Friday, 13 December 2019

বিশ্বের মুসলিম মানবতা আজ কাঠগড়ায় ; আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও করণীয়ঃ

বিশ্বের মুসলিম মানবতা আজ কাঠগড়ায়
আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও করণীয়ঃ
আব্দুস সালাম হুসাইন আলী



বিশ্বের মুসলিম মানবতা আজ কাঠগড়ায়! 
হে আল্লাহ আপনি বিশ্বের মুসলিম মানবতার বিজয় অর্জনে হেগের আন্তর্জাতিক আদালত’-এ মামলা পরিচালনা ও নেতৃত্বদানকারীদ্বয় গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী জনাব আবু বকর ও অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মারি তামবাদুকে সাহয্য-সহযোগিতা, সফলতা দান করুন, আমীন

উল্লেখ্য যে, 
বিগত সময়ে মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের মুসলিম জনবসতি এলাকায় সুচি ও তার রুক্তপিপাসু সৈন্যরা সরণকালের, সর্ববৃহৎ লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক, মুসলিম নিধন, নির্যাতন এবং অত্যাচারের ষ্টীমরুলার চালিয়ে মুসলিম গণহত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তার প্রতিবাদ ও বিচারের জন্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালত’-এ মামলা পরিচালনা ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী জনাব আবু বকর ও অ্যাটর্নি জেনারেল মারি তামবাদু

প্রকাশ থাকে যে, 
গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী জনাব আবু বকর ও অ্যাটর্নি জেনারেল মারি তামবাদু দ্বয় পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খচিত ও লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবেন এবং দুই হীরক খন্ডে পরিণত হয়েছেন

হে বিশ্ববিবেক ও অলস মুসলিম নেতৃত্বদানকারী! 
আলস্যপূর্ণ নিদ্রা ত্যাগ করে নিজেদের অস্তিত্ব, মান-ইজ্জত, সম্মান-সম্ভ্রম, জান-মাল, গদি, পদ-পদবী টিকাতে কার্যকরী ও অগ্রণী ভূমিকা রাখুনউদারমনে কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার দরবারে ফরিয়াদ করুন

কেন এই মহতি উদ্যোগঃ
যেহেতু মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা কুরআনে এরশাদ করেছেন :
﴿تَعَاوَنُوْا عَلٰى الْبِرِّ وَالتَّقْوٰى وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلٰى الْإِثْمِ وَالْعُدْوٰنِ
সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিতে একে অন্যের সাহায্য করপাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না’। [সূরা মায়িদাহ : ০২]।

সেহেতু আমাদেরকে, 
এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং বিশ্বের সকল নির্যাতীত-নিপীড়িত মুসলিম ও মাজলুম মানবতার পাশে দাড়াতে হবে। যাতে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলার মহান এ আদেশ পালনের মাধ্যমে ইহ-লৌকিক ও পার-লৌকিকের সুখ-শান্তি, সাচ্ছন্দ্য-সমৃদ্ধি, সফলতা, মঙ্গল ও কল্যাণ সাধন সম্ভব হয়। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন, আমীন।

Thursday, 12 December 2019

সচেতন অভিভাবক হিসেবে সন্তান লালন-পালনে লুকমান (আঃ)-এর উপদেশঃ

সচেতন অভিভাবক হিসেবে 
সন্তান লালন-পালনে লুকমান (আঃ)-এর উপদেশঃ
আব্দুস সালাম হুসাইন আলী



০১. ভূমিকা :
প্রতিটি মুসলিম পিতার উচিত তার সন্তানকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যেভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবেলুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণ যোগ্য ও অত্যন্ত উপকারী যে, মহান আল্লাহ তাআলা তা কুরআনে করীমে উল্লেখ করে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মতের জন্য তিলাওয়াতের উপযোগী করে দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তের জন্য তা আদর্শ করে রেখেছেন

০২. লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেলেন তা নিম্নরূপ:
প্রথম উপদেশ :
﴿يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾
হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম [সূরা ‍লুক্বমান : ১৩]
এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমে তিনি তার ছেলেকে শিরক হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী হতে হবে কারণ, তাওহীদই হল, যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি তাই তিনি তার ছেলেকে প্রথমেই বলেন, আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা হতে বেচে থাক যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি এছাড়াও এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত

দ্বিতীয় উপদেশ :
﴿يٰبُنَىَّ إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِى صَخْرَةٍ أَوْ فِى السَّمٰوٰتِ أَوْ فِى الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ

হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন [সূরা লুক্বমান : ১৬]

লুকমান হাকীম তার ছেলেকে আল্লাহর বড়ত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন আল্লাহর জ্ঞান পরিপূর্ণ, সৃষ্টিজগতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্পর্কে তিনিই একমাত্র যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী তার ক্ষমতাও সকল সৃষ্টির উপর এবং প্রশ্নাতীত এই ক্ষমতার বাইরে কেউই যেতে পারেনা বা কেউ তাকে চ্যালেঞ্জও করতে পারেনা

তৃতীয় উপদেশ :
﴿يَا بُنَىَّ أَقِمِ الصَّلٰوةَ

হে বৎস! সালাত (নামায) কায়েম কর [সূরা লুক্বমান : ১৭]

লুকমান হাকীম তার সন্তানকে নিয়মিত যথাসময়ে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন সকল পিতা-মাতাই তার সন্তানদের শুধু কিভাবে নামাজ আদায় করতে হবে তাই নয় বরং কেন নামাজ আদায় করতে হবে, তার সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন নামাজের আরবি প্রতিশব্দ সালাহ’ (صلاة) শব্দটির মূল অর্থ সংযোগ নামাজের মাধ্যমে আমরা মূলত আল্লাহর সাথে আমাদের সংযোগ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখি নামাজের মাধ্যমে মূলত আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর আমাদের সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকি এবং নিজেদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করি

চতুর্থ উপদেশ :
﴿وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ

হে বৎস! সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর [সূরা লুক্বমান : ১৭]

সৎকাজের জন্য আদেশ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং মন্দকাজ করতে নিষেধ ও নিরুৎসাহিত করা নারী-পুরুষ, শাসক-শাসিত সকল মুসলমানের সাধারন দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানের তার সামর্থ্য অনুসারে এই দায়িত্ব পালন করা আবশ্যিক কর্তব্য

 

পঞ্চম উপদেশ :
﴿وَاصْبِرْ عَلٰى مَآ أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
 হে বৎস! আর বিপদাপদে সবর কর, নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ [সূরা লুক্বমান : ১৭]
লুকমান হাকীম তার ছেলেকে সকল প্রকার বিপদ-আপদে ধৈর্যধারনের জন্য বলেছেন আল্লাহর স্মরণ এবং জিকির ধৈর্যের চাবিকাঠি এবং ধৈর্য মানুষকে চিরন্তন সুখের আবাসস্থল জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় 

ষষ্ঠ উপদেশ :
﴿وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ
হে বৎস! অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না [সূরা লুক্বমান : ১৮]
কখনোই এমন আচরণ করবেন না, যেনো আপনি অন্যসকলের থেকে উত্তম মুসলমানের জন্য বিনয় আবশ্যিক চারিত্রিক গুণ বিনয়ের মাধ্যমে একজন মানুষ তার আশেপাশের সকল মানুষের কাছ থেকে সম্মান অর্জনের পাশাপাশি জান্নাতের জন্য নিজেকে গড়ে তুলে অপরদিকে অহংকারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মানুষের অশ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি নিজের পরিণতিকে জাহান্নামের জন্য তৈরি করে শয়তান মূলত তার অহংকারের কারনে মানুষকে সেজদা করতে অস্বীকার করেছে ফলে আল্লাহ তাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়ে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত করে দেন 

সপ্তম উপদেশ :

﴿وَلَا تَمْشِ فِى الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
হে বৎস! এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না [সূরা লুক্বমান : ১৮]
ঔদ্ধত্যের সাথে পৃথিবীতে চলাচল অহংকারের অপর এক ধরন এই বিষয়টি লুকমান হাকীম বিশেষ গুরুত্বের সাথে তার উপদেশে উল্লেখ করেছেন আল্লাহর চোখে সকল মানুষই সমান, তাদের মধ্যে পার্থক্যের একমাত্র বিষয় হল তাকওয়া রাসূল (সা.), তার সাহাবাগণ এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের মুসলমানদের জীবন পাঠ করলে আমরা বিনয় ও অহংকারহীনতার বিষয় সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি

অষ্টম উপদেশ :
﴿وَاقْصِدْ فِى مَشْيِكَ
হে বৎস! পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর [সূরা লুক্বমান : ১৯]
লুকমান হাকীম তার ছেলেকে পথে চলার সময় নম্রতার সাথে চলার জন্য উপদেশ দেন হাটার সময় অভদ্রের মত আঘাত করে করে হাটতে তিনি নিষেধ করেছেন এর মাধ্যমে মূলত তিনি বলতে চেয়েছেন, একজন মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হল নম্রতা ও বিনয় একজন মুমিনের আচরণের সকলক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বিনয়, ভদ্রতা ও ক্ষমার প্রকাশ ঘটবে

নবম উপদেশ :
﴿وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوٰتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

হেবৎস! আর তোমার কন্ঠস্বর নীচু কর নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর [সূরা লুক্বমান : ১৯]

সর্বশেষ লুকমান হাকীম তার ছেলেকে কথার সময় নিম্নস্বরে কথার উপদেশ দিয়েছেন উচ্চস্বরে, কর্কশ আওয়াজে কথাকে তিনি গাধার স্বরের সাথে তুলনা করেছেন উচ্চস্বরে, কর্কশ আওয়াজে কথা কারো হৃদয় জয় করতে পারেনা বরং তা মানুষকে আঘাত করে এবং বক্তার প্রতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে নিজের ছেলেকে দেওয়া লুকমান হাকীমের এই দশ উপদেশ যদি কোন পিতা-মাতা তার সন্তানদের অন্তরে গেঁথে দিতে পারে, তবে সন্তানকে পিতা-মাতা উত্তম পরিণতির পথে চলার জন্য তৈরি করে নিতে পারে

০৩. উপসংহার :
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সন্তানদেরকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গঠন করতে লুক্বমান (আঃ)-এর উপদেশ পালন করার তাওফীক দান করুন এবং একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে ইসলামের পরিপূর্ণ বিধান জানার ও মানার তাওফীক দান করুন, আমীন।

Wednesday, 11 December 2019

আদম ও হাওয়া (আঃ) দ্বয়ের তাওবাহ-ইস্তিগফার ; আমাদের শিক্ষা ও প্রয়োজনীয়তাঃ


আদম ও হাওয়া (আঃ) দ্বয়ের তাওবাহ-ইস্তিগফার ; 
আমাদের শিক্ষা ও প্রয়োজনীয়তাঃ
আব্দুস সালাম হুসাইন আলী


০১. ভূমিকাঃ
আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আ-লামী-ন। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালাম ‘আলা- সায়্যিদিল আম্বিয়াই ওয়াল মুরসালীন। ওয়া ‘আলা আ-লিহি ওয়া আসহা-বিহি আজমাঈন। আম্মা বা‘দ! পৃথিবীর মানুষ ভূল ও অপরাধ করবে এটাই স্বাভাবিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে সর্বোত্তম হলো ভূল ও অপরাধ হয়ে গেলে সাথে সাথে ক্ষমা চাওয়া, ভূল স্বীকার করা।

০২. নিম্নে পৃথিবীর সর্ব প্রথম মানব ও মানবী ‘আদম ও আদম ও হাওয়া (আঃ) দ্বয়ের তাওবাহ-ইস্তিগফার প্রসঙ্গে কুরআনের বাণী :
﴿قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾
‘তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের রাব্ব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব [সূরা আ‘রাফ : ২৩]।

০৩. তাফসীর / ব্যাখ্যাঃ
৩/১. তাফসীর আহসানুল বায়ান :
তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার এ হল সেই বাক্যসমূহ, যা আদম (আঃ) বরকতময় মহান আল্লাহর কাছ থেকে শেখেনযেমন সূরা বাক্বারার ৩৭ নং আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। (উক্ত আয়াতের টীকা দ্রঃ) শয়তান আল্লাহর অবাধ্যতা করল এবং তারপর সে কেবল এর উপর অটলই থাকেনি, বরং এটাকে বৈধ ও সাব্যস্ত করার জন্য জ্ঞান ও অনুমানভিত্তিক দলীলসমূহ পেশ করতে লাগলফলে সে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে বিতাড়িত এবং চিরদিনকার জন্য অভিশপ্ত গণ্য হলপক্ষান্তরে আদম (আঃ) স্বীয় ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রতি যত্নবান হলেনফলে তিনি আল্লাহর রহমত ও তাঁর ক্ষমা লাভের যোগ্য গণ্য হলেনএইভাবে দু'টি পথের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে গেলশয়তানের পথের এবং আল্লাহওয়ালাদের পথেরওপাপ করে অহংকার প্রদর্শন করা, তার উপর অটল থাকা এবং তাকে সঠিক সাব্যস্ত করার জন্য দলীলাদির স্তূপ খাড়া করা ইত্যাদি হল শয়তানী পথআর পাপ করার পর অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আল্লাহ-সমীপে নত হয়ে যাওয়া এবং তওবা ও ক্ষমা চাওয়ায় সচেষ্ট হওয়া ইত্যাদি হল আল্লাহর বান্দাদের পথ। হে আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। [তাফসীর আহসানুল বায়ান]।

৩/২. তাফসীর যাকারিয়া :
কাতাদা বলেন, তারা দুজন নিজেদের লজ্জাস্থান পরস্পর দেখতে পেত নাকিন্তু অপরাধের পর সেটা প্রকাশ হয়ে পড়লতখন আদম আলাইহিস সালাম বললেন, হে রব! যদি আমি তাওবা করি এবং ক্ষমা চাই তাহলে কি হবে আমাকে জানান? আল্লাহ বললেন, তাহলে আমি তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবোকিন্তু ইবলীস ক্ষমা চাইলো না, বরং সে অবকাশ চাইলফলে আল্লাহ প্রত্যেককে তার প্রার্থিত বিষয় দান করলেন[আত-তাফসীরুস সহীহ]

৩/৩. আয়াত সংশ্লিষ্ট কাহিনী ; এ কাহিনীটিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়ঃ
৩/৩/ক. লজ্জা মানুষের একটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক অনুভূতি
মানুষ নিজের শরীরের বিশেষ স্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে প্রকৃতিগতভাবে যে লজ্জা অনুভব করে সেটি ঐ স্বাভাবিক অনুভূতির প্রাথমিক প্রকাশকুরআন আমাদের জানায়, সভ্যতার ক্রমোন্নতির ফলে মানুষের মধ্যে কৃত্রিমভাবে এ লজ্জার সৃষ্টি হয়নি বা এটি বাইরের থেকে অর্জিত কোন জিনিসও নয়, যেমন শয়তানের কোন কোন সুচতুর শিষ্য ও অনুসারী অনুমান করে থাকে বরং জন্মের প্রথম দিন থেকেই এ প্রকৃতিগত গুণটি মানুষের মধ্যে রয়েছে

৩/৩/খ. নগ্নতা, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা ও যৌনতার পথে পরিচালিত করা :
মানুষকে তার স্বভাবসূলভ সোজা-সরল পথ থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে শয়তানের প্রথম কৌশলটি ছিল তার এ লজ্জার অনুভূতিতে আঘাত করা, উলংগতার পথ দিয়ে তার জন্যে নির্লজ্জতা ও অশ্লিলতার দরজা খুলে দেয়া এবং যৌন বিষয়ে তাকে খারাপ পথে পরিচালিত করাঅন্য কথায় বলা যায় , প্রতিপেক্ষের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্যে তার যে, দুর্বলতম স্থানটিকে সে বেছে নিয়েছিল সেই ছিল তার জীবনের যৌন বিষয়ক দিক যে লজ্জাকে মানবীয় প্রকৃতির দুর্গরক্ষক হিসেবে মহান আল্লাহ নিযুক্ত করেছিলেন তারই ওপর এনেছে সে প্রথম আঘাতটি শয়তান ও তার শিষ্যবর্গের এ কর্মনীতি আজো অপরিবর্তিত রয়েছেমেয়েদেরকে উলংগ করে প্রকাশ্য বাজারে না দাঁড় করানো পর্যন্ত তাদের প্রগতির কোন কার্যক্রম শুরুই হতে পারে না

৩/৩/গ. অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করে :
অসৎকাজ করার প্রকাশ্য আহবানকে মানুষ খুব কমই গ্রহণ করে, এটিও মানুষের স্বভাবসূলভ প্রবণতাসাধারণত তাকে নিজের জালে আবব্ধ করার জন্যে তাই প্রত্যেক অসৎকর্মের আহকায়ককে কল্যাণকামীর ছদ্মবেশে আসতে হয়

৩/৩/ঘ. মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিলাশী জীবন লাভের আকাংখা :
মানুষের মধ্যে উচ্চতর বিষয়াবলী যেমন মানবিক পর্যায় থেকে উন্নতি করে উচ্চতর মার্গে পৌছার বা চিরন্তন জীবনলাভের স্বাভাবিক আকাংকা থাকে আর শয়তান তাকে ধোঁকা দেবার ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য অর্জন করে এ পথেইসে মানুষের এ আকাংখাটির কাছে আবেদন জানায়শয়তানের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হচ্ছে , সে মানুষের সামনে তাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়ার এবং বর্তমান অবস্থা থেকে উন্নতর অবস্থায় পৌছিয়ে দেবার টোপ ফেলে, তারপর তাকে এমন পথের সন্ধান দেয় , যা তাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যায়

৩/৩/ঙ. মানবীয় সাধারণ ধারণার খন্ডন :
সাধারণভাবে একথাটির প্রচলিত হয়ে গেছে যে, শয়তান প্রথমে হাওয়া (আ.)-কে তার প্রতারণা জালে আবদ্ধ করে, তারপর আদম (আ.)-কে জালে আটকাবার জন্যে তাকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করেকিন্তু কুরআন এ ধারণা খণ্ডন করেকুরআনের বক্তব্য হচ্ছে, শয়তান তাদের উভয়কেই ধোঁকা দেয় এবং তারা উভয়েই শয়তানের ধোঁকায় বিভ্রান্ত হয়আপাতদৃষ্টিতে এটা একটি মামুলী কথা বলে মনে হয়কিন্তু যারা জানেন, হযরত হওয়া সম্পর্কিত এ সাধারন্যে প্রচলিত বক্তব্যটি সারা দুনিয়ায় নারীর নৈতিক সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা হ্রাস করার ক্ষেত্রে কত বড় ভূমিকা পালন করেছে একমাত্র তারাই কুরআনের এ বর্ণনার যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন

৩/৩/চ. নিষিদ্ধবৃক্ষের ফল ও যৌক্তিকতা :
এরূপ ধারণা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই যে, নিষিদ্ধ গাছের এমন কোন বিশেষ গুণ ছিল, যে কারণে তার ফল মুখ দেবার সাথে সাথেই হযরত আদম ও হাওয়ার লজ্জাস্থান অনাবৃত হয়ে গিয়েছিলআসলে এটি কেবল আল্লাহর নাফরমানিরই ফলশ্রুতি ছিলআল্লাহ ইতিপূর্বে নিজের ব্যবস্থাপনায় তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করেছিলেনতারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করার সাথে সাথেই তিনি তাদের ওপর থেকে নিজের হেফাজত ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে নিয়েছিলেন, তাদের আবরণ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেনতারা যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে নিজেদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ব্যবস্থা করুকএ কাজের দায়িত্ব তাদের নিজেদের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেনআর যদি তারা প্রয়োজন মনে না করে অথবা এ জন্যে প্রচেষ্টা না চালায় তাহলে তারা যেভাবেই বিচরণ করুক না কেন, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় নাএভাবে যেন চিরকালের জন্যে এ সত্যটি প্রকাশ করে দেয়া হলো যে, মানুষ আল্লাহর নাফরমানী করলে একদিন না একদিন তার আবরণ উন্মুক্ত হয়ে যাবেই এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর সাহায্য -সহযোগিতা ততদিন থাকবে যতদিন সে থাকবে আল্লাহর হুকুমের অনুগতআনুগত্যের সীমানার বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে নাবরং তখন তাকে তার নিজের হাতেই সঁপে দেয়া হবেবিভিন্ন হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এবংএ সম্পর্কে তিনি দোয়া করেছেন ‘‘"হে আল্লাহ! আমি তোমার রহমতের আশা করিকাজেই এক মুহুর্তের জন্যেও আমাকে আমার নিজের হাতে সোপর্দ করে দিয়ো না"

৩/৩/ছ. মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিরোধিতায় শয়তানের অবস্থান :
শয়তান একথা প্রমাণ করতে চাচ্ছিল যে, তার মোকাবিলায় মানুষকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে সে তার যোগ্য নয়কিন্তু প্রথম মোকাবিলায় সে পরিজিত হলোসন্দেহ নেই, এ মোকাবিলায় মানুষ তার রবের নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে পূর্ণ সফলকাম হতে পারেনি এবং তার এ দুর্বলতাটিও প্রকাশ হয়ে পড়লো যে, তার পক্ষে নিজের প্রতিপক্ষের প্রতারণা জালে আবদ্ধ হয়ে তার আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া সম্ভবকিন্তু এ প্রথম মোকাবিলায় একথাও চূড়ান্ত ভাবে প্রমানিত হয়ে গেছে যে, মানুষ তার নৈতিক মর্যাদার দিক দিয়ে একটি উন্নত ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিপ্রথমত শয়তান নিজেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার ছিলআর মানুষ নিজে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করেনি রবং শ্রেষ্ঠত্ব তাকে দান করা হয়েছে দ্বিতীয়ত শয়তান নির্জলা অহংকার ও আত্মাম্ভরিতার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেঅন্যদিকে মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেনিবরং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে এতে প্রবৃত্ত হয়অসৎকাজের প্রকাশ্য আহবানে সে সাড়া দেয়নিবরং অসৎকাজের আহবায়ককে সৎকাজের আহবায়ক সেজে তার সামনে আসতে হয়েছিলসে নীচের দিকে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিয়ে নীচের দিকে যায়নি বরং এ পথটি তাকে উপরের দিকে নিয়ে যাবে এ ধোকায় পড়ে সে নীচের দিকে যায়তৃতীয়ত শয়তানকে সতর্ক করার পর সে নিজের ভুল স্বীকার করে বন্দেগীর দিকে ফিরে আসার পরিবর্তে নাফরমানীর ওপর আরো বেশী অবিচল হয়ে যায়অন্যদিকে মানুষকে তার ভূলের ব্যাপারে সতর্ক করে দেবার পর সে শয়তানের মত বিদ্রোহ করেনি বরং নিজের ভূল বুঝতে পারার সাথে সাথেই লজ্জিত হয়ে পড়েনিজের ত্রুটি স্বীকার করে, বিদ্রোহ থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের রবের রহমতের ছত্রছায়ায় আশ্রয় খুঁজতে থাকে

৩/৩/জ. মানবপথ ও শয়তানের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন :
এভাবে শয়তানের পথ ও মানুষের উপযোগী পথ দুটি পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়আল্লাহর বন্দেগী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁর মোকাবিলায় বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করা , সতর্ক করে দেয়া সত্ত্বেও সগর্বে নিজের বিদ্রোহাত্মক কর্মপদ্ধতির ওপর অটল হয়ে থাকা এবং যারা আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলে তাদেরকেও বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করে গোনাহ ও নাফরমানীর পথে টেনে আনার চেষ্টা করাই হচ্ছে নির্ভেজাল শয়তানের পথ বিপরীত পক্ষে মানুষের উপযোগী পথটি হচ্ছেঃ প্রথমত শয়তানের প্ররোচান ও অপহরণ প্রচেষ্টার মোকাবিলা করতে হবেতার এ প্রচেষ্টায় বাধা দিতে হবেনিজের শত্রুর চাল ও কৌশল বুঝাতে হবে এবং তার হাতে থেকে বাচার জন্যে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে কিন্তু এরপর যদি কখনো তার পা বন্দেগী ও আনুগত্যের পথ থেকে সরেও যায় তাহলে নিজের ভূল উপলব্ধি করার সাথে সাথেই লজ্জায় অধোবদন হয়ে তাকে নিজের রবের দিকে ফিরে আসতে হবে এবং নিজের অপরাধ ও ভুলের প্রতিকার ও সংশোধন করতে হবেএ কাহিনী থেকে মহান আল্লাহ এ মৌল শিক্ষাটিই দিতে চানএখানে মানুষের মনে তিনি একথাগুলো বদ্ধমূল করে দিতে চান যে, তোমরা যে পথে চলছো সেটি শয়তানের পথএভাবে আল্লাহর হেদায়াতের পরোয়া না করে জিন ও মানুষের মধ্যকার শয়তানদেরকে নিজেদের বন্ধু ও অভিভাবকে পরিণত করা এবং ক্রমাগত সতর্ক বাণী উচ্চারণ করার পরও তোমাদের এভাবে নিজেদের ভুলের ওপর অবিচল থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া মূলত নির্ভেজাল শয়তানী কর্মনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়তোমরা নিজেদের আদি ও চিরন্তন দুশমনের ফাঁদে আটকা পড়ছোএবং তার কাছে পূর্ণ পরাজয় বরণ করছোশয়তান যে পরিণতির মুখোমুখি হতে চলেছে, তোমাদের এ বিভ্রান্তির পরিণামও তাই হবেযদি তোমরা সত্যিই নিজেরা নিজেদের শত্রু না হয়ে গিয়ে থাকো এবং তোমাদের মধ্যে সামান্যতম চেতনাও থেকে থাকে, তাহলে তোমরা নিজেদের ভুল শুধরিয়ে নাও, সতর্ক হয়ে যাও এবং তোমাদের বাপ আদম ও মা হাওয়া পরিশেষে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তোমরাও সেই একই পথ অবলম্বন করো

০৪. আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
ক. শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু, তার প্রতিশ্রতি মিথ্যা, সে ধোঁকা দিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে চায়, তাই তার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে
খ. শয়তানের চক্রান্তে পড়ে অন্যায় করলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবাহ করা উচিত, এটাই আদম (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্যআর তাওবাহ না করে অপরাধে অটল থাকা শয়তানের কাজ

০৫. উপসংহারঃ
জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদেরকে নবীদের পথ অনুসরণ করতে হবে। অপরাধ, ভুল ও গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাওবাহ করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত বিষয়ের উপর আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।