Wednesday, 27 March 2019

আরব মনীষা ; ‘অকুতোভয় বীরসেনানী, মহাবীর সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী’


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আরব মনীষা ; ‘অকুতোভয় বীরসেনানী
মহাবীর সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী
রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী 


‘অদম্য দুর্জয় দ্বিকবিজয়ী, রাজপথের লড়াকু সৈনিক, মিথ্যার সাথে আপোষহীন সংগ্রামী সিপাহসালার, অকুতোভয় বীরসেনানী, মহাবীর সালাহ উদ্দীন আইয়ূবীযিনি পশ্চাত্যে সালাদিননামে পরিচিত

সালাহ উদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব (কুর্দি : سەلاحەدینی ئەییووبی / Selahedînê Eyûbî; আরবি : صلاح الدين يوسف بن أيوب‎‎) (১১৩৭/১১৩৮  ৪ মার্চ ১১৯৩) ছিলেন মিশর  সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাপাশ্চাত্যে তিনি সালাদিন বলে পরিচিততিনি কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর লোক ছিলেন। লেভেন ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তিনি মুসলিম প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেনক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এব উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল

১১৬৩ সালে তার জেনগি বংশীয় ঊর্ধ্বতন নূরউদ্দিন জেনগি তাকে ফাতেমীয় মিশরে প্রেরণ করেনক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে সালাহউদ্দীন ফাতেমীয় সরকারের উচ্চপদে পৌছান ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল১১৬৯ সালে তার চাচা শেরেকোহ মৃত্যুবরণ করলে আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তার উজির নিয়োগ দেনশিয়া নেতৃত্বাধীন খিলাফতে সুন্নী মুসলিমদের এমন পদ দেয়া বিরল ঘটনা ছিলউজির থাকাকালে তিনি ফাতেমীয় শাসনের প্রতি বিরূপ ছিলেনআল আদিদের মৃত্যুর পর তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য ঘোষণা করেনপরবর্তী বছরগুলোতে তিনি ফিলিস্তিনে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালান, ইয়েমেনে সফল বিজয় অভিযানের আদেশ দেন এবং উচ্চ মিশরে ফাতেমীয়পন্থি বিদ্রোহ উৎখাত করেন

১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা  হিমস জয় করেনজেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়েসরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিলএরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হনউত্তর সিরিয়া ও জাজিরায় তিনি আরও অভিযান চালানএসময় হাশিশীনদের দুটি হত্যাচেষ্টা থেকে তিনি বেঁচে যান১১৭৭ সালে তিনি মিশরে ফিরে আসেন১১৮২ সালে আলেপ্পো জয়ের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন সিরিয়া জয় সমাপ্ত করেনতবে জেনগিদের মসুলেরশক্তঘাটি দখলে সমর্থ হননি

সালাহউদ্দীনের ব্যক্তিগত নেতৃত্বে আইয়ুবী সেনারা ১১৮৭ সালে হাত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের পরাজিত করেএর ফলে মুসলিমদের জন্য ক্রুসেডারদের কাছ থেকে ফিলিস্তিন জয় করা সহজ হয়ে যায়এর ৮৮ বছর আগে ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ক্রুসেডার ফিলিস্তিন রাজ্য এরপর কিছুকাল বজায় থাকলেও হাত্তিনের পরাজয় এই অঞ্চলে মুসলিমদের সাথে ক্রুসেডার সংঘাতের মোড় ঘুরিয়ে দেয়সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ১১৯৩ সালে তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেনতার অধিকাংশ সম্পদ তিনি তার প্রজাদের দান করে যান উমাইয়া মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়সেখানে তার মাজার অবস্থিত

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে সংগৃহীত।

Tuesday, 26 March 2019

আল-কুরআনের মুক্তাতুল্য রত্মবাণীর চুম্বাকাংশঃ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আল-কুরআনের মুক্তাতুল্য রত্মবাণীর চুম্বাকাংশঃ
রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী


০১. আল্লাহই মুমিনদের অভিভাবক :
﴿اَللهُ وَلِىُّ الَّذِينَ ءَامَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمٰتِ إِلَى النُّورِ﴾
আল্লাহই হচ্ছেন মুমিনদের অভিভাবকতিনি তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে নিয়ে যান[সূরা বাক্বারা : ২৫৭]

০২. নারী বা পুরুষ যারা ঈমান আনবে ও সৎ কর্ম করবে তারাই মুমিন ও জান্নাতী :
﴿وَمَن يَعْمَلْ مِنَ الصّٰلِحٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوْ أُنثٰى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولٰٓئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا﴾
আর পুরুষই হোক অথবা নারীই হোক, যারাই বিশ্বাসী হয়ে সৎকাজ করবে, তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি (খেজুরের আঁটির পিঠে) বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না[সূরা নিসা : ১২৪]

০৩. যে ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার :
﴿مَنْ ءَامَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْءَاخِرِ وَعَمِلَ صٰلِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ﴾
যে আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তার জন্য তার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে পুরস্কার[সূরা বাক্বারা : ৬২]

০৪. কল্যাণ ও আত্ম সংযমতায় পরস্পরকে সাহায্য করা :
﴿وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى ۖ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوٰنِ﴾
সৎ কাজ করতে ও সংযমী হতে তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করতবে পাপ ও শক্রতার ব্যাপারে তোমরা একে অপরকে সাহায্য করনা[সূরা মায়িদা : ০২]

০৫. আল্লাহ ধৈর্য্যধারণকারীদের সাথে রয়েছেন :
﴿يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوةِ ۚ إِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِينَ﴾
হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলগণের সাথে আছেন[সূরা বাক্বারা : ১৫৩]

Monday, 25 March 2019

তাযকীয়্যাহ্ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে আল-কুরআন ও হাদীসের রত্মবাণী এবং বিজ্ঞবচনঃ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
তাযকীয়্যাহ্ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে আল-কুরআন ও 
হাদীসের রত্মবাণী এবং বিজ্ঞবচনঃ
রচনা, সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : মুফতি আব্দুস সালাম
 

০১. তাযকীয়্যাহ্ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে আল-কুরআনে মহান আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেনঃ
1-  قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى
He has certainly succeeded who purifies himself নিশ্চয়ই সে সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে[সূরা আলা : ১৪]

2-  ﴿قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكّٰىهَا﴾
He has succeeded who purifies it সেই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে[সূরা শামস : ৯]

3-  ﴿رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ ءَايٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
Our Lord, and send among them a messenger from themselves who will recite to them Your verses and teach them the Book and wisdom and purify them. Indeed, You are the Exalted in Might, the Wise হে আমাদের রাব্ব! তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার নিদর্শনাবলী পাঠ করে শুনাবেন এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেননিশ্চয়ই আপনি পরাক্রান্ত, বিজ্ঞানময়[সূরা বাক্বারা : ১২৯]

4-  ﴿هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ﴾
It is He who has sent among the unlettered a Messenger from themselves reciting to them His verses and purifying them and teaching them the Book and wisdom - although they were before in clear error তিনিই উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল রূপে যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াত, তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত; ইতোপূর্বেতো তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে[সূরা জুম: ০২]

০২. তাযকীয়্যাহ্ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে আল-হাদীসে মহান রাসূল () এরশাদ করেনঃ
1-  عَنْ نُعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : ‏أَلاَ وَإِنَّ فِي الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ‏.‏ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ ‏
Narrated Nu'man bin Bashir : I heard Allah's Messenger() saying, Beware! There is a piece of flesh in the body if it becomes good (reformed) the whole body becomes good but if it gets spoilt the whole body gets spoilt and that is the heart. নুমান ইবনু বশীর (রাযি.) হতে বর্ণিততিনি বলেনঃ আমি আল্লাহর রাসূল ()-কে বলতে শুনেছি যে, ‘জেনে রাখ, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়জেনে রাখ, সে গোশতের টুকরোটি হল অন্তর’’[সহীহ বুখারী ৫২, সহীহ মুসলিম হা/নং ১৫৯৯, আহমাদ হা/নং ১৮৩৯৬, ১৮৪০২]

2-  عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏"‏ إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ
Abu Huraira reported Allah's Messenger () as saying : Verily Allah does not look to your faces and your wealth but He looks to your heart and to your deeds. আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল () এরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের শরীর বা আকৃতির দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তরের প্রতিই লক্ষ করেনএরপর রাসুল (সা.) অন্তরকে দেখানোর জন্য আঙুল দিয়ে নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন[সহীহ বুখারী হা/নং ৬০৬৪, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৫৬৪, সুনান ইবনু মাযাহ হা/নং ৪১৪৩]

০৩. তাযকীয়্যাহ্ (আত্মশুদ্ধি) সম্পর্কে বিজ্ঞবচনঃ
মানবচরিত্রের এমন কিছু দোষ বা গুণ আছে, যা ইহকাল ও পরকালের সফলতা ও ব্যর্থতার নিয়ামক১০টি মন্দ স্বভাব আছে, যা আত্মশুদ্ধির পথে বাধাস্বরূপসে বিষয়গুলো হলো : حِرْصٌ (হিরস) লোভ, طَمَعيٰ (তমা) উচ্চাভিলাষ, رِيٰا (রিয়া) প্রদর্শনেচ্ছা, كِبِرْ (কিবর) অহংকার, كِذْبٌ (কিজব) মিথ্যা, غِيْبَةٌ (গীবাহ্) পরনিন্দা, حَسَدٌ (হাসাদ) হিংসা, عُزْبٌ (উজব) অহমিকা, قِنيٰ (কিনা) পরশ্রীকাতরতা ও بَخْلٌ (বুখল) কৃপণতা[তথ্যসূত্র : القول الجميل (আল কওলুল জামিল) সুন্দর ও উত্তম কথা]।

Sunday, 24 March 2019

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব-তাৎপর্য ও ভয়াবহতাঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব-তাৎপর্য ও ভয়াবহতাঃ
সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
 

১. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার দ্বারা আল্লাহ তাআলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের ধন-সম্পদে বরকত দেনআত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়-স্বজনকে।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা যেমন জরুরী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা তেমনি হারাম। আর আত্মীয়-স্বজনদের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কুরআনে কারিমে এবং হাদীসে অনেক বাণী উল্লিখিত হয়েছে

২. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে কুরআনের বাণীঃ
ক. আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে তাদের প্রশংসায় তিনি ইরশাদ করেন : ﴿وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ﴾ আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে[সূরা আর-রাদ : ২১]।

খ. পক্ষান্তরে যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না তীব্র ভাষায় তাদের ভৎর্সনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন : ﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ﴾ আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লানত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস[সূরা আর-রাদ : ২৫]।

গ. যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন : ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ ۞ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ﴾ তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদেরকে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]

ঘ. রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন : ﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾ আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক[সূরা আন-নিসা : ০১]

এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন

সম্মানিত পাঠকবর্গ, আমরা কি আল্লাহর বাণীর মর্ম অনুধাবন করেছি? আমরা কি রাব্বুল আলামিনের ডাকেন সাড়া দেব না? নাকি এরপরও আমরা আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো? নিজেদের গোমরাহিতে ডুবে থাকবো? আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবো? আর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালনে উদাসীন থাকবো?

৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদীসের বাণীঃ
ক. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :

إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি জীবের সৃজন কাজ শুরু করেনযখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর আশ্রয়স্থানআল্লাহ তাআলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রবতিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্যরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ : ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾ তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’। [সূরা মুহাম্মদ : ২২} সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮৭]।

খ. আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : إنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تُنَادِي بِلِسَانٍ لَهَا ذُلَقٍ : اللَّهُمَّ صِلْ مَنْ وَصَلَنِي، وَاقْطَعْ مَنْ قَطَعَنِي নিশ্চয় আত্মীয়তা-সম্পর্ক আরশকে আকঁড়ে ধরা একটি কাণ্ড, যা জিহ্বার ডগা দিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সাথে জুড়ো যে আমার সাথে জুড়ে আর তুমি তাকে ছিন্ন করো যে আমাকে ছিন্ন করেতখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলা বলেন, ‘রহীম রহমান (আমি দয়ালু, পরম করুণাময়) আর রাহীম’ (اَلرَّحِمَ)  তথা আত্মীয়তা-সম্পর্ক শব্দটিকে আমার নাম থেকে বের করেছিসুতরাং যে এর সাথে সুসম্পর্ক রাখবে আমি তার সাথে সুম্পর্ক রাখবো আর যে এ সম্পর্ক ভঙ্গ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ করবো’। [মুসান্নফ ইবনু আব্দির রাজজাক হা/নং  ২৫৯০১]।

আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হেরাকল তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবরণ জানতে চানজবাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে : يَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিত শুভ্রতা ও আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন[সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮০]।

আমরা কুরআন ও হাদীস থেকে জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সূচনাকালে যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতমআমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি দু’ভাবে। যথা :
এক. কিছু কাজ করার মাধ্যমেযেমন : আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের সঙ্গে সদাচার অব্যাহত রাখা
দুই. কিছু কাজ না করার মাধ্যমেযেমন : আত্মীয়দের কষ্ট না দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট না করাপ্রথমটি আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ স্তর আর দ্বিতীয়টি সর্বনিম্ন স্তর

উল্লেখ্য যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক আবার কয়েক ধরনের। যথা :
প্রথম. সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্কএটি আসলে দীনদারির ভিত্তিতে সম্পর্ক, যা তাকওয়ার একটি শাখাও বটেএটি অর্জিত হয় নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে :
একে অন্যের শুভ কামনা করা, পরামর্শ নেয়া, পরস্পরকে ভালোবাসা, ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা, ওয়াজিব বা জরুরী হক এবং যথাসাধ্য নফল বা ঐচ্ছিক হকসমূহ আদায় করা, মানুষকে সুশিক্ষা দেয়া, সুপথ দেখানো, দিক-নির্দেশনা দেয়া, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অন্যের দুখে সমব্যথী হওয়া এবং মানুষের জন্য কষ্ট দূর করাআর আমরা তো জানিই যে, মুসলিম ভাইয়ের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা

৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার করার ফযীলত / তাৎপর্যঃ
ক. আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত লম্বা হয় এবং ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়এটি কিন্তু যার তার কথা নয়; মহা সত্যবাদী, চরম শত্রু  কাফেরদের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা বিশ্বস্ত উপাধী লাভকারী আল্লাহর নবীর ওয়াদা, যার সম্পর্কে কুরআনে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এভাবে : ﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ۞ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى﴾ তিনি আর মনগড়া কথা বলেন নাতাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়’। [সূরা নাজম : ৩-৪]।

. তিনি ইরশাদ করেন : عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখে[সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮৫, সহীহ মুসলিম হা/নং ৪৬৩৯]।

গ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলে গেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য যে, অন্য পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও নিজের পক্ষ থেকে তা জোড়া লাগায়পক্ষান্তরে যার সাথে সম্পর্ক বহাল রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করলে ব্যাস তা হবে সর্বোচ্চ ভালো সম্পর্কের প্রতিদানে ভালো সম্পর্কএটি যদিও আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যেই পড়ে কিন্তু যে ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক জুড়বে তার সওয়াব অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অনেক বড়রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنْ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করেবরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রাকারী সেই, যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরলে সে তা জোড়া দেয়[সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৯১]।

ঘ. মহান এই দীনে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সাথে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছেআসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي قَالَ نَعَمْ صِلِي أُمَّكِ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেনআমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো[সহীহ বুখারী হা/নং  ২৬২০, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৩৭২]।

সম্মানিত পাঠকবর্গ, আমাদের প্রিয় ধর্মে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মর্যাদা এমনইআমরা কি আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত? আমরা পালন করি তাঁর নির্দেশ? বর্জন করি তার নিষেধকৃত বিষয়গুলো? ভেবে দেখুন, আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি? তাদের খোঁজ-খবর নেই? আমরা তাদের সাথে যোগাযোগহীনতা, তাদের ব্যাপারে অন্তরের অনুদারতাকে ক্ষমার যোগ্য ভাবছি?

হে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশী ভাই-বন্ধু ও বোন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখুনআত্মীয়দের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করবেন না কখনোতাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখলে, তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখলে কত বেশি সওয়াব আর কত লাভ তা সবসময় মনে রাখবেন

ঙ. জানেন কি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখলে কত লাভ? এর লাভ দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতেসংক্ষেপে সেদিকে ইশারা করছি :
  ক. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রকাশ
  খ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা রিজিক ও হায়াত বৃদ্ধির কারণ
  গ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়

চ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরী বুযুর্গদের উক্তিঃ
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমরা তোমাদের বংশগতি বিদ্যা শিক্ষা করো অতপর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করোআল্লাহর কসম! নিশ্চয় তোমাদের একজনের সাথে তার ভাইয়ের বিবাদ হবে, যদি সে জানতো তার ও এর মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্কের কী গুরুত্ব রয়েছে তাহলে তা তাদের এই সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখতো [তাফসিরে তাবারী ১/১৪৪]।

‘আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন, আমি আমার আত্মীয়র জন্য এক টাকা খরচ করাকে দরিদ্র ব্যক্তির জন্য এক হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে উত্তম মনে করিএকজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবু মুহাম্মদ, যদি আত্মীয়টি ধনাঢ্যতায় আমার মতো হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি সে তোমার চেয়েও বড় বিত্তশালী হয় তবুও [ইবনে আবিদ্দুনিয়া, মাকারিমুল আখলাক পৃ. ৬২]।

সাঈদ বিন মুসায়্যাব রহ. কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেনতিনি বলতেন, হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি টাকা কেবল নিজের দীন ও বংশকে নিরাপদ রাখার জন্য সঞ্চয় করেছিযে ব্যক্তি অর্থ সঞ্চয় করল না আর তা দিয়ে অন্যের পাওনা পরিশোধ করল না এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারল আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না, তাতে কোনো কল্যাণ নেই[ইবনে মুফলিহ, আদাবে শরইয়্যা ৩/২৬২]।

‘আমর বিন দিনার রহ. বলেন, নিশ্চিত জেনো, ফরজ আদায়ের জন্য কদম ফেলার সর্বোত্তম পদক্ষেপ সেটি, যা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রার জন্য ফেলা হয়সুলাইমান বিন মুসা রহ. বলেন, আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, আত্মীয়তা-সম্পর্কের হক কী? তিনি বললেন, যখন সে এগিয়ে আসে তখন তাকে স্বাগত জানানো আর যখন সে পিছিয়ে যায় তখন তার পেছনে যাওয়া[প্রাগুক্ত]।

ছ. আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে সতর্কিকরণঃ
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যেমন অনেক সওয়াব ও বড় নেকি রয়েছে, তেমনি তা নষ্ট করার মধ্যে রয়েছে অনেক গুনাহ ও ক্ষতিকারিতাযেমন : বলা হয়েছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারী জান্নাতে যাবে নাজুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’[বুখারী : ৬৬৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৭]

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে এ সম্পর্ক ছিন্নকারী যেন উত্তপ্ত বালি ভক্ষণ করেআবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত :

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمْ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنْ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় রয়েছে- আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি আর তারা তা নষ্ট করে, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি আর তারা আমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে এবং তারা আমার সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে আর আমি তাদের আচরণে ধৈর্য্য ধরিরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘটনা যদি তেমনই হয় যেমন তুমি বলছো, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত বালু খাওয়াচ্ছো আর যতক্ষণ তুমি তোমার এ অবস্থানে থাকবে, তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী থাকবে[সহীহ বুখারী হা/নং ৬৬৮৯, সহীহ মুসলিম হা/নং ৪৬৪০]।

আল্লাহ তাআলা বলেন : ﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ﴾ আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লানত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস[সূরা রাদ : ২৫]।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকরার সবচেয়ে বড় নমুনা হলো পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করাতারপর যে সবচেয়ে কাছের তার সাথে, তারপর যে সবচেয়ে নিকটতর তার সাথেএজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করবো না? কথাটি তিনি তিনবার বললেনআমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূলতিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া[সহীহ বুখারী হা/নং ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৭০]।

পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ যে, আল্লাহর সাথে শিরকের সাথে সাথেই এর কথা বলা হয়েছে! আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার আরেকটি হলো, আখিরাতের আগেই দুনিয়াতে এর শাস্তি প্রদান করা হয়রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْعُقُوبَةَ لِصَاحِبِهِ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা ও জুলুমের চেয়ে অধিক উপয্ক্তু কোনো অপরাধ নেই যার শাস্তি সত্বরই দুনিয়াতে দেয়া হয়অথচ আখিরাতের শাস্তি তার জন্য বরাদ্দই থাকে[মুসনাদে আহমদ হা/নং ২০৪১৪]।

৫. উপসংহারঃ
হে আল্লাহর বান্দাগণ, আল্লাহকে ভয় করুন এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখুনআত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করুন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে উপহার দেয়া, তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমেতাদের সাথে সম্পর্ক রাখুন ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নম্র কথা, হাসিমুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমাজে প্রচলিত সব ধরনের আত্মীয়তা রক্ষার উপায় অবলম্বনের মাধ্যমেকামিয়াব হোন এর দ্বারা দুনিয়াতে ও আখিরাতে  আর অবশ্যই আপনারা এ সম্পর্ক নষ্ট করবেন নাকারণ তা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনেআল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দিনআমীন