Tuesday, 2 April 2019

জলে ও স্থলের সকল বিপর্যয় মানুষের হস্তদ্বয়ের উপার্জনঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
জলে ও স্থলের সকল বিপর্যয় মানুষের হস্তদ্বয়ের উপার্জনঃ
মানুষের নিকট যত প্রবকারের বিপদ-আপদ আসে তা নিজেদের কৃতকর্মের তথা গুনাহের কারণেই আসেঃ
রচনা সংগ্রহ ও সঞ্চয়নে : আবু মাহফুজ মুফতি আব্দুস সালাম 


০১. আয়াত সমূহঃ
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা বলেনঃ
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِى الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِى النَّاس لِيُذِيقَهُم بَعْضَ الَّذِى عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُون
অর্থ: মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয়, বিপদাপদ (গযব) ছড়িয়ে পড়েছে; যাতে ওদের কোন কোন কর্মের শাস্তি ওদেরকে আস্বাদন করানো হয়। যাতে ওরা (সৎপথে) ফিরে আসে"। [সূরা রুম : ৪১]
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা অন্যত্র বলেন :
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
অর্থ: তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে। অনেক গোনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করে দেন"। [সূরা শূরা : ৩০]

০২. আয়াত সমূহের ব্যাখ্যাঃ
ব্যাখ্যা : বর্তমানে প্রায় সকল স্থানে এমন কোনো পাপের কাজ নাই যে, তা নির্দ্বিধায় করা হয় না। সকল পাপ কাজ সর্বত্রই ঢুকে পড়েছে । ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, পাড়া মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কি গ্রাম! কি শহর! সকল পর্যায়ের নারী পুরুষ জঘন্য পাপ কাজে নিমজ্জিত বা জড়িত । সর্বত্রই মদ, গাঁজা, নেশাজাতীয় বস্তু পান বা ভক্ষন অহরহ চলছে । যেখানে সেখানে মদের ছড়াছড়ি । সর্বত্রই চলছে যেনা ব্যভিচার, চলছে অবৈধ প্রেম ও দেহ ব্যবসা । যেখানে সেখানে পতিতালয় । চলছে হারাম উপার্জন, চলছে ঠকবাজি ধোঁকাবাজি, যেখানেই দুই চোখ যায় সেখানেই দেখা মিলে দূর্নীতির । আরো কতো কি । আরো একটি জঘন্য পাপের কাজ তা হল, গান বাজনা , বাদ্যযন্ত্র,নাচ গান ও নৃত্য ।বর্তমানে এই নাচ গান, বাদ্যযন্ত্র গান, এগুলোই সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সকল স্থানে, এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও চলে নাচ গান ও নৃত্য । এখন ঘরে ঘরে সিনেমা তৈরি হয়েছে। পকেটে পকেটে সিনেমা তৈরি হয়েছে। তাইতো অশ্লীলতার ছড়াছড়ি ।

জল ও স্থলের বিপর্যয় দ্বারা উদ্দেশ্য হলন অনাবৃষ্টি, ফসল ও ফলমূল উৎপন্ন না হওয়া, দুর্ভিক্ষ হওয়া, বেশি বেশি বালা-মুসিবত, বিপদ-আপদ হওয়া, অনাকাক্সিক্ষত রোগ-মহামারি, মানব হত্যা, অগ্নিকাণ্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়া, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ। আল্লাহ তাআলা বলেন, এসব আপদ-বিপদ মানুষের কর্মের ফসল অর্থাৎ অন্যায়-অশ্লীল কাজে জড়িত হওয়া, মানুষের ওপর জুলুম করা, মন্দ কাজ থেকে বাধা না দেয়া, অপরাধের শরয়ী শাস্তি প্রদান না করা ইত্যাদিও দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার কারণ।

স্থল' বলতে মানুষের বাসভূমি এবং জল বলতে সমুদ্র, সামুদ্রিক পথ এবং সমুদ্র-উপকূলে বসবাসের স্থান বুঝানো হয়েছে। 'ফাসাদ' (বিপর্যয়) বলতে ঐ সকল আপদ-বিপদকে বুঝানো হয়েছে, যার দ্বারা মনুষ্য-সমাজে সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট হয় এবং মানুষের শান্তিময় জীবন-যাত্রা ব্যাহত হয়। এই জন্য এর অর্থ গোনাহ ও পাপাচরণ করাও সঠিক। অর্থাৎ, মানুষ এক অপরের উপর অত্যাচার করছে, আল্লাহর সীমা লংঘন করছে এবং নৈতিকতার বিনাশ সাধন করছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত সাধারণ ব্যাপার হয়ে পড়েছে।

ফাসাদ'-এর অর্থ আকাশ-পৃথিবীর ঐ সকল বিপর্যয় নেওয়াও সঠিক, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি ও সতর্কতা স্বরূপ প্রেরণ করা হয়। যেমন দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অনিরাপত্তা, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি। উদ্দেশ্য এই যে, যখন মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিফল স্বরূপ তাদের কর্মপ্রবণতা মন্দের দিকে ফিরে যায় এবং তার ফলে পৃথিবী নানা বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সুখ-শান্তি বিলীন হয় এবং তার পরিবর্তে ভয়-ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ছিন্তাই-ডাকাতি, লড়াই ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়ে। তার সাথে সাথে কখনো আকাশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন আপদ-বিপদ (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) ও প্রেরিত হয়। আর তাতে উদ্দেশ্য এই থাকে যে, ঐ সর্বনাশী বিপর্যয় ও আপদ-বিপদ দেখে সম্ভবত মানুষ পাপকর্ম থেকে বিরত হবে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে পুনরায় তাঁর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসবে।

যেখানে আল্লাহর বিধিবিধান পালন করার কথা ছিল ।তা নাকরে উল্টো আল্লাহকে ভুলে, আল্লাহর সাথে নাফরমানি করে । আল্লাহর বিধি-বিধান উপেক্ষা করে চলে । এ কারণেই তো স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের কুকর্মের বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। উপরের উক্ত আয়াতে বিপর্যয়বলে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকাণ্ড, রোড এক্সিডেন্ট,পানিতে নিমজ্জিত, আসমানী বালা, কাল বৈশাখী ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও ভূমি ধস হওয়ার ঘটনাবলীর প্রাচুর্য, সব কিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি আপদ-বিপদ বোঝানো হয়েছে। [তাফসীর সাদী, কুরতুবী, বাগভী]

উপরের আয়াতে আল্লাহ্ এই দিকেই লক্ষ্য করে বলেছেন :
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
অর্থ: তোমাদেরকে যেসব বিপদাপদ স্পর্শ করে, সেগুলো তোমাদেরই কৃতকর্মের কারণে। অনেক গোনাহ তো আল্লাহ ক্ষমাই করে দেন"। [সূরা শূরা : ৩০]
ব্যাখ্যা : উদ্দেশ্য এই যে, এই দুনিয়ায় বিপদাপদের সত্যিকার কারণ তোমাদের গোনাহ; যদিও দুনিয়াতে এসব গোনাহের পুরোপুরি প্রতিফল দেয়া হয় না এবং প্রত্যেক গোনাহর কারণেই বিপদ আসে না। বরং অনেক গোনাহ, তো ক্ষমা করে দেয়া হয়। তবে এটা সত্য যে, সমস্ত গোনাহর কারণে বিপদ আসে না বরং কোন কোন গোনাহর কারণেই বিপদ আসে। দুনিয়াতে প্রত্যেক গোনাহর কারণে বিপদ আসলে একটি মানুষও পৃথিবীতে বেঁচে থাকত না।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন :
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِظُلْمِهِمْ مَا تَرَكَ عَلَيْهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ
অর্থ: আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের সীমালংঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন।” [সূরা নাহল : ৬১]।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আরো বলেন : 
وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللَّهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَى ظَهْرِهَا مِنْ دَابَّةٍ وَلَكِنْ يُؤَخِّرُهُمْ إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِعِبَادِهِ بَصِيرًا
অর্থ: আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূপৃষ্ঠের কোন জীব জন্তুকেই রেহাই দিতেনন।, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে গেলে আল্লাহ হবেন তাঁর বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা। [সূরা ফাতির : ৪৫]

০৩. আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. সর্বপ্রকার পাপাচার হতে বিরত থাকতে হবে। কেননা একজনের পাপের কারণে সমস্ত দুনিয়ার সৃষ্টিজীব কষ্ট পেতে পারে।
২. দুনিয়াতে ফেতনা-ফাসাদ ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মানুষের পাপের কারণে হয়ে থাকে।
৩. আরাম-আয়েশ ও অবসর যাপনের জন্য ভ্রমণ না করে শিক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা উচিত।

 ০৪. হাদীস সমূহঃ
হাদীসে এসেছে :
০১. রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘‘জমিনে একটি হদ (শরয়ী বিচারের শাস্তি) কায়েম হওয়া জমিনবাসীর জন্য চল্লিশ দিন বৃষ্টিপাত হওয়া অপেক্ষা উত্তম। [নাসায়ী হা/নং ৪৯২০, মুসনাদ আহমাদ ২/৩৬২ সহীহ]।
কারণ হদ কায়েম হলে পাপীরা পাপকার্য হতে বিরত থাকবে, নিরীহ মানুষ নির্যাতন মুক্ত থাকবে। আর দুনিয়ায় যখন পাপকার্য বন্ধ হয়ে যাবে তখন দুনিয়াবাসী আসমান ও জমিনের বরকত লাভ করবে। তাদের এ সকল পাপকার্যের জন্য আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিভিন্ন মঙ্গল-অমঙ্গল দ্বারা পরীক্ষা করেন যাতে তারা অপকর্ম থেকে ফিরে আসে।
আল্লাহ তাআলা বলেন : وَبَلَوْنٰهُمْ بِالْحَسَنٰتِ وَالسَّيِّاٰتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ  এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ দ্বারা আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে। [সূরা আরাফ ১৬৮]।

০২. কাতাদাহ (রা) বলেন, এটা আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে পাঠানোর আগের অবস্থার বর্ণনা। যখন যমীন ভ্ৰষ্টতা ও অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তারপর আল্লাহ যখন তাঁর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠালেন, তখন মানুষের মধ্যে যারা ফিরে আসার তারা ফিরে আসল। [তাবারী]

০৩. পাপীদের সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে যে, الْعَبْدُ الْفَاجِرُ يَسْتَرِيحُ مِنْهُ الْعِبَادُ وَالْبِلاَدُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّযখন কোন পাপী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তখন লোকজন, শহর, গাছপালা, জীবজন্তু সবাই শান্তি লাভ করে। [সহীহ বুখারী হা/নং ৬৫১২, সহীহ মুসলিম হা/নং ৬১]।

০৫. উপসংহারঃ
এই গুনাহের প্রতিফলনেই আমরা বর্তমানে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড, ঘন ঘন পানি পথের দুর্ঘটনা লক্ষ্য করতে পারছি ‌। আসলে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'য়ালা মাঝে মধ্যে এ ধরনের বিপদ বা গজব মানুষদেরকে দিয়ে থাকেন । যাতে মানুষেরা গুনাহ ও পাপ কাজ বর্জন করে আল্লাহর পথে ও সৎ পথে ফিরে আসে । পরিশেষে আল্লাহর নিকট দোয়া করি আল্লাহ তা'আলা যেন আমাদের সকলকে পাপ কাজ থেকে হেফাজত করে ও সবধরনের বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করে আমিন ।

No comments:

Post a Comment