বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
রামাদানে
সালাফদের অবস্থা পর্যালোচনাঃ
মুফতি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
অবতরণিকাঃ রামাদান হচ্ছে কুর'আনের মাস। এই মাসেই রাসূল (সা)-এর উপর পবিত্র কুর'আন অবতীর্ণ হয়েছিল। সুতরাং রামাদান আর কুর'আনের সম্পর্ক
"একদেহ একপ্রাণ"এর মত। আসুন রামাদানে আমরা বেশী বেশী কুর'আন তিলাওয়াত করি!!! আমাদের আকাবির এবং সালাফগণ এই পবিত্র
মাসে কুর'আন তেলাওয়াতের ব্যপারে অনেক গুরুত্ব দিতেন। এই মাসে তাঁদের সময়ের
বড় একটা অংশ পবিত্র কুর'আন তেলাওয়াতে ব্যায় করতেন। অনেক সময় তাঁরা ইলমের দরস ছেড়ে কুর'আন তিলাওয়াতের জন্য সময় করে নিতেন। নিম্নে সালাফদের জীবনচিত্রের কিছু খন্ডচিত্র উল্লেখ করছি।
প্রথম : কুরআন
তিলাওয়াত ও খতমে সালাফদের অবস্থাঃ
১. উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন
. . . . .
أَنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يُعَارِضُهُ بِالْقُرْآنِ كُلَّ سَنَةٍ مَرَّةً "
وَإِنَّهُ قَدْ عَارَضَنِي بِهِ الْعَامَ مَرَّتَيْنِ، وَلاَ أَرَى الأَجَلَ
إِلاَّ قَدِ اقْتَرَبَ، فَاتَّقِي اللَّهَ وَاصْبِرِي، فَإِنِّي نِعْمَ السَّلَفُ
أَنَا لَكَ ". قَالَتْ فَبَكَيْتُ بُكَائِي الَّذِي رَأَيْتِ، فَلَمَّا
رَأَى جَزَعِي سَارَّنِي الثَّانِيَةَ قَالَ " يَا فَاطِمَةُ أَلاَ
تَرْضَيْنَ أَنْ تَكُونِي سَيِّدَةَ نِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ ـ أَوْ ـ سَيِّدَةَ
نِسَاءِ هَذِهِ الأُمَّةِ
নিশ্চয়ই জিবরীল (আ) প্রতি বছর এসে পূর্ণ কুরআন একবার আমার নিকট
পেশ করতেন। কিন্তু এ বছর তিনি
এসে তা আমার কাছে দু’ বার পেশ করেছেন। এতে আমি ধারণা করছি যে, আমার চির বিদায়ের সময় সন্নিকট। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করে চলবে এবং বিপদে
ধৈর্যধারণ করবে। নিশ্চয়ই আমি তোমার
জন্য উত্তম অগ্রগমনকারী। তখন আমি কাঁদলাম যা নিজেই দেখলেন। তারপর যখন আমাকে চিন্তিত দেখলেন, তখন দ্বিতীয়বার আমাকে কানে-কানে বললেনঃ তুমি জান্নাতের
মুসলিম মহিলাদের অথবা এ উম্মাতের মহিলাদের নেত্রী হওয়াতে সন্তুষ্ট হবে না? (আমি তখন হাসলাম)। [সহীহ বুখারী হা/নং ৬২৮৫, ৬২৮৬ (তা. পা) ৩৬২৩, ৩৬২৪ (আ প্র) ৫৮৪২, ই ফা- ৫৭৩৬) সহীহ মুসলিম হা/নং ২৪৫০]।
২.
উসমান (রা) প্রতিদিন একবার কুর'আন খতম করতেন।
৩. অনেক সাহাবি প্রতি
তিন রাত্রে (তারাবিতে) কুর'আন খতম করতেন।
৪. অনেকেই প্রতি সাত রাত্রিতে। অনেকেই দশম রাত্রিতে। তাঁরা কুর'আন তিলাওয়াত
করতেন,
সালাতে এবং সালাতের বাইরেও।
৫. ইমাম আবু হানিফা (রহ) এই মাসে বাষট্টি বার কুরআন খতম করতেন।
৬.
ইমাম শাফেয়ী (রহ) ষাট বার কুরআন খতম করতেন।
৭. আসওয়াদ (রহ) প্রতি দুই রাত্রিতে একবার কুরআন খতম করতেন।
৮. কাতাদা (রহ) রামাদানের বাইরে প্রতি সাত দিনে এক খতম, রামাদানে প্রতি তিন রাত্রিতে এক খতম, আর শেষ দশ দিনে প্রতি রাত্রিতে এক খতম দিতেন।
৯. রামাদান মাস আসলে ইমাম মালেক (রহ) হাদিছের দারছ এবং ইলমি
মজলিছ ছেড়ে দিয়ে কুর'আন পাঠে নিমগ্ন থাকতেন।
১০. ছুফিয়ান ছাওরি (রহ)
রামাদান আসলে অন্য সব নফল ইবাদাত ছেড়ে কুর'আনের সাথে
একান্ত সময় কাটাতেন।
১১. ইমাম বুখারী (রহ) রামাদানের প্রতি দিনে এক খতম করতেন ও
প্রতি তিন রাতে এক খতম করতেন।
দ্বিতীয় :
‘ক্বিয়ামুল লাইল’ রাতের দীর্ঘ সালাতে সালাফদের অবস্থাঃ
‘ক্বিয়ামুল লাইল’
রাতের দীর্ঘ সালাত হলো সালাফদের আদব, মু’মিনদের লাভজনক ব্যবসায় এবং সফলদের ‘আমল।
রাতে সালাফগণ দুনিয়াবী কর্মব্যস্থতা থেকে মুক্ত হয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে সময়
অতিবাহিত করতেন এবং সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের নিকট তাদের চাওয়া, কামনা, বাসনা পেশ
করতেন। বিনয়ের সাথে দু‘আ-মুনাজাত ও কান্না-কাটি করতেন।
১. হাসান বসরী (রহ) বলেন : রাতের শেষাংশে সালাতের চেয়ে অন্য
কোন কাজে অধিক তৃপ্তীদায়ক কোন ‘আমল পাইনি।
২. আবূ উসমান আল-হিন্দী বলেন : আমি সাতবার আবূ হুরাইরা
(রা)-এর মেহমান হয়েছি। তিনি, তার স্ত্রী ও সেবিকাগণ রাতকে তিন ভাগে বিভক্ত করতেন।
অতঃপর এক গ্রুপ ইবাদত করতেন অন্য গ্রুপ ঘুমাতেন এভাবে রাত কাটাতেন।
৩. সাদ্দাদ ইবনু আউছ রাতে ঘুমানোর পূর্বে বিছানার নিচে একটি
বীচি বা ছোট পাথর রাখতেন যাতে ইবাদত করতে সহজ হয়।
৪. ত্বাউছ বিছানায় পানি ঢেলে দিতেন যাতে ইবাদত করা সহজতর
হয়। তিনি বিছানা ক্বিবলামূখী করে রাখতেন আর বলতেন : পশু-পাখি জান্নামের ভয়ে
ক্রন্দন করে এবং মু’মিনদের জাগিয়ে দেয়।
৫. ছায়িব ইবনু ইয়াযিদ থেকে বর্ণিত, তিনিবলেন : ওমর (রা)
ইবাই ইবনু কা’ব ও তামিম আদ-দারী (রা) কে আদেশ করতেন রামাদানে লোকজনদের জাগিয়ে দিতে
ও ইবাদত করতে। [বাইহাক্বী]।
৬. ইমাম মালেক আব্দুল্লাহ ইবনু আবি বকর থেকে বর্ণনা করেন : আমরা রামাদানে ফজরের
পূর্বে খাদেমের চিৎকারে (ফজর হওয়ার ভয়ে) রাতের সালাত শেষ করে তাড়াতাড়ি সাহরী
খেতাম। [মুওয়াত্বা ইমাম মালেক]।
তৃতীয় : রামাদান
আগমন করলে সালাফদের দান-অনুদান ও বদান্যতা বহুগুণে বেড়ে যেতঃ
১. রাসূল (সা)-এর
দান-অনুদান ও বদান্যতা বাতাসের চেয়ে বেশি প্রবাহমান ছিল : ইবনু ‘আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি
বলেন :
انَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ
بِالْخَيْرِ وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُونُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ إِنَّ جِبْرِيلَ
عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ سَنَةٍ فِي رَمَضَانَ حَتَّى
يَنْسَلِخَ فَيَعْرِضُ عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْقُرْآنَ
فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ
بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল
ছিলেন আর রমাযান মাসে যখন জিব্রীল (আঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো
অধিক দানশীল হয়ে যেতেন। জিব্রীল (রাঃ) রমাযানের প্রতি রাতে তাঁর
সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন পাঠ করে শুনাতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে যখন জিব্রাঈল (আঃ) দেখা করতেন,
তখন তিনি মানুষের কল্যাণের
জন্য পাঠানো বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হতেন। [সহীহ বুখারী ৩২২০, মুসলিম ২৪৫০, আহমাদ ২৬৪৭৫ (আ প্র) ২৯৮০,
ই ফা ২৯৯০]।
২. মুলহাব (রহ) বলেন : দান-অনুদান ও বদান্যতায় সমস্ত কল্যাণময় কর্ম-তান্ডের
বরকতম রয়েছে। এর দ্বারা সমস্ত দরজাসমূহ খুলে যায়। দানের কারণে অদৃশ্য সাহায্য আসে।
সিয়ামের বরকতে জিব্রীলের আগমন, কুরআন তিলাওয়াত ও খতমের কারণে বদান্যতা বৃদ্ধি।
এমনকি রাসূল (সা)-এর বদান্যতা বাতাসের চেয়েও বেশি প্রবাহমান ছিল।
৩. ইবনু রাজাব বলেন, ইমাম
শাফিয়ী (রহ) বলেছেন : পুরুষদের প্রিয় কর্ম হলো রামাদানে রাসূল (সা)-এর অনুকরণে
বেশি দান-সাদাক্বাহ করা। মানুষের প্রয়োজনীয়তা হলো সংশোধনকরা আর মানুষের ব্যস্ততা
হলো রামাদানে সাওম ও সালাতে সময় অতিবাহিত করা।
৪. ইবনু ওমর (রা)
হতদরিদ্য, অসহায়, দুঃস্থ ও মিসকীন ব্যতীত ইফতার করতেন না। যদি কখনো পরিবারের পক্ষ
থেকে নিষেধাজ্ঞা আসত তাহলে তিনি রাতে আহার করতেন না। যখন কোন ভিক্ষুক আসত তখন
তিনি, খাদ্যরত অবস্থায় থাকলে সেই খাদ্য ভাগ করে ভিক্ষুককে দান করে দিতেন। নিজের
অংশ খেয়ে ভিক্ষুককে দিয়ে চলে যেতেন। কখনো এমন হতো যে, নিজে কোন কিছু না খেয়ে অন্য
সায়িমিনদের (রোযাদারদের) খাওয়াতেন।
৫. ইউনুস ইবনু ইয়াযীদ বলেন
: ইবনু শিহাব রামাদান প্রবেশ করলে কুরআন তিলাওয়াত ও খাদ্য বিতরণে ব্যস্ত থাকতেন।
৬. হাম্মাদ ইবনু আবি
সুলাইমান, রামাদানে পাঁচশত মানুষকে ইফতার খাওয়াতেন। আর প্রত্যেককে ঈদের পরে একশত
দিরহাম (তথকালীন রৌপ্যমুদ্রা) দানকরতেন।
চতুর্থ : খাদ্য
হ্রাসে সালাফদের অবস্থাঃ
১. ইবরাহিম ইবনু
আইয়্যুব বলেন : মুহাম্মাদ ইবনু আমর আল-গাজী (রহ) রামাদান মাসে প্রতিদিন মাত্র
দু’লুক্বমা খাদ্য খেতেন।
২. আবুল আব্বাস, হাশেম ইবনে আল
কাসিম বলেন : আমি রামাযানের
প্রাক্কালে মুহতাদ্দির নিকট ছিলাম, তাই আমি চলে
যেতে ইচ্ছা পোষণকরলে তিনি বলেন, বস, অতঃপর আমি বসলাম। তিনি আমাদের সালাত
পড়ালেন এবং আমাদের জন্য খাদ্য আনতে ডাকলেন। অতঃপর খাদ্য নিয়ে আসা হলো আর তাতে একটি পাত্রে শুধুমাত্র রুটি, লবণ, তেল ছাড়া আর কিছু ছিলনা। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমি
খাদ্য গ্রহণ করলাম। পাচক (বাবুর্চী) বলেন : আপনি কী সাঈম? আমি বললাম : হ্যাঁ। পাচক
(বাবুর্চী) বলেন : সুতরাং খান আর এখানে আপনি ছাড়া কেউ খাবে না।
পঞ্চম : রসণা সংযত রাখা (জিহ্বা সংরক্ষণ), ঘুম বা নিদ্রা হ্রাস ও মিথ্যার অপনোদনে সালাফদের অবস্থাঃ
১. অহেতুক কথা ও অষাঢ় বাক্যালাপ পরিহার করা, মিথ্যা কথা ও
সাক্ষ্য বর্জন করা :
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে
অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার
এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [সহীহ
বুখারী ১৯০৩, ৬০৫৭ (আ প্র) ১৭৬৮,
ই ফা) ১৭৭৯, তিরমিযী ৭০৭,
আবু দাঊদ ২৩৬২, ইবনু মাযাহ ১৬৮৯]।
২. মূর্খ আচরণ থেকে বিরত থাকা, কেউ গালি দিলে ও আহত করলে বলা ‘আমি সায়িম’
(রোযাদার) :
আবূ হরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন : ‘তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না
হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে
ঝগড়া করে, তাহলে
সে যেন বলে, আমি
একজন সায়িম। [বুখারী ১৮৯৪,
মুসলিম ১১৫১,
আহমাদ ৭৭৯৩ (আ প্র) ১৭৬৯,
(ই ফা) ১৭৮০]।
৩. আলী ইবনু আবি ত্বালিব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : সিয়াম শুধু খাদ্য ও
পাণীয় থেকে বিরত থাকা নয়, বরং মিথ্যা, অশ্লীলতা,
মূর্খ আচরণ থেকেও বিরত থাকা। [কিতাবুন সিয়াম, ইবনু
আবি শাইবানী]।
৪. ত্বলাক্ব ইবনু ক্বাইছ (রহ) বলেন, আবু যার (রা) বলেন : যখন তুমি সিয়াম পালন
করবে তখন, সাধ্যানুপাতে রসনা সংযত রাখবে। এজন্য ত্বলাক্ব ইবনু ক্বাইছ (রহ)
রামাদানে দিনের বেলায় সালাত ছাড়া ঘর থেকে বের হতেন না। [কিতাবুন সিয়াম, ইবনু আবি শাইবানী]।
৫. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন : যখন তুমি সিয়াম পালন
করবে তখন, তোমার কর্ণ (কান), দৃষ্টি (চোখ), রসনা (জিহ্বা) কে মিথ্যা, অশ্লীল, বলা
ও শ্রবণ করা বিরত থেকে এদেরকেও সিয়াম পালন করাও। [কিতাবুন
সিয়াম, ইবনু আবি শাইবানী ২/৪২২]।
৬. আত্বা (রহ) বলেন, আমি আবূ হুরাইরা (রা) থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন : যখন
তুমি সিয়াম পালন করবে তখন, মূর্খ আচরণ ও অশ্লীল বাক্যালাপ করনা। যদি তোমাকে আহত
করে তাহলে বলবে আমি রোযাদার। [আব্দুর রাজ্জাক,
আল-মুছান্নিফ]।
৭. মুজাহিদ (রহ) বলেন : দু’টি বিষয় যে সংরক্ষণ করবে সিয়াম তার জন্য উপকারী ও
নিরাপদ হবে ; গীবাহ (পরনিন্দা) ও মিথ্যা। [কিতাবুন সিয়াম,
ইবনু আবি শাইবানী]।
ষষ্ঠ : সময়ের
সঠিক ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে সালাফদের অবস্থাঃ
১. হাসান বসরী (রহ) বলেন : হে আদম সন্তান! তোমার জীবন ক্ষণিকের জন্য। কিছু সময়
অতিবাহিত হলে তোমার জীবন ধ্বংসের ধারপ্রান্তে উপণীত। রামাদানের দিনের বেলাটা তোমার
অতিথী। সুতরাং সাথে ভাল আচরণ কর। যদি তার সাথে ভাল আচরণ কর তাহলে কৃতজ্ঞতারস্বরূপ
ভাল ফলাফল হবে। আর যদি খারাপ আচরণ কর তাহলে কঠিন শাস্তির সম্মূখীন হবে।
২. হাসান বসরী (রহ) বলেন : দুনিয়াটা তিন দিনের। ‘গতকাল’ ; যা অতিবাহিত হয়েগেছে
তার আর ফেরত আসবে না। ‘আগামীকাল’ ; ভবিষ্যতের কোন জ্ঞান তোমার নেই। আর ‘আজ’ ; এটা
তোমার সুতরাং ভাল কর্ম কর।
৩. আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা) বলেন : আমি এমন কোন বিষয়ে অনুশোচিত হয়নি যে,
আজকের দিন সূর্য্য অস্তমিত হওয়ার পর যা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি তা তো আর ফেরত পাব না
অথচ না জানি কী কিরেছি?
৪. ইবনুল কায়্যিম (রহ) বলেন : সময়ের অপব্যয় ও অপচয় করা মৃত্যু যন্ত্রণা অপক্ষো
অধিকতর কঠিন। কেননা সময়ের অপব্যয় ও অপচয় তোমাকে আল্লাহ ও তোমার গৃহ জান্নাত থেকে
বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আর মৃত্যু তোমাকে দুনিয়া ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।
সপ্তম :
তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ
আবু বকর (রাঃ) আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় এক বান্দা। তার ঈমান, ইহসান, তাওয়াক্কুল, তাক্বওয়ার অবিশ্বাস্য সব ঘটনা পড়ে পৃথিবীর মানুষ আবেগাপ্লুত
হয়ে পড়ে। তিনি ছিলেন এমন একজন
আল্লাহর বান্দা যিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়ার পরও স্বলাতে দাড়িয়ে ছোট
বাচ্চার মত ঝর ঝর করে কাঁদতেন। এমন একজন মানুষকে রাসূল (সা) স্বলাতে একটি দু‘আ পাঠ করতে
বলেছিলেন যা আমরা স্বলাতের শেষ বৈঠকে পাঠ করি।
দু‘আটি হল : اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا
كَثِيرًا، وَلَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً
مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসি জুলমান
কাছীরাও ওয়ালা ইয়াগফুরুজজুনুবা ইল্লা আনতা ফাগফিরলী মাগফিরাতাম মিন ইংদিকা
ওয়ারহামনী ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহীম) অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আমার নাফসের উপর
বেশী জুলুম করেছি, আর তুমি ব্যতিত গুণাসমূহ কেউ ক্ষমা করতে পারেনা, সুতরাং তুমি তোমার নিজ গুণে আমাকে মার্জনা করে দাও এবং তুমি
আমার প্রতি রহম কর, তুমি তো মার্জনাকারী দয়ালু। [সহীহ বুখারী হা/নং
৮৩৪, সহীহ মুসলিম হা/নং ২৭০৫]।
চিন্তা করুন! আবু বকর (রাঃ) যিনি রাসূল (সঃ) এর পর উম্মাহর
শ্রেষ্ঠ একজন মুসলিম, যিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন তাকে
রাসূল (সঃ) শিখিয়েছেন "হে আল্লাহ! আমি আমার নাফসের উপর বেশী বেশী জুলুম
করেছি!" তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত? তাই এই রামাদান হোক নফসের গোলামী থেকে মুক্তির মাস। নিজের সাথে জুলুম আর আত্মপ্রতারণা বন্ধ করার
মাস। নিজেদেরকে সত্যিকার
অর্থে সালাফদের অনুসারি বানানোর মাস।
অষ্টম : ঘুমন্ত
বিবেককে জাগিয়ে তুলন এবং রামাদানের পবিত্রতা রক্ষার্থে সচেষ্ট হউনঃ
মাহে রমাদানের পবিত্রতা রক্ষা এবং তাক্বওয়া ভিত্তিক আত্ম-গঠন,
চরিত্র ও সমাজ গঠনের
প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে আমাদের সামনে আসছে পবিত্র
মাহে রমাদান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘এ মাসের প্রথম অংশ রহমতের,
মধ্যবর্তী অংশ মাগফিরাতের ও
শেষ অংশ নাজাতের।’
এ মাসের শেষ দশ দিনের মধ্যে
রয়েছে পবিত্র লাইলাতুল ক্বদর একটি বরকতময় রাত যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে একটি ফরজ কাজ আঞ্জাম দিলে অন্য মাসের ৭০টি ফরজ কাজের সমান সওয়াব পাওয়া
যায়; আর ১টি নফল
কাজের আঞ্জাম দিলে ১টি ফরজ কাজের সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। [হাদীসটি
দুর্বল] এ মাস সবর ও পরস্পরের প্রতি
সহানুভূতিশীলতার মাস। এ মাসটি পূর্ণ মর্যাদাসহকারে পরিপূর্ণ
আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করার প্রয়োজন।
পবিত্র এ রমাদান মাস কুরআন নাজিলের মাস। কুরআন মানবজাতির প্রতি আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। পবিত্র কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে কুরআনকে সঠিকভাবে জানা এবং সেই অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মাধ্যমেই সত্যিকার অর্থে পবিত্র রমাদান মাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব। কুরআন থেকে হেদায়াত লাভের জন্য যে মন-মানসিকতা ও চরিত্রের প্রয়োজন, সেই মন ও চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তায়ালা মাহে রমাদানের সিয়াম পালনকে আমাদের প্রতি ফরজ করেছেন। এক মাসব্যাপী সিয়াম পালনের মাধ্যমে সে লক্ষ্য অর্জনের বিকল্প নেই।
আল্লাহর বিধান না মানার কারণেই সমাজে বেহায়াপনা, ঘুষ, দুর্নীতি, শোষণ, জুলুম, নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন এবং মাদকাসক্তিসহ নৈতিক অবক্ষয় ব্যাপকভাবে বেড়েই
চলেছে। যে কারণে মানুষের উপর আল্লাহর গজব-আজাব আসছে। সকল পর্যায়ে আল্লাহর বিধান মেনে চললেই সমাজ থেকে সকল প্রকারের পাপাচার-অপরাধ
দূর হবে এবং আল্লাহর গজব-আজাব থেকে মানুষ রেহাই পাবে। রমাদানের পবিত্রতা রক্ষা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ,
অশ্লীলতা,
বেহায়াপনা ও নগ্নতা বন্ধ করার
দায়িত্ব প্রধানতঃ সরকারের। আমরা সরকারকে এ সব বন্ধের জন্য যথাযথ
পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। উপরন্তু দ্রব্যমূল্যের
ঊর্ধ্বগতি রোধ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয় সীমার মধ্যে নিয়ে
আসা এবং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করে মানুষের জান-মাল-ইজ্জতের
নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের
দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সিয়াম পালনকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয়
দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রেখে অধিক মুনাফা লাভের মানসিকতা
পরিহার করার জন্য ব্যবসায়ী মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এবং দেশ থেকে
জুলুম-নির্যাতনের অবসান, দেশের
জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমৃদ্ধির জন্য মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করছি।
নবম : উপসংহারঃ
হে আল্লাহ! হে অন্তরসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী! উপরোক্ত আলোচ্য ও
পঠিতব্য বিষয়ের উপর সকলকে ‘আমল করার তাওফীক্ব দান করুন। আমাদেরকে আপনার দ্বীনের
উপর অটল রাখুন। আমাদেরকে নফসের পূজা করা থেকে হেফাজত করুন। ইসলাম পালনের সাহায্য করুন। সঠিকভাবে সালাফদের
অনুসরণের মাধ্যমে সিয়াম অতিবাহিত করার তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।
No comments:
Post a Comment