنِ اللهِ বা গাইরুল্লাহ্কে অস্বীকার করা অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য যে সকল জিনিসের ঈবাদত করা হয় তা অস্বীকার করা

উপরোক্ত শর্তসমূহ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ -এর আন্তরিক বিশ্বাস ও স্বীকৃতির মাধ্যমে আমরা সত্যিকার মুমিন হতে পারব, নতুবা নয়আল্লাহ্ আমাদের তাওফিক দান করুন

মনোমুগ্ধকর সুন্দর কুরআন তিলাওয়াত ; মা’রুফুর রহমান বিন আব্দুস সালাম।

মনোমুগ্ধকর সুন্দর কুরআন তিলাওয়াত ; মাহফুজুর রহমান বিন আব্দুস সালাম

Wednesday, 20 February 2019

ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ; মাতৃভাষা (বাংলা ভাষা)-এর পরিচিতি, ইতিহাস ও ক্রমবিকাশঃ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ
মাতৃভাষা (বাংলা ভাষা)-এর পরিচিতি, ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস সালাম

০১. মাতৃভাষা বা বাংলা ভাষার পরিচিতিঃ
বাংলদেশের প্রধান ও রাষ্ট্রভাষাযদিও বাংলাদেশে আরো ২৮টি ভাষা প্রচলিত আছে, তারপরও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেপ্রায় ৯৮ ভাগ বাংলাদেশি বাংলা ভাষা তাদের প্রধান ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বসবাস করে এমন বাংলাদেশি আদিবাসীগণ তাদের নিজ নিজ ভাষা (যেমন চাকমা, মারমা ইত্যাদি) ভাষায় কথা বলে

একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষামাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের দ্বিতীয়, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ট বৃহত্তম ভাষাবাংলা সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা ও একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষাবঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলাএছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যা রাজ্যগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী জনগণ রয়েছেভারতে হিন্দির পরেই সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বাংলা সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে ২৬ কোটির অধিক লোক দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ব্যবহার করে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত  স্তোত্র বাংলাতে রচিত

বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১২০০ বছরের অধিক পুরনো চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শনঅষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করেবাংলা ভাষার লিপি হল বাংলা লিপি বাংলাদেশ  পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষার মধ্যে শব্দগত ও উচ্চারণগত সামান্য পার্থক্য রয়েছে বাংলার নবজাগরণে  বাংলার সাংস্কৃতিক বিবিধতাকে এক সূত্রে গ্রন্থনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাংলাদেশ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে

১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলায় সংগঠিত বাংলা ভাষা আন্দোলন এই ভাষার সাথে বাঙালি অস্তিত্বের যোগসূত্র স্থাপন করেছিল১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবীতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেনতাঁদের সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে

০২. বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ক্রমবিকাশঃ
খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কালে মাগধী প্রাকৃত  পালির মতো পূর্ব মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ থেকে বাংলা ও অন্যান্য পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষাগুলির উদ্ভব ঘটে এই অঞ্চলে কথ্য ভাষা প্রথম সহস্রাব্দে মাগধী প্রাকৃত বা অর্ধমাগধী ভাষায় বিবর্তিত হয় খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর শুরুতে উত্তর ভারতের অন্যান্য প্রাকৃত ভাষার মতোই মাগধী প্রাকৃত থেকে অপভ্রংশ ভাষাগুলির উদ্ভব ঘটে  পূর্বী অপভ্রংশ বা অবহট্‌ঠনামক পূর্ব উপমহাদেশের স্থানীয় অপভ্রংশ ভাষাগুলি ধীরে ধীরে আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় বিবর্তিত হয়, যা মূলতঃ ওড়িয়া ভাষা, বাংলা-অসমীয়া  বিহারী ভাষাসমূহের জন্ম দেয়কোনো কোনো ভাষাবিদ ৫০০ খ্রিস্টাব্দে এই তিন ভাষার জন্ম বলে মনে করলেও  এই ভাষাটি তখন পর্যন্ত কোনো সুস্থির রূপ ধারণ করেনি; সে সময় এর বিভিন্ন লিখিত ও ঔপভাষিক রূপ পাশাপাশি বিদ্যমান ছিলযেমন, ধারণা করা হয়, আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশ থেকে অবহট্‌ঠের উদ্ভব ঘটে, যা প্রাক-বাংলা ভাষাগুলির সঙ্গে কিছু সময় ধরে সহাবস্থান করছিল

চৈতন্য মহাপ্রভুর যুগে ও বাংলার নবজাগরণের সময় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃত ভাষা দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিল সংস্কৃত থেকে যে সমস্ত শব্দ বাংলা ভাষায় যোগ করা হয়, তাঁদের উচ্চারণ অন্যান্য বাংলা রীতি মেনে পরিবর্তিত হলেও সংস্কৃত বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়বাংলা ভাষার ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন বাংলার মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ফার্সির পাশাপাশি বাংলাও বাংলার সালতানাতের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিলো এবং ব্যাপক হারে ব্যবহার হতোএছাড়াও প্রোটো বাংলা ছিলো পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে নদিয়া অঞ্চলে প্রচলিত পশ্চিম-মধ্য বাংলা কথ্য ভাষার ওপর ভিত্তি করে আধুনিক বাংলা সাহিত্য গড়ে ওঠেবিভিন্ন আঞ্চলিক কথ্য বাংলা ভাষা ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষার মধে অনেকখানি পার্থক্য রয়েছে[১৭] আধুনিক বাংলা শব্দভাণ্ডারে মাগধী প্রাকৃত, পালি, সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি ভাষা এবং অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাসমূহ সহ অন্যান্য ভাষা পরিবারের শব্দ স্থান পেয়েছে

১৯৫১৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগণের প্রবল ভাষা সচেতনতার ফলস্বরূপ বাংলা ভাষা আন্দোলন নামক একটি ভাষা আন্দোলন গড়ে ওঠেএই আন্দোলনে পাকিস্তান সরকারের নিকট বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতি দাবি করা হয়১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে বহু ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন বাংলাদেশে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস পালিত হয়১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদান করে

বাংলাদেশ ছাড়াও ১৯৫০-এর দশকে ভারতের বিহার রাজ্যের মানভূম জেলায় বাংলা ভাষা আন্দোলন ঘটে১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারতের অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় একইরকম ভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন সংঘ ভাষা বঙ্গ অঞ্চলের বাঙালি অধিবাসীর মাতৃভাষাস্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ  ত্রিপুরা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিতএছাড়া ভারতের অসম রাজ্যের দক্ষিণাংশেও এই ভাষা বহুল প্রচলিত ভারতেরআন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন

০৪. ইসলামের আলোকে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ

আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগনিত দান আর নিয়ামতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন-সংসারসকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত, জীবনের শুরু থেকে বিদায় পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ মহানের দান-নিয়ামতের মুখাপেক্ষি আমরামহান আল্লাহর নিয়ামতভোগী মাখলুক আমরা মানুষভাষা আল্লাহ তায়ালার অনন্য একটি দানঅন্যন্য একটি নিয়ামতমানব জাতিকে প্রদান করা বিশেষ নিয়ামতভাষা জীবনের এমন একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়; যা ছাড়া সুস্থ ও সম্পূর্ণ জীবন কল্পনা করা যায় নাভাষার ব্যবহার, ভাষা শিক্ষা ও মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চা করাকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলামপবিত্র কোরানের সুরা আর-রহমানের প্রথমদিকে আল্লাহ তায়ালা বলেছে, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছি বয়ান বা উপস্থাপনজ্ঞানআলোচ্য আয়াতের মাঝে মানুষকে উপস্থাপনজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করার কথা বলার মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছেআল্লাহ তায়ালা মানবকূলকে যত নিয়ামত দিয়েছেন তার মধ্যে ভাষা অন্যতমমানুষ ভাষার মাধ্যমে অন্যের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারেমনের মণিকোঠায় লুকানো সুখানুভূতি দু:খানুভূতি নিমিষেই প্রকাশ করতে পারে অন্যের কাছেআল্লাহ তায়ালা মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন, যা অন্য কোন প্রানীকে দেননিপশু-প্রানীরা কখনো তাদের মনের বেদনা কারে কাছে বলতে পারেনা; আনন্দ উল্লাস অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে পারে নাকিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ তাঁদের সব অনুভুতি অন্যের সাথে আদান প্রদান করতে পারেএ এক অপূর্ব নিয়ামতআল্লাহ তায়ালার অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শন আমাদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেএইসব নিদর্শনগুলোর মধ্য থেকে কথা বলা বা ভাষার নিদর্শনটিই আমরা অনুভব করি এবং ব্যবহার করি

আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় কোটি কোটি মানুষ তৈরী করেছেনতিনি নিপূণতার সাথে প্রত্যেকটি মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে তৈরী করেছেনতাদের মধ্যে দিয়েছেন রংয়ের ভিন্নতা; ভাষার ভিন্নতা; দিয়েছেন রুচীর বৈচিত্র্যকোটি কোটি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন ধরণ, রূপ-সৌন্দর্য্যে ও ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তায়ালার অপরূপ মহিমা ও কুদরতকে সাক্ষ্য দেয়প্রমাণ করে আল্লাহ কতো সুনিপূণ কারিগরআল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতিকে আলাদা আলাদা ভাষা দিয়েছেনসব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি; আল্লাহর দানসব ভাষাই আল্লাহর কাছে সমানআল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) -কে সৃষ্টির পর তাঁকে সব ধরণের ভাষা জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন 

০৫. ইসলামের আলোকে ভাষার মর্যাদা : 
আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিকুলকেতার কোনো নিয়ামতই গুরুত্বের দিক থেকে কম নয়তবে কিছু কিছু নিয়ামত প্রয়োজন ও অপরিহার্যতার বিচারে একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণমানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য স্রষ্টা তাদের যে ভাষার নিয়ামত দান করেছেন সেটাও এর অন্তর্ভূক্তমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ যে শব্দ বের করি সেটাই ভাষাভাষাকে আল্লাহ তাআলা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন

পবিত্র কোরানে আল্লাহ তায়ালা বলেন : وَمِنْ آَيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হল- আসমান জমিন সৃষ্টি, তোমাদের বিভিন্ন রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা। [সূরা রূম : ২২]

ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচলবাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিষহ তা বোঝানো মুশকিলমানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তাআলা আশরাফুল মাখলুকাত তথা মানুষকে দান করেছেন ভাষার নিয়ামতসব প্রাণীরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছেকিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বাচ্ছন্দ্য, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণীর নেইএখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, সেরা জীব হওয়ার মহাত্ম্যপ্রথম মানুষ হযরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করার পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন

পবিত্র কোরানে ইরশাদ হয়েছে : وَعَلَّمَ آَدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন। [সূরা বাকারা : ৩১]

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে  : خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَانَ মানব জাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বর্ণনা করার জ্ঞান দিয়েছেন। [সূরা আর রহমান : ৩-৪]

মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেনযুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবি-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেনযখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবিদের মাতৃভাষায় করেছেন

মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন : وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ আমি সব রাসূলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তারা আমার বাণী স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে। [সূরা ইবরাহিম: ৪]

প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মানের সাথে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলাআমাদেরও উচিত হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রিয় ভাষা বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মহীয়ান করে তোলার জন্য আকুল প্রয়াস চালানোতবেই মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ পালিত হবে; স্রষ্টার নিয়ামতের যথার্থ কদর করায় আমরা বিশেষভাবে মূল্যায়িত হব 

০৬. বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব : 
ইসলামের সুমহান আদর্শকে বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌছে দিতে বাঙ্গালী মুসলমানের বাংলা ভাষায় বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেইআমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন আরবের অধিবাসী তাই কোরান অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়পবিত্র কোরানের বাণীসমূহ ও রাসূলের হাদিসকে তাই বাংলা ভাষায় মানুষের কাছে পৌছে দিতে হবে এবং এটাই সময়ের অনিবার্য দাবীকারণ আমাদের ভাষা আরবি নয়কোরান বোঝার স্বার্থে মুসলমানদের আরবি ভাষা জানা আবশ্যক হলেও আরবিভাষী না হওয়ার কারণে সকলের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়তাই কোরান, হাদিস ও ইসলামি ফিকহ, তাফসির, বিধি-বিধান ও ইসলামি সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় এদেশের মুসলমানদের হাতে পৌছে দিতে হবেবাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মপ্রাণ; কিন্তুশুধুমাত্র বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের সঠিক চেতনা তাঁদের কাছে পৌছে দেয়ার অভাবে তাঁদের অনেকেই ইসলামের সঠিক জ্ঞান রাখেন নাএকসময় ফার্সি ভাষাকে অমুসলিমদের ভাষা মনে করা হতরুমি, জামি, শেখ শাদিরা সে ভাষায় অসংখ্য কবিতা, সাহিত্য রচনা করে ফার্সি ভাষাকে জয় করে ফেলেনএতে ইসলামের বিশাল উপকার হয়আল্লামা ইকবাল উর্দু ভাষায় যে সাহিত্য রচনা করেছেন তা ইসলামি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেবাংলা ভাষায়ও আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই তাদের কবিতা ও সাহিত্যে ইসলামকে তুলে ধরেছেনকিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্যবর্তমানে আলেম-ওলামাদের অনেকেই লেখালেখি করেন; কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপরইসলামের সব বিষয়, সব দিক ও অধ্যায় নিয়ে রচিত বইয়ের বাংলা অনুবাদ হলে, বাংলা ভাষী মুসলমানরা নিমিষেই ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলেঅচনা বুঝতে পারবে এবং আমল করতে পারবেবাংলা ভাষায় ইসলামের এস গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে কোনো বই বা রচনা না থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করতে পারে নাবাংলঅ ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে মনোনিবশে করা এখন যুগের একান্ত চাহিদাপ্রত্যেকজন নবি তার সময়ের ভাষায় ধর্ম প্রচার করেছেআমাদের দেশে আমাদের এই সময় যদি কোনো নবির আগমন ঘটতো, অকশ্যই তিনি হতে বাংলা ভাষীবাংলা হতো তাঁর ভাষাযেহেতু নবি বা রাসুল আর আসবেন না, তাই নবি-রাসুলদের যারা উত্তরসূরি রয়েছেন তাদের উচিত বাংলণা ভাষায় ইসলাম প্রচারের কাজে এগিয়ে আসা 

০৭. ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মর্যাদা : 
ইসলামে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছেশহীদ দুই প্রকারএক. ইসলামের জন্য আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন যারা অথবা যাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছেদুই. কোনো মহামারীতে, পানিতে ডুবে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে অথবা কোনো ভবন বা স্থাপনা ধসে তার নিচে চাপা পড়ে যদি কোনো মুসলমান প্রাণ হারায়; ইসলামের দৃষ্টিতে শহীদ বলে বিবেচিত হবেন তারাএমনিভাবে সন্তান প্রসবের সময় কোনো স্ত্রীলোক যদি মৃত্যুবরণ করেন সেও শহীদ বলে গণ্য হবেনবাংলাদেশের মুসলমানগণ ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরলছালাম, জব্বার, রফিক, বরকতেরা মাতৃভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আমাদেরকে ধন্য করেছেনঅন্যের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তারাইসলামের আলোচনা অনুযায়ী ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা শহীদ¤পদের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ দেশে দেশে লড়াই করে কিন্তু মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশীরাই তৈরী করেছেশহীদের মর্যাদা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে ভিন্ন আলোচনা এসেছেএক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘ঋণ ব্যতীত শহীদের সব গুণাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়কেননা শাহাদাত তথা অন্যান্য নেক আমল দ্বারা কেবল আল্লাহর হক মাফ হয়কিন্তু ঋণ তথা বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত হকদার ব্যক্তি ক্ষমা না করেনজামে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘শহীদকে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই ক্ষমা করে দেনএরপর জান্নাতে তার আবাসস্থল দেখানো হয়, কবরের ভয়াবহ আজাব থেকে হেফাজত রাখবেনকিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদে থাকবেএবং তার মাথায় বিশেষ মুকুট পরিধান করানো হবেমহান আল্লাহ তায়ালা শহীদদের ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তাদের (শহীদদের) মৃত বলো নাতারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে রিজিকপ্রাপ্ত হয়সুতরাং ভাষা শহীদ কিংবা যে কোনো ধরনের শহীদ হোক না কেন, আল্লাহ মহানের কাছে রয়েছে তার জন্য আলাদা মর্যাদা এবং ইসলাম তাকে প্রদান করেছে বিশেষ গুরুত্বএকজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের জন্য আল্লাহ মহানের কাছে দোয়া-প্রার্থনা করাআল্লাহ আমাদের সবাইকে ভাষা শহীদদের প্রকৃত মর্যাদা প্রদান করার তাওফিক দান করুনআমিন

০৮. ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বঃ

মানুষের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধ্বনিকে ভাষা বলেভাষার উদ্ভব ও উৎস সন্ধানে ভাষাতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানী করেছে বটে; কিন্তু ভাষার আবির্ভাব তত্ত্বের কোনো সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করা যায়নি
 মানুষের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধ্বনিকে ভাষা বলেভাষার উদ্ভব ও উৎস সন্ধানে ভাষাতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানী করেছে বটে; কিন্তু ভাষার আবির্ভাব তত্ত্বের কোনো সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করা যায়নিনানা ধরনের থিওরি বা তত্ত্ব আবিষ্কারের মোদ্দা কথা হচ্ছে ভাষা আল্লাহ প্রদত্ত এর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালাপৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা রয়েছেমহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেনতারা পৃথিবীতে এসেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যযুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা যে অঞ্চলে নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন সেই নবি বা রাসুলকে সে অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন

আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ [সা.]-এর মাতৃভাষা ছিল আরবিতার কাছে আসা আসমানি কিতাব পবিত্র কোরানের ভাষা আরবিপ্রিয় নবি সা.-এর মাতৃভাষা আরবিতে কোরান নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ  আমি আপনার ভাষায় কোরানকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ রাখে। [সুরা আদদুখান, আয়াত ৫৮]

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্যঅপরিসীম গুরুত্বের সঙ্গে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলামমাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থনপবিত্র কোরান থেকেই আমরা জানতে পারি যে, ইসলামী আদর্শ যেমন সর্বজনীন ইসলামের ভাষাও তেমনি সর্বজনীনএ কারণেই দেখা যায়, নবিজির [সা.] ইন্তেকালের পর ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গেছেন, সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী তাদের কাছে তুলে ধরেছেনমুসলমানরাই বাংলা ভাষাকে স্বমহিমতায় সমুন্নত করেছেবস্তুত মুসলিম মননে মাতৃভাষাপ্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে ইসলামের মাতৃভাষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের কারণেসুতরাং মাতৃভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা অপরিহার্য বিষয়পবিত্র কোরান ও হাদিসে নবি তথা ইসলামের আলোকে ধর্মপ্রাণ মানুষের সৎ মনোভাব প্রকাশের দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা, অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধনে ভাষা শহিদদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করাই উচিত

০৯. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিব রাসূলে কারিম সাঃ-কে উদ্দেশ করে এরশাদ করেনঃ
  ক. فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لِتُبَشِّرَ بِهِ الْمُتَّقِينَ وَتُنْذِرَ بِهِ قَوْمًا لُدًّا আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি মুত্তাকিদের সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন’ [সূরা মরিয়ম : ৯৭]। 

  খ. وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا এমনিভাবে আমি আরবি ভাষায় কুরআন নাজিল করেছি এবং এতে নানাভাবে সতর্ক বাণী ব্যক্ত করেছি, যাতে তারা আল্লাহভীরু হয় অথবা তাদের অন্তরে চিন্তার খোরাক জোগায়’ [সূরা ত্বহা : ১১৩]। 

  গ.
قُرْآَنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ আরবি ভাষায় এই কুরআন যাতে কোনো বত্র্নতা নেইযাতে তারা সাবধান হয়ে চলে’ [সূরা আয-যুমার : ২৮]।

  ঘ. পবিত্র কুরআন মজিদ হতেই আমরা জানতে পারি যে, ইসলামি আদর্শ যেমন সার্ব জনীন ইসলামের ভাষাও তেমনি সার্ব জনীন, এভাবে ভাষা, ও আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ইসলাম শাশ্বত সত্য ধর্ম প্রচারে মাতৃভাষা চর্চার জোরালো তাগিদ দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন : ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَআপনি মানুষকে আপনার রবের পথে বিজ্ঞানসম্মত ও উত্তম ভাষণ দ্বারা আহ্বান করুন এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা করুন’ [সূরা আন-নাহল : ১২৫]।

  . إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ আমি একে আরবি ভাষায় কুরআন রূপে নাজিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো’ [সূরা ইউসুফ : আয়াত ০২]।

আর এ কারণেই দেখা যায়, পরবতী সময়ে ইসলাম প্রচারকগণ পৃথিবীর যে অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গেছেন, সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী তাদের কাছে তুলে ধরেছেনতাদের মাতৃভাষায় পবিত্র কুরআন মজিদ অনুবাদ করে তাদেরকে কুরআন-হাদিসের জ্ঞান দান করেছেন এবং নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের হুকুম-আহকাম, নিয়মকানুন শিক্ষা দিয়েছেন 

যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাঃ-এর খিলাফতকালের মধ্যভাগ হতে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেআরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, তুরস্ক, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে ইসলাম প্রচারকগণ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য এসেছেনতারা এ দেশে এসে এ দেশের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করেছেন এবং এ দেশের মানুষের ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেছেনএ দেশের মানুষ অতি সহজেই তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পকে জানতে পারে, ফলে দলে দলে মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেআরো লক্ষ করা যায়, বাংলা ভাষা এক দারুণ অবহেলিত অবস্থা থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত হয় মুসলমানদের আগমনের ফলে
[তথ্যসূত্র : আল-কুরআন, বাংলা উইকপিডিয়া, বাংলা পিডিয়া ও ভাষার অন্যান্য গ্রন্থাবলী]।

১০. উপসংহারঃ
ভাষা মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার পক্ষ বিশাল নি‘য়ামত। এই নি‘য়ামত যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি তাদের মূল্যায়ণ করা, তাদের রুহে মাগফিরাত কামনা করা, এই ভাষা চর্চা করা এবং দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণে এই নি‘য়ামত যেন আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনে মহান আল্লাহর নিকট এই কামনা-বাসনা ও প্রত্যাশ্যা ব্যক্ত করছি। মহান আল্লাহ সকল ভাষা শহীদদের ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে ইল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে এই ভাষা ব্যবহার করার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।