Friday, 22 November 2019

মানুষ কি মাতৃগর্ভ থেকে কুরআন হিফয করে এবং অলী হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে?


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
মানুষ কি মাতৃগর্ভ থেকে কুরআন হিফয করে 
এবং অলী হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে?
আব্দুস সালাম হুসাইন আলী


০১. প্রারম্ভিকা ও প্রশ্ন :
মানুষ কি মাতৃগর্ভ থেকে কুরআন হিফয করে এবং অলী হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে? সমাজে কথিক রয়েছে যে, ‘আব্দুল কাদির জিলানী মাতৃগর্ভ থেকে ১৮ পারা কুরআন হিফয করে জন্মগ্রহণ করেছেনএ কথার আদৌ কি কোন ভিত্তি আছে-না অসাঢ়, মূখরোচ ভ্রান্ত মতবাদেই সিমাবদ্ধ? আসুন তাহলে ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে, কুরআন ও হাদীসের মানদন্ডে নিরূপণ করে বিস্তারিত জেনে নেই

০২. উত্তর :
উপরোক্ত কথিত কথাটি একটি ভ্রান্ত মতবাদইহা বিশ্বাস করা কুরআন ও হাদীস অস্বীকারের নামান্তরএ ধরণের ভ্রান্ত কথা ও মতবাদ থেকে আন্তরিক তাওবার মাধ্যমে ইসলামের সঠিক আকিদা পোষণ করতে হবে কেননা একথা চূলছেড়া গভীর বিশ্লেষণের দাবী রাখে যে, প্রত্যেক মানুষকে তার রবের প্রতি চারটি কারণে কৃতজ্ঞ থাকতে হবেযথা :
ক. অনস্তিত্বশীল জড়পদার্থ থেকে মানুষকে আল্লাহ অস্তিত্বশীল ভাষা ব্যবহারকারী উত্তম প্রাণীতে রূপান্তর করেছেন
খ. সর্বোত্তম অবয়ব ও গঠন প্রণালী দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সুনীপনতা ও কারুকার্যের মাধূরি দিয়ে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন
গ. অথর্ব, গর্দভ, বিকারগ্রস্থ, অকেজো, ব্রেইন না দিয়ে, পাগল-উন্মাদ না বানিয়ে সুস্থ্য-সুন্দর দেহ-মন, মেধা ও প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ বানিয়েছেন
ঘ. মহা প্রাচুর্য্যশীল, দৌলত সম্পন্ন ঈমান নামক মহাদৌলত ও নিয়ামত দিয়ে মুমিন বানিয়েছেন সুতরাং উপরোক্ত আকিদা পোষণের মাধ্যমে ঈমান হারা হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

০৩. তথ্য-প্রমাণ :
মহান আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এরশাদ কেরছেন :
﴿وَاللهُ أَخْرَجَكُم مِّنۢ بُطُونِ أُمَّهٰتِكُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ شَيْـًٔا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصٰرَ وَالْأَفْـِٔدَةَ ۙ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
আর আল্লাহ তোমাদেরকে নির্গত করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ হতে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতেনা, এবং তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং হৃদয়, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ [সূরা নাহল : ৭৮]।

০৪. তাফসীল ; ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ :
৪/১. তাফসীর আহসানুল বায়ান :
ক. আয়াতে شيئا অনির্দিষ্টঅর্থাৎ, তোমরা কিছুই জানতে নানা ভাল-মন্দ, আর না লাভ-নোকসান
খ. اَلسَّمْعَ যাতে কান দ্বারা তোমরা শব্দ শুনতে পারো, وَالْأَبْصٰرَ  চোখ দ্বারা সকল জিনিস দেখতে পারোوَالْأَفْـِٔدَةَ  আর অন্তর অর্থাৎ, জ্ঞান (কেননা অন্তর জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল) দান করেছেন, যাতে নানা জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে পারো, লাভ-ক্ষতি বুঝতে পারোমানুষ ধীরে ধীরে যত বড় হয়, তার জ্ঞান-বুদ্ধি ও শক্তি বাড়তে থাকেএমন কি যখন সে পূর্ণ বয়সে (পূর্ণ যৌবনে) পদার্পণ করে, তখন তার ঐ সকল শক্তিও পরিপূর্ণতা লাভ করে

গ.
تَشْكُرُونَ لَعَلَّكُمْ এই সকল শক্তি মহান আল্লাহ এই জন্য দান করেছেন, যাতে মানুষ এই সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনভাবে ব্যবহার করবে, যাতে আল্লাহ খুশি হনতা দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করবেএটিই হল আল্লাহর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতাহাদীসে কুদসীতে বর্ণিত, মহান আল্লাহ বলেন, "আমার বান্দা যে সব জিনিস দিয়ে আমার নৈকট্য লাভ করে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হল আমি যা তাদের উপর ফরয করেছিতাছাড়া নফল ইবাদত দ্বারাও সে আমার অধিক নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হয়পরিশেষে আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করিআর যখন আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করি, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শোনে, তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে, তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলেসে চাইলে তাকে দান করি, আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিই।" [বুখারীঃ কিতাবুর রিক্বাক]।

কিছু লোক এই হাদীসের ভুল অর্থ নিয়ে আল্লাহর অলীদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত শক্তির মালিক বলে মনে করেঅথচ হাদীসের স্পষ্ট অর্থ হল যে, যখন বান্দা আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে নিষ্ঠাবান হয়তখন তার প্রতিটি কর্ম আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকেসে তার কান দিয়ে ঐ কথাই শোনে, চোখ দিয়ে ঐ জিনিসই দেখে, যাতে আল্লাহর অনুমতি আছেযে জিনিস হাত দিয়ে ধরে বা যে পথে চলে, তা শরীয়ত সমর্থিতআল্লাহর অবাধ্যতায় তা ব্যবহার করে না; বরং তা একমাত্র তাঁর আনুগত্যে ব্যবহার করে

৪/২. তাফসীর যাকারিয়া :
অর্থাৎ এমন সব উপকরণ যার সাহায্যে তোমরা দুনিয়ার সব রকমের জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহ করে দুনিয়ার যাবতীয় কাজ কর্ম চালাবার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছোজন্মকালে মানব সন্তান যত বেশী অসহায় ও অজ্ঞ হয় এমনটি অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে হয় নাকিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উপকরণাদির (শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টিশক্তি, বিবেক ও চিন্তাশক্তি) সাহায্যেই সে উন্নতি লাভ করে পৃথিবীর সকল বস্তুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার এবং তাদের ওপর রাজত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করেআয়াতের শেষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার অর্থ, এগুলোকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিতে কাজে লাগানোসুতরাং আল্লাহর সন্তুষ্টি যাতে হয় তাই শুধু সে করবেএক হাদীসে এ ব্যাপারটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, “মহান আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার কোন অলীর সাথে শক্রতা পোষণ করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিলামআমার বান্দার উপর যা আমি ফরয করেছি তা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন প্রিয় বস্তু নেই যার মাধ্যমে সে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারেআমার বান্দা আমার কাছে নফল কাজসমূহ দ্বারা নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসিতারপর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে শুনে, তার দৃষ্টি শক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যার দ্বারা সে ধারণ করে আর তার পা হয়ে যাই যার দ্বারা সে চলেতখন আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা অবশ্যই দেব, আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে অবশ্যই উদ্ধার করব"[বুখারীঃ ৬৫০২]

হাদীসের অর্থ হচ্ছে, বান্দাহ যখন একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করে এবং যাবতীয় কাজ আল্লাহর জন্যই করে, তখন তার সমস্ত কর্মকাণ্ড একমাত্র আল্লাহর জন্য হয়ে যায়সে তখন এর বাইরে চলতে পারে নাসে যা শোনে তা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই শোনেযা দেখে তা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই দেখে, অর্থাৎ তার শরীআতের অনুমোদন ছাড়া কিছুই দেখে নাঅনুরূপভাবে তার যাবতীয় চলা-ফেরা, ধর-পাকড় কেবলমাত্র আল্লাহর আনুগত্য অনুসারে হয়তার সাহায্যেই অনুষ্ঠিত হয়আর যখন বান্দা এরকম হয়, তখন আল্লাহও তার ডাকে সাড়া দেনতার যাবতীয় কাজ সফল হতে থাকেবস্তুত: আল্লাহ্ তা'আলা বান্দার কাছে সবসময়ই চায় তার বান্দাগণ তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেঅন্য আয়াতেও সে কথা বর্ণনা করা হয়েছে

যেমন, “বলুন, তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তকরণতোমরা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবলুন, তিনিই যমীনে তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তারই কাছে তোমাদেরকে সমবেত করা হবে[সূরা আল-মুলকঃ ২৩-২৪] [ইবন কাসীর]

৪/. তাফসীর ফাতহুল মাজীদ :
ক. অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষকে মায়ের পেট থেকে এমন অবস্থায় বের করে আনেন যে, সে অবস্থায় তার কোন জ্ঞান থাকে নাকোনটা ভাল-মন্দ, কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক ইত্যাদি সম্পর্কে থাকে একেবারেই অজ্ঞকিন্তু সৃষ্টির সময় আল্লাহ তাআলা কান, চোখ ও অন্তর দিয়ে দিয়েছেন যাতে কান দ্বারা শোনে, চোখ দ্বারা দেখে এবং অন্তর দ্বারা উপলদ্ধি করে জ্ঞান অর্জন করতে পারেমানুষ যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখন তার সব কিছু বাড়তে থাকে এবং দৈহিক শক্তি ও জ্ঞানের পরিমাণও বাড়তে থাকে

আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿قُلْ هُوَ الَّذِيْٓ أَنْشَأَكُمْ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيْلًا مَّا تَشْكُرُوْنَ -‏ قُلْ هُوَ الَّذِيْ ذَرَأَكُمْ فِي الْأَرْضِ وَإِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ
বল: তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণতোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকবল: তিনিই পৃথিবীব্যাপী তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাঁরই কাছে তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে[সূরা মুলক ৬৭:২৩-২৪]।

৫. আয়াত ও হাদীস হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
ক. আল্লাহ তাআলা মানুষকে অস্তিত্বহীন থেকে সৃষ্টি করেছেন।
খ. জন্মগ্রহণের সময় কথিত কুরআন হিফয করে এবং অলী হয়ে জন্মগ্রহণ করা ভ্রান্ত মতবাদ।
গ. আল্লাহ তাআলার নিকট সকল কিছুর জ্ঞান রয়েছে

৬. উপসংহার :
প্রত্যেক মানুষকে তার রবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে ভিত্তিহীন, অসাঢ়, মূখরোচ ভ্রান্ত কথা, মতবাদ ও বিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক ধর্মবিশ্বাস তথা আকিদা পোষণ করতে হবে। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে চূলছেড়া গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে, কুরআন ও হাদীসের মানদন্ডে নিরূপণ করে আমল করতে হবে। আন্তরিকপূর্ণ তাওবার মাধ্যমে ইসলামের সু-শীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর পরিপূর্ণ অনুসরণ, অনুকরণের মাধ্যমে আমল করে জান্নাতি হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।

1 comment: