বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব-তাৎপর্য ও
ভয়াবহতাঃ
সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
১. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের
ধন-সম্পদে বরকত দেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের
উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়-স্বজনকে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা যেমন জরুরী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা তেমনি হারাম। আর আত্মীয়-স্বজনদের
ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক
কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কুরআনে কারিমে এবং হাদীসে অনেক বাণী উল্লিখিত
হয়েছে।
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে
কুরআনের বাণীঃ
ক. আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে তাদের প্রশংসায় তিনি ইরশাদ করেন : ﴿وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ
بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ﴾ ‘আর আল্লাহ যে
সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট
রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের
আশঙ্কা করে।’ [সূরা আর-রা‘দ : ২১]।
খ. পক্ষান্তরে যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না তীব্র ভাষায়
তাদের ভৎর্সনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ
عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ
أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ
سُوءُ الدَّارِ﴾ ‘আর যারা
আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট
রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের
জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’ [সূরা আর-রা‘দ : ২৫]।
গ. যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়দের সাথে
সুসম্পর্ক বজায় রাখে না তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ﴿فَهَلْ
عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا
أَرْحَامَكُمْ ۞ أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى
أَبْصَارَهُمْ﴾ ‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদেরকে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’ [সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]।
ঘ. রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়ে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي
تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾ ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক।’ [সূরা আন-নিসা : ০১]।
এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার নির্দেশ
দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন।
সম্মানিত পাঠকবর্গ, আমরা কি আল্লাহর বাণীর মর্ম অনুধাবন
করেছি?
আমরা কি রাব্বুল আলামিনের ডাকেন সাড়া দেব না? নাকি এরপরও আমরা আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো? নিজেদের গোমরাহিতে ডুবে থাকবো? আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতার
পুনরাবৃত্তি করতে থাকবো? আর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালনে উদাসীন
থাকবো?
৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে
হাদীসের বাণীঃ
ক. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ
خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ
قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ
قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ
تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾
আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের
সৃজন কাজ শুরু করেন। যখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে
উঠল,
‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর
আশ্রয়স্থান’। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও
তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রব’। তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ : ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ
تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾ ‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’। [সূরা মুহাম্মদ : ২২} সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮৭]।
খ. আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : إنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تُنَادِي بِلِسَانٍ
لَهَا ذُلَقٍ : اللَّهُمَّ صِلْ مَنْ وَصَلَنِي، وَاقْطَعْ مَنْ قَطَعَنِي ‘নিশ্চয় আত্মীয়তা-সম্পর্ক আরশকে আকঁড়ে ধরা একটি কাণ্ড, যা জিহ্বার ডগা দিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সাথে জুড়ো যে আমার সাথে জুড়ে আর তুমি
তাকে ছিন্ন করো যে আমাকে ছিন্ন করে।’ তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা বলেন, ‘রহীম রহমান (আমি দয়ালু, পরম করুণাময়) আর ‘রাহীম’ (اَلرَّحِمَ) তথা
আত্মীয়তা-সম্পর্ক শব্দটিকে আমার নাম থেকে বের করেছি। সুতরাং যে এর সাথে সুসম্পর্ক রাখবে আমি তার
সাথে সুম্পর্ক রাখবো আর যে এ সম্পর্ক ভঙ্গ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ করবো’। [মুসান্নফ ইবনু আব্দির রাজজাক হা/নং ২৫৯০১]।
আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে
বাদশা হেরাকল তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবরণ জানতে
চান। জবাবে তিনি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে : يَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ ‘তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিত শুভ্রতা ও আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।’ [সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮০]।
আমরা কুরআন ও হাদীস থেকে জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের
সূচনাকালে যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আত্মীয়তার
সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি দু’ভাবে। যথা :
এক. কিছু কাজ করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের
সঙ্গে সদাচার অব্যাহত রাখা।
দুই. কিছু কাজ না করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের
কষ্ট না দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট না করা। প্রথমটি আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ স্তর আর
দ্বিতীয়টি সর্বনিম্ন স্তর।
উল্লেখ্য যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক আবার কয়েক ধরনের। যথা :
প্রথম. সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক। এটি আসলে দীনদারির
ভিত্তিতে সম্পর্ক, যা তাকওয়ার একটি শাখাও বটে। এটি অর্জিত হয় নিম্নোক্ত
কাজগুলোর মাধ্যমে :
একে অন্যের শুভ কামনা করা, পরামর্শ নেয়া, পরস্পরকে ভালোবাসা, ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা, ওয়াজিব বা
জরুরী হক এবং যথাসাধ্য নফল বা ঐচ্ছিক হকসমূহ আদায় করা, মানুষকে সুশিক্ষা দেয়া, সুপথ দেখানো, দিক-নির্দেশনা দেয়া, সৎ কাজে আদেশ
ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অন্যের দুখে
সমব্যথী হওয়া এবং মানুষের জন্য কষ্ট দূর করা। আর আমরা তো জানিই যে, মুসলিম ভাইয়ের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ঈমানের
সর্বনিম্ন শাখা।
৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার করার ফযীলত / তাৎপর্যঃ
ক. আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত লম্বা হয় এবং ধন-সম্পদ
বৃদ্ধি পায়। এটি কিন্তু যার তার কথা নয়; মহা
সত্যবাদী, চরম শত্রু কাফেরদের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা
বিশ্বস্ত উপাধী লাভকারী আল্লাহর নবীর ওয়াদা, যার সম্পর্কে কুরআনে সার্টিফিকেট
দেয়া হয়েছে এভাবে
: ﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى ۞
إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى﴾
‘তিনি আর মনগড়া কথা বলেন না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়’। [সূরা নাজম : ৩-৪]।
খ. তিনি ইরশাদ করেন : عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ
لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ ‘যে ব্যক্তি
কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক
বজায় রাখে।’ [সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৮৫, সহীহ মুসলিম
হা/নং ৪৬৩৯]।
গ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলে গেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে
আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য যে, অন্য পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন
করলেও নিজের পক্ষ থেকে তা জোড়া লাগায়। পক্ষান্তরে
যার সাথে সম্পর্ক বহাল রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করলে ব্যাস তা হবে সর্বোচ্চ ভালো
সম্পর্কের প্রতিদানে ভালো সম্পর্ক। এটি যদিও
আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যেই পড়ে কিন্তু যে ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে
এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক জুড়বে তার সওয়াব অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অনেক বড়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : لَيْسَ الْوَاصِلُ
بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنْ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا
‘সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে সম্পর্ক রক্ষার
বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রাকারী সেই, যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরলে সে তা জোড়া দেয়।’ [সহীহ বুখারী হা/নং ৫৯৯১]।
ঘ. মহান এই দীনে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের
সাথেও সম্পর্ক রাখতে আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সাথে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত
করা হয়েছে। আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু
আনহুমা থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন : قَدِمَتْ
عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي قَالَ نَعَمْ صِلِي أُمَّكِ ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো।’ [সহীহ বুখারী হা/নং ২৬২০, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৩৭২]।
সম্মানিত পাঠকবর্গ, আমাদের প্রিয় ধর্মে আত্মীয়তার সম্পর্ক
রক্ষার মর্যাদা এমনই। আমরা কি আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত? আমরা পালন করি তাঁর নির্দেশ? বর্জন করি তার
নিষেধকৃত বিষয়গুলো? ভেবে দেখুন, আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি? তাদের খোঁজ-খবর নেই? আমরা তাদের সাথে যোগাযোগহীনতা, তাদের ব্যাপারে অন্তরের অনুদারতাকে ক্ষমার যোগ্য ভাবছি?
হে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশী ভাই-বন্ধু ও বোন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখুন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করবেন না কখনো। তাদের সাথে
সুসম্পর্ক রাখলে, তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখলে কত বেশি সওয়াব
আর কত লাভ তা সবসময় মনে রাখবেন।
ঙ. জানেন কি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখলে কত লাভ? এর লাভ দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে। সংক্ষেপে সেদিকে ইশারা করছি :
ক. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রকাশ।
খ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা রিজিক ও হায়াত বৃদ্ধির কারণ।
গ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি
অর্জন হয়।
চ. আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরী বুযুর্গদের উক্তিঃ
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশগতি বিদ্যা শিক্ষা করো অতপর আত্মীয়দের
সাথে সম্পর্ক রক্ষা করো। আল্লাহর কসম! নিশ্চয় তোমাদের একজনের সাথে তার ভাইয়ের বিবাদ হবে, যদি সে জানতো তার ও এর মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্কের কী গুরুত্ব
রয়েছে তাহলে তা তাদের এই সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখতো।’ [তাফসিরে তাবারী ১/১৪৪]।
‘আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন, ‘আমি আমার আত্মীয়র জন্য এক টাকা খরচ করাকে দরিদ্র ব্যক্তির
জন্য এক হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে উত্তম মনে করি। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবু মুহাম্মদ, যদি আত্মীয়টি
ধনাঢ্যতায় আমার মতো হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি সে তোমার চেয়েও বড় বিত্তশালী হয় তবুও।’ [ইবনে আবিদ্দুনিয়া, মাকারিমুল আখলাক পৃ. ৬২]।
সাঈদ বিন মুসায়্যাব রহ. কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি জানেন
আমি টাকা কেবল নিজের দীন ও বংশকে নিরাপদ রাখার জন্য সঞ্চয় করেছি। যে ব্যক্তি অর্থ
সঞ্চয় করল না আর তা দিয়ে অন্যের পাওনা পরিশোধ করল না এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা
করতে পারল আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না, তাতে কোনো
কল্যাণ নেই।’ [ইবনে মুফলিহ, আদাবে শরইয়্যা ৩/২৬২]।
‘আমর বিন দিনার রহ. বলেন, ‘নিশ্চিত জেনো, ফরজ আদায়ের
জন্য কদম ফেলার সর্বোত্তম পদক্ষেপ সেটি, যা
আত্মীয়তা-সম্পর্ক রার জন্য ফেলা হয়।’ সুলাইমান বিন মুসা রহ. বলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, আত্মীয়তা-সম্পর্কের হক কী? তিনি বললেন, যখন সে এগিয়ে আসে তখন তাকে স্বাগত জানানো আর
যখন সে পিছিয়ে যায় তখন তার পেছনে যাওয়া।’ [প্রাগুক্ত]।
ছ. আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে সতর্কিকরণঃ
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যেমন অনেক সওয়াব ও বড় নেকি রয়েছে, তেমনি তা
নষ্ট করার মধ্যে রয়েছে অনেক গুনাহ ও ক্ষতিকারিতা। যেমন : বলা হয়েছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারী জান্নাতে যাবে না। জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : لَا يَدْخُلُ
الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ
‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’[বুখারী : ৬৬৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৭]
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে এ সম্পর্ক ছিন্নকারী যেন উত্তপ্ত
বালি ভক্ষণ করে। আবু হুরায়রা
রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُولَ
اللَّهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ
وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ
كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمْ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنْ
اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় রয়েছে- আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি
আর তারা তা নষ্ট করে, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি আর তারা আমার
সাথে মন্দ ব্যবহার করে এবং তারা আমার সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে আর আমি তাদের
আচরণে ধৈর্য্য ধরি। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘটনা যদি
তেমনই হয় যেমন তুমি বলছো, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত বালু খাওয়াচ্ছো
আর যতক্ষণ তুমি তোমার এ অবস্থানে থাকবে, তোমার সাথে
আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী থাকবে।’
[সহীহ
বুখারী হা/নং ৬৬৮৯, সহীহ মুসলিম হা/নং ৪৬৪০]।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ
اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ
يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ
الدَّارِ﴾ ‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর
তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং
যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’
[সূরা রা‘দ : ২৫]।
আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকরার সবচেয়ে বড় নমুনা হলো পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক
নষ্ট করা। তারপর যে সবচেয়ে কাছের তার সাথে, তারপর যে
সবচেয়ে নিকটতর তার সাথে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : أَلَا
أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ
اللَّهِ قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ
‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করবো
না? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে
শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া।’ [সহীহ বুখারী হা/নং ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৭০]।
পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ যে, আল্লাহর সাথে শিরকের সাথে সাথেই এর কথা
বলা হয়েছে! আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্ট করার আরেকটি হলো, আখিরাতের
আগেই দুনিয়াতে এর শাস্তি প্রদান করা হয়। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ
اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْعُقُوبَةَ لِصَاحِبِهِ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا
يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ ‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা ও জুলুমের চেয়ে অধিক উপয্ক্তু
কোনো অপরাধ নেই যার শাস্তি সত্বরই দুনিয়াতে দেয়া হয়। অথচ আখিরাতের শাস্তি তার জন্য বরাদ্দই থাকে।’ [মুসনাদে আহমদ হা/নং ২০৪১৪]।
৫. উপসংহারঃ
হে আল্লাহর বান্দাগণ,
আল্লাহকে ভয় করুন এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখুন। আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করুন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে
উপহার দেয়া, তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে। তাদের
সাথে সম্পর্ক রাখুন ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নম্র কথা, হাসিমুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমাজে প্রচলিত সব ধরনের আত্মীয়তা রক্ষার উপায়
অবলম্বনের মাধ্যমে। কামিয়াব হোন এর দ্বারা দুনিয়াতে ও
আখিরাতে। আর অবশ্যই আপনারা এ সম্পর্ক নষ্ট
করবেন না। কারণ তা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের
ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনে। আল্লাহ তা‘আলা
আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।