সচেতন অভিভাবক হিসেবে
০১. ভূমিকা :
প্রতিটি মুসলিম পিতার উচিত তার সন্তানকে
ইসলামের মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা। লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যেভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন তা থেকে
আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা এতই সুন্দর ও গ্রহণ যোগ্য ও অত্যন্ত উপকারী যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তা কুরআনে করীমে উল্লেখ করে কিয়ামত পর্যন্ত
অনাগত উম্মতের জন্য তিলাওয়াতের উপযোগী করে দিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্তের জন্য তা
আদর্শ করে রেখেছেন।
০২. লুকমান (আঃ) তার ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেলেন তা নিম্নরূপ:
প্রথম উপদেশ :
﴿يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ﴾
‘হে বৎস! আল্লাহর সাথে শিরক করো না, নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলুম’। [সূরা লুক্বমান : ১৩]।
এখানে লক্ষণীয় যে, প্রথমে তিনি তার ছেলেকে শিরক হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। একজন সন্তান তাকে অবশ্যই জীবনের শুরু থেকেই আল্লাহর তাওহীদে
বিশ্বাসী হতে হবে। কারণ, তাওহীদই হল, যাবতীয় কর্মকাণ্ডের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতার একমাত্র মাপকাঠি। তাই তিনি তার ছেলেকে
প্রথমেই বলেন, আল্লাহর সাথে ইবাদতে কাউকে শরিক করা হতে বেচে থাক। যেমন, মৃত ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করা অথবা অনুপস্থিত ও অক্ষম লোকের নিকট সাহায্য
চাওয়া বা প্রার্থনা করা ইত্যাদি। এছাড়াও এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয় উপদেশ :
﴿يٰبُنَىَّ إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَكُن فِى صَخْرَةٍ أَوْ فِى السَّمٰوٰتِ أَوْ فِى الْأَرْضِ يَأْتِ بِهَا اللَّهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٌ﴾
“হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা
পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন’। [সূরা লুক্বমান : ১৬]।
লুকমান হাকীম তার ছেলেকে আল্লাহর বড়ত্ব ও
ক্ষমতা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহর জ্ঞান পরিপূর্ণ, সৃষ্টিজগতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্পর্কে তিনিই একমাত্র যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী। তার ক্ষমতাও সকল
সৃষ্টির উপর এবং প্রশ্নাতীত। এই ক্ষমতার বাইরে কেউই যেতে পারেনা বা কেউ তাকে চ্যালেঞ্জও
করতে পারেনা।
তৃতীয় উপদেশ :
﴿يَا بُنَىَّ أَقِمِ الصَّلٰوةَ﴾
‘হে বৎস! সালাত (নামায) কায়েম কর’। [সূরা লুক্বমান : ১৭]।
লুকমান হাকীম তার সন্তানকে নিয়মিত যথাসময়ে
নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। সকল পিতা-মাতাই তার সন্তানদের শুধু কিভাবে নামাজ আদায় করতে
হবে তাই নয় বরং কেন নামাজ আদায় করতে হবে, তার সম্পর্কেও শিক্ষা দেওয়া
প্রয়োজন। নামাজের আরবি
প্রতিশব্দ ‘সালাহ’ (صلاة) শব্দটির মূল অর্থ সংযোগ। নামাজের মাধ্যমে আমরা মূলত আল্লাহর সাথে আমাদের সংযোগ
প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখি। নামাজের মাধ্যমে মূলত আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর আমাদের সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য
সম্পর্কে সচেতন থাকি এবং নিজেদেরকে গুনাহ থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করি।
চতুর্থ উপদেশ :
﴿وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ﴾
‘হে বৎস! সৎকাজে আদেশ দাও, মন্দকাজে নিষেধ কর’। [সূরা লুক্বমান : ১৭]।
সৎকাজের জন্য আদেশ ও অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং
মন্দকাজ করতে নিষেধ ও নিরুৎসাহিত করা নারী-পুরুষ, শাসক-শাসিত সকল
মুসলমানের সাধারন দায়িত্ব। প্রত্যেক মুসলমানের তার সামর্থ্য অনুসারে এই দায়িত্ব পালন
করা আবশ্যিক কর্তব্য।
পঞ্চম উপদেশ :
﴿وَاصْبِرْ عَلٰى مَآ أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ﴾
‘হে বৎস! আর বিপদাপদে সবর কর, নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ’। [সূরা লুক্বমান : ১৭]।
লুকমান হাকীম তার ছেলেকে সকল প্রকার বিপদ-আপদে
ধৈর্যধারনের জন্য বলেছেন। আল্লাহর স্মরণ এবং জিকির ধৈর্যের চাবিকাঠি এবং ধৈর্য মানুষকে চিরন্তন সুখের
আবাসস্থল জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।
ষষ্ঠ উপদেশ :
﴿وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ﴾
‘হে বৎস! অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না’। [সূরা লুক্বমান : ১৮]।
কখনোই এমন আচরণ করবেন না, যেনো আপনি অন্যসকলের থেকে উত্তম। মুসলমানের জন্য বিনয় আবশ্যিক চারিত্রিক গুণ। বিনয়ের মাধ্যমে একজন
মানুষ তার আশেপাশের সকল মানুষের কাছ থেকে সম্মান অর্জনের পাশাপাশি জান্নাতের জন্য
নিজেকে গড়ে তুলে। অপরদিকে অহংকারের
মাধ্যমে একজন ব্যক্তি মানুষের অশ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি নিজের
পরিণতিকে জাহান্নামের জন্য তৈরি করে। শয়তান মূলত তার অহংকারের কারনে মানুষকে সেজদা করতে অস্বীকার
করেছে। ফলে আল্লাহ
তাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়ে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত করে দেন।
সপ্তম উপদেশ :
﴿وَلَا تَمْشِ فِى الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ﴾
‘হে বৎস! এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে
পছন্দ করেন না’। [সূরা লুক্বমান : ১৮]।
ঔদ্ধত্যের সাথে পৃথিবীতে চলাচল অহংকারের অপর এক
ধরন। এই বিষয়টি
লুকমান হাকীম বিশেষ গুরুত্বের সাথে তার উপদেশে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর চোখে সকল মানুষই সমান, তাদের মধ্যে পার্থক্যের একমাত্র বিষয় হল তাকওয়া। রাসূল (সা.), তার সাহাবাগণ এবং পূর্ববর্তী
প্রজন্মের মুসলমানদের জীবন পাঠ করলে আমরা বিনয় ও অহংকারহীনতার বিষয় সম্পর্কে
শিক্ষাগ্রহণ করতে পারি।
অষ্টম উপদেশ :
﴿وَاقْصِدْ فِى مَشْيِكَ﴾
‘হে বৎস! পদচারণায়
মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর’। [সূরা লুক্বমান : ১৯]।
লুকমান হাকীম তার ছেলেকে পথে চলার সময় নম্রতার
সাথে চলার জন্য উপদেশ দেন। হাটার সময় অভদ্রের মত আঘাত করে করে হাটতে তিনি নিষেধ করেছেন। এর মাধ্যমে মূলত তিনি
বলতে চেয়েছেন, একজন মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হল নম্রতা ও বিনয়। একজন মুমিনের আচরণের
সকলক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বিনয়, ভদ্রতা ও ক্ষমার প্রকাশ ঘটবে।
নবম উপদেশ :
﴿وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوٰتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ﴾
‘হেবৎস! আর তোমার কন্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর’। [সূরা লুক্বমান : ১৯]।
সর্বশেষ লুকমান হাকীম তার ছেলেকে কথার সময়
নিম্নস্বরে কথার উপদেশ দিয়েছেন। উচ্চস্বরে, কর্কশ আওয়াজে কথাকে তিনি গাধার স্বরের সাথে তুলনা করেছেন। উচ্চস্বরে, কর্কশ আওয়াজে কথা কারো হৃদয় জয় করতে পারেনা বরং তা মানুষকে আঘাত করে এবং
বক্তার প্রতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। নিজের ছেলেকে দেওয়া লুকমান হাকীমের এই দশ উপদেশ যদি কোন
পিতা-মাতা তার সন্তানদের অন্তরে গেঁথে দিতে পারে, তবে সন্তানকে
পিতা-মাতা উত্তম পরিণতির পথে চলার জন্য তৈরি করে নিতে পারে।
০৩. উপসংহার :
আল্লাহ
সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সন্তানদেরকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গঠন করতে লুক্বমান
(আঃ)-এর উপদেশ পালন করার তাওফীক দান করুন এবং একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে ইসলামের
পরিপূর্ণ বিধান জানার ও মানার তাওফীক দান করুন, আমীন।
No comments:
Post a Comment