Friday, 1 March 2019

জুম‘আর ফযিলত-গুরুত্ব, সুন্নত ও আদব সমূহঃ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
জুম‘আর ফযিলত-গুরুত্ব, সুন্নতআদব সমূহঃ
আব্দুস সালাম হুসাইন আলী *

১. অবতরণিকাঃ
জুমআর দিন মুসলিমদের সাপ্তাহিক মিলনমেলা ও সমাবেশের দিনতাই এই দিনকে "ইয়াওমুল জুমআ' জুমআর দিন বলা হয়আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ বরকত, মর্যাদা ও মহিমান্বিতপূর্ণ দিন হলো জুমআর দিন। এই দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য অলৌকিক ও ঐতিহাসিক ঘটনামহামহিম স্রষ্টা আল কুরআনে জুমানামে স্বতন্ত্র একটি সূরা নাজিল করে দিবসটিকে আরও মহিমান্বিত করেছেন। মহিমান্বিত ও পুণ্যময় এই দিনটি মুমিনের জন্য সওয়াব বৃদ্ধি, কৃত গুণাহ মোচন, দয়াময় স্রষ্টার নৈকট্য লাভের বিশেষ অফার ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে প্রতি সপ্তাহে আমাদের মাঝে ফিরে আসে ।

২. জুমআর দিনের ফযিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
জুমআর দিনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যথা :
ক. আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল ও সমস্ত জগৎকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেনএই ছয়দিনের শেষদিন ছিল জুম'আর দিন।’ [মুসলিম : ২৭৮৯]।
খ. যে দিনগুলোতে সূৰ্য উদিত হয় তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিন হচ্ছে, জুমআর দিনএই দিনেই আদম (আ.) সৃজিত হন, এই দিনেই তাকে জান্নাতে দাখিল করা হয় এবং এই দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়আর কেয়ামত এই দিনেই সংঘটিত হবে[মুসলিম : ৮৫৪, আবু দাউদ ৯৬১, তিরমিজী ৪৮৮]।
গ. জুমআর দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে মানুষ যে দুআই করে, তাই কবুল হয়’। [বুখারী : ১৯৩৫, মুসলিম : ৮৫২]
ঘ. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিতরসুল (সা.) এরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে, অতঃপর জুমার নামাজের জন্য মসজিদে আসে, খুব মনোযোগসহ খুতবা শোনে এবং খুতবার সময় চুপ থাকে, তার এই জুমা থেকে বিগত জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের গুনা মাফ করে দেওয়া হয়’ [মুসলিম]
ঙ. আল্লাহ তায়ালা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতির সমাবেশ ও ঈদের জন্যে এই দিন রেখেছিলেনকিন্তু পূৰ্ববতীর্ণ উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়ইয়াহুদীরা "ইয়াওমুস সাব্‌ততথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন নির্ধারিত করে নেয় এবং নাসারারা রবিবারকেআল্লাহ তায়ালা এই উম্মতকে তওফীক দিয়েছেন যে, তারা শুক্রবারকে মনোনীত করেছেঅন্য হাদীসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন : ‘আমরা সবশেষে এসেও কিয়ামতের দিন অগ্রণী হবআমরাই প্রথম জান্নাতে প্ৰবেশ করবযদিও তাদেরকে আমাদের আগে কিতাব দেওয়া হয়েছিল, আর আমাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের পরেকিন্তু তারা এতে মতভেদে লিপ্ত হয়েছেঅতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পথ দিয়েছেনএই যে দিনটি, তারা এতে মতভেদ করেছেঅতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে এ দিনের সঠিক হেদায়াত করেছেনতা হলো, জুম'আর দিনসুতরাং আজ আমাদের, কাল ইয়াহুদীদেরআর পরশু নাসারাদের[বুখারী : ৮৭৬, মুসলিম : ৮৫৫]

৩. জুমআ অর্থ এবং জুমআর নামকরণঃ
অর্থ : يَوْمُ الْجُمْعَة (ইয়াওমুল জুমআ) দুটি শব্দের সমন্বয়ে যৌগিক একটি বাক্য। তথা يَوْمٌ (ইয়াওমুন) অর্থ দিন / দিবস। আর جُمْعَةٌ (জুমআ) অর্থ একত্রিত করা। সুতরা উভয় শব্দের সমন্বয়ে يَوْمُ الْجُمْعَة (ইয়াওমুল জুমআ) অর্থ হলো একত্রিত করার বা সমন্বয় করার বা সমাবশের দিন।

নামকরণ : মূর্খতাযুগে শুক্রবারকে "ইয়াওমে আরূবাবলা হতবলা হয়ে থাকে যে, আরবে কা'ব ইবনে লুয়াই সর্বপ্রথম এর নাম "ইয়াওমুল জুমুআরাখেনকারণ, জুম'আ শব্দটির অর্থ একত্রিত করাএই দিনে কুরাইশদের সমাবেশ হত এবং কাব ইবনে লুয়াই ভাষণ দিতেনসারকথা এই যে, ইসলাম পূর্বকালেও কব ইবনে লুয়াই-এর আমলে শুক্রবার দিনকে গুরুত্ব দান করা হততিনিই এই দিনের নাম জুমআর দিন রেখেছিলেনকিন্তু সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় যে, ‘আদম (আ.)-এর সৃষ্টিকে এই দিন একত্রিত করা হয়েছিল বলেই এই দিনকে জুম'আ নামকরণ করা হয়েছে ‘। [মুস্তাদরাকে হাকিম : ১০২৮, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ১৭৩২, ত্বাবরানী, মুজামুল কাবীর ৬০৯২, মুজামুল আওসাত্ব ৮২১, মাজমাউয যাওয়ায়িদ : ২/৩৯০]

৪. যেভাবে সূচিত হলো জুমার দিনঃ
প্রথম হিজরি সনরাসুল (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেন। রাসুল (সা.)-এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেনএটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজতবে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় আরো পরেরাসুল (সা.)-এর মদিনায় যাওয়ার পর এবং জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার আগে একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেনতারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যে দিনে তারা সবাই একত্র হয়নাসারারাও সপ্তাহে একদিন একত্র হয়সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, নামাজ আদায় করবঅতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসারাদের জন্য নির্ধারিতঅবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এদিনকে জুমার দিন নামকরণ করলেন[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (পৃথিবীর আদি-অন্ত ইতিহাস), সীরাত মুস্তাফা, উইকিপিডিয়া]।

৫. জুমআর দিনের আমল (কর্ম) সমূহঃ
জুমার দিনের সর্বাধিক গুরুত্ব, বরকতময়, কল্যাণময়, মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ আমল (কর্ম) হলো খুতবা (জুমরা পূর্ব আলোচনা / ভাষণ / বক্তব্য) শ্রবণ করা এবং জুমার সালাত / নামাজ আদায় করা। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন :
﴿يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا إِذَا نُوْدِىَ لِلصَّلٰوةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلٰى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
‘হে মুমিনগণ! জুমআর দিনে যখন সালাতের / নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর স্মরণের দিকে শীঘ্র ধাবিত হও, ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে! [সূরা জুমআ : ৯]

ব্যাখ্যা :
ক. نُوْدِىَ (নূদিয়া) শব্দের অর্থ : যখন ডাকা হয়এখানে খুতবা-এর আযান বোঝানো হয়েছে[ফাতহুল কাদীর, বাগভী]।

খ. জুমআর আযানের সংখ্যা নিরূপণ :
সায়েব ইবনে ইয়াযীদ বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর যুগ, আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.)-এর যুগে জুমআর দিনে ইমাম যখন মিম্বরে বসত তখন প্রথম আযান দেওয়া হততারপর যখন উসমান (রা.)এর যুগ আসল এবং মানুষ বেড়ে গেল তখন দ্বিতীয়ি আযানটি তিনি বাড়িয়ে দেন’। [বুখারী : ৯১২]।

গ. فاسْعَوْا (ফাসআও) শব্দের এক অর্থ :
আয়াতে বর্ণিত فاسْعَوْا শব্দের এক অর্থ দৌঁড়ানো এবং অপর অর্থে কোন কাজ গুরুত্ব সহকারে করাএখানে এই অর্থ উদ্দেশ্যকারণ, সালাতের জন্যে দৌড়ে আসতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেনতিনি বলেছেন : ‘প্রশাস্তি ও গাম্ভীৰ্য সহকারে সালাতের জন্যে গমন কর’। [বুখারী : ৬৩৬, মুসলিম : ৬০২]।

ঘ. আয়াতের অর্থ :
এই যে, জুমআর দিনে জুমআর আযান দেওয়া হলে আল্লাহর যিকিরের দিকে গুরুত্বসহকারে যাওঅর্থাৎ সালাত ও খুতবার জন্যে মসজিদে যেতে যত্নবান হওযে ব্যক্তি দৌঁড় দেয়, সে যেমন অন্য কোন কাজের প্রতি মনোযোগ দেয় না, তোমরাও তেমনি আযানের পর সালাত ও খুতবা ব্যতীত অন্য কাজের দিকে মনোযোগ দিও নাএখানে ذِكْرٌ (যিকর) বলে জুম'আর সালাত এবং এই সালাতের অন্যতম শর্ত খুতবাও বোঝানো হয়েছে

ঙ. বহু হাদীসে জুম'আর দিনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মসজিদে হাযির হওয়ার প্রতি গুরুত্বারূপ করা হয়েছে। যথা :
রাসুল (সা.) বলেন : ‘যে জুমআর দিনে জানাবত তথা অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার মত গোসল করবে, তারপর (প্রথম ঘণ্টায়) মসজিদে হাজির হবে সে যেন একটি উট কুরবানী করলআর যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেল সে যেন গরু কুরবানী করলযে তৃতীয় ঘন্টায় গেল সে যেন শিংওয়ালা ছাগল কুরবানী করলযে চতুর্থ ঘন্টায় গেল সে যেন মুরগী উৎসর্গ করলযে পঞ্চম ঘন্টায় গেল সে যেন ডিম উৎসর্গ করলতারপর যখন ইমাম বের হয়ে যায় তখন ফেরেশতারা (লিখা বন্ধ করে) ইমামের কাছে হাযির হয়ে যিকর (খুতবা) শুনতে থাকে’। [বুখারী : ৮৮১]।

চ. জুমআর দিনে দুআ কবুলের বিশেষ সময় :
রাসুল (সা.) বলেছেন : ‘জুমআর দিনে এমন একটি সময় আছে কোন মুসলিম যদি সে সময়ে আল্লাহর কাছে কোন কল্যাণ চায় তবে অবশ্যই তিনি তাকে সেটা দিবেন’। [বুখারী : ৬৪০০]।

. জুমআর দিনের নিষিদ্ধ কর্ম :
জুমআর সালাতের / নামাযের আযান হওয়ার পর সর্ব প্রকার ব্যবসায়-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় করা নিষিদ্ধ। আয়াতে (وَذَرُوا الْبَيْعَ) ‘ব্যবসায়-বাণিজ্য ক্রয়-বিক্রয় পরিহার ও বর্জণ করা’। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, যখন আযান দেওয়া হয় তখন সকল কাজকর্ম এমনকি ব্যবসায়-বাণিজ্য বর্জন করে সালাত আদায় করতে চলোএজন্য সকল আলেমগণ একমত যে, দ্বিতীয় আযানের পর সকল প্রকার ক্রয়-বিক্রয় হারামالزوراء (জাওরা) হলো : মদীনার একটি বাড়ি যা খুব উঁচু ছিল এবং মাসজিদের নিকটে ছিল। যেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে মানব সমাগম ঘটত। [ইবনু কাসীর, সহীহ বুখারী ৯১২]।

জ. আয়াত : وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً ‘যখন তারা কোন ব্যবসা দেখে’-এর অবতীর্ণের পেক্ষাপট :
জাবের (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একটি (বাণিজ্যিক) কাফেলা জুমুআর দিন আগমন করলআমরা রাসুল (সা.)-এর সাথে ছিলামমানুষেরা ১২ জন ব্যতীত সবাই চলে গেলতখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়[সহীহ বুখারী : ৪৮৯৯]। তিরমিযীর বর্ণনামতে জাবের (রা.) বলছেন : একদা নাবী (সা.) জুমুআর দিন খুৎবা প্রদান করছিলেনএমন সময় মদীনাতে একটি (বাণিজ্যিক) কাফেলা আগমন করলরাসুল (সা.)-এর সাথে ১২ জন সাহাবী ব্যতীত সবাই সেদিকে দৌড়ালোরাসুল (সা.) বলছেন : ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! যদি তোমরাও তাদের মতো চলে যেতে, একজনও যদি না থাকতে তাহলে উপত্যকা আগুন হয়ে তোমাদের ওপর পতিত হতোতখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়[তিরমিযী : ৩৩১১ সহীহ]। জাবের (রা.) বলছেন, ১২ জনের মধ্যে আবূ বকর ও উমার (রা.)-ও ছিলেন

ঘটনাটি হচ্ছে : মদীনাতে তখন খুব অভাব-অনটন ছিলবাইরের এলাকা থেকে কেউ কিছু আমদানী করে নিয়ে আসে নাদীর্ঘদিন পর এ কাফেলাটি আসছিল জুমুআর দিন খুৎবার সময়তখন একজন ঘোষণা দিল অমুকের কাফেলা পণ্য নিয়ে এসেছেযার কারণে সাহাবীগণ ছুটে গিয়েছিলেনরাসুল (সা.) জুমুআর দিন আগে সালাত আদায় করতেন পরে খুৎবা দিতেন ঈদের সালাতের মতযখন এরূপ একদিন সালাত আদায় করে খুৎবা দিচ্ছিলেন আর একজন লোক প্রবেশ করে বলল : দাহইয়া বিন খলিফা তার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে আগমন করেছেতখন কয়েকজন সাহাবী ব্যতীত সবাই চলে গেল তখন থেকে প্রথমে খুতবা দিলেন পর সালাত আদায় করলেন। [আবূ দাঊদ তার মারাসিল গ্রন্থে জুমুআর খুৎবা অধ্যায়, বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য]

ঝ. জুমআর খুতবা দাঁড়িয়ে দিতে হবে :
আয়াত : ﴿وَتَرَكُوْكَ قَآئِمًا তারা তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে ওর দিকে ছুটে যায়’ এ আয়াত দ্বার প্রমাণ হয় যে, খতিব সাহেব দাঁড়িয়ে খুৎবা প্রদান করবেনরাসূল (সা.)-এর খুৎবা দুটি ছিলদু খুৎবার মাঝে বসতেন[সহীহ মুসলিম, মিশকাত হা. ১৪০৫]।

৬. জুমআর দিনের বিশেষ আমল ; সুন্নত ও আদব (কর্ম) সমূহঃ
৬/১. জুমআর দিন গোসল করা : যাদের উপর জুমআ ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল (সাঃ) ওয়াজিব করেছেন। পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসাবে সেদিন নখ ও চুল কাটা একটি ভাল কাজ [বুখারী ৮৯৮]
৬/২. জুমআর সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা : [বুখারী ৮৮০]
৬/৩. মিস্ওয়াক করা : [ইবনে মাজাহ ১০৯৮, বুখারী ৮৮৭, (ইঃ ফাঃ ৮৪৩]
৬/৪. গায়ে তেল ব্যবহার করা : [বুখারী ৮৮৩]
৬/৫. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমআ আদায় করা : [ইবনে মাজাহ ১০৯৭]
৬. মুসুল্লীদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা : [তিরমিযী ৫০৯, ইবনে মাজাহ ১১৩৬]
৬/৭. মনোযোগ সহ খুৎবাহ শোনা ও চুপ থাকা এটা ওয়াজিব : [বুখারী ৯৩৪, মুসলিম ৮৫৭, আবু দাউদ ১১১৩, আহমাদ ১/২৩০]
৬/৮. আগে ভাগে মসজিদে যাওয়া : [বুখারী ৮৮১, মুসলিম ৮৫০]
৬/৯. পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন করা : [আবু দাউদ ৩৪৫]
৬/১০. জুমআর দিন ফজরের নামাজে ১ম রাকআতে সূরা সাজদা (সূরা নং-৩২) আর ২য় রাকাআতে সূরা ইনসান / দাহর (সূরা নং-৭৬) পাঠ করা : [বুখারী ৮৯১, মুসলিম ৮৭৯]
৬/১১. সূরা জুমআ ও সূরা মুনাফিকুন দিয়ে জুমআর সালাত আদায় করা অথবা সূরা আলা ও সূরা গাশিয়া দিয়ে জুমআ আদায় করা : [মুসলিম ৮৭৭, ৮৭৮]
৬/১২. জুমআর দিন ও জুমআর রাতে বেশী বেশী দুরুদ পাঠ করা [আবু দাউদ ১০৪৭]
৬/১৩. এ দিন বেশী বেশী দোয়া করা [বুখারী ৯৩৫]
১৪. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া [বুখারী ৯১০, ৮৮৩]
৬/১৫. মুসুল্লীদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনের কাতারে আগানোর চেষ্টা না করা [আবু দাউদ ৩৪৩, ৩৪৭]
৬/১৬. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসার চেষ্টা না করা [বুখারী ৯১১, মুসলিম ২১৭৭, ২১৭৮]
৬/১৭. খুৎবা চলাকালীন সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে তখনও দুরাকাআত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত আদায় করা ছাড়া না বসা [বুখারী ৯৩০]
৬/১৮. জুমআর দিন জুমআর পূর্বে মসজিদে জিকর বা কোন শিক্ষামুলক হালকা না করা অর্থাৎ ভাগ ভাগ হয়ে, গোল গোল হয়ে না বসা, যদিও এটা কোন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হোক না কেন [আবু দাউদ ১০৮৯]
৬/১৯. কেউ কথা বললে চুপ করুন এটুকুও না বলা [নাসায়ী ৭১৪, বুখারী ৯৩৪]
৬/২০. মসজিদে যাওয়ার আগে কাঁচা পেয়াজ, রসুন না খাওয়া ও ধুমপান না করা [বুখারী ৮৫৩]
৬/২১. ঘুমের ভাব বা তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে বসার জায়গা বদল করে বসা [আবু দাউদ ১১১৯]
৬/২২. ইমামের খুৎবা দেওয়া অবস্থায় দুই হাঁটু উঠিয়ে না বসা [আবু দাউদ ১১১০, ইবনে মাজাহ ১১৩৪]
২৩. খুৎবার সময় ইমামের কাছাকাছি বসা জান্নাতে প্রবেশের উপযুক্ত হলেও ইমাম থেকে দূরে উপবেশনকারীরা বিলম্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে [আবু দাউদ ১১০৮]
৬/২৪. জুমআর দিন সূরা কাহফ পড়া এতে পাঠকের জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুমআর মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন [হাকেম ২/৩৬৮, বায়হাকী ৩/২৪৯]
৬/২৫. জুমআর আযান দেওয়া অর্থাৎ ইমাম মিম্বরে বসার পর যে আযান দেওয়া হয় তা [বুখারী ৯১২]
৬/২৬. জুমআর ফরজ নামাজ আদায়ের পর মসজিদে ৪ রাকাআত সুন্নাত সালাত আদায় করা
[বুখারী ১৮২, মুসলিম ৮৮১, আবু দাউদ ১১৩০]
৬/২৭. উযর ছাড়া একই গ্রাম ও মহল্লায় একাধিক জুমআ চালু না করা আর উযর হলে এলাকাটি খুব বড় হওয়া, বা প্রচুর জনবসতি থাকা, বা মসজিদ দূরে হওয়া, বা মসজিদে জায়গা না পাওয়া, বা কোন ফিতনা ফাসাদের ভয় থাকা [মুগনি লিবনি কুদামা  ৩/২১২, ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৪/২০৮]
৬/২৮. ওজু ভেঙ্গে গেলে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া অতঃপর আবার ওজু করে মসজিদে প্রবেশ করা [আবু দাউদ ১১১৪]
৬/২৯. একান্ত উযর না থাকলে দুই পিলারে মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় সালাত আদায় না করা [হাকেম ১/১২৮]
৬/৩০. সালাতের জন্য কোন একটা জায়গাকে নির্দিষ্ট করে না রাখা, যেখানে যখন জায়গা পাওয়া যায় সেখানেই সালাত আদায় করা অর্থাৎ আগে থেকেই নামাজের বিছানা বিছিয়ে জায়গা দখল করে না রাখা বরং যে আগে আসবে সেই আগে বসবে [আবু দাউদ ৬২]
৬/৩১. কোন নামাজীর সামনে দিয়ে না হাঁটা অর্থাৎ মুসুল্লী ও সুতরার মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে না হাঁটা [বুখারী ৫১০]
৬/৩২. এতটুকু জোরে আওয়াজ করে কোন কিছু না পড়া, যাতে অন্যের সালাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে [আবু দাউদ ১৩৩২]
৬/৩৩. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়ার ফযীলত অন্তরে জাগরূক রাখা
৬/৩৪. হাঁটার আদব মেনে মসজিদে গমন করা
৬/৩৫. খুৎবার সময় খতীবের কোন কথার সাড়া দেওয়া বা তার প্রশ্নের জবাব দানে শরীক হওয়া জায়েজ [বুখারী ১০২৯, মুসলিম ৮৯৭]
৬/৩৬. হানাফী আলেমগন বলেছেন যে, ভিড় প্রচণ্ড হলে সামনের মুসুল্লীর পিঠের উপর সিজদা দেওয়া জায়েজদরকার হলে পায়ের উপর ও দিতে পারে [আহমাদ ১/৩২, আর রাউদুল মুরবী]
৬/৩৭. যেখানে জুমআর ফরজ আদায় করেছে, উত্তম হল ঐ একই স্থানে সুন্নাত না পড়া অথবা কোন কথা না বলে এখান থেকে গিয়ে পরবর্তী সুন্নাত সালাত আদায় করা [মুসলিম ৭১০, বুখারী ৮৪৮]
৬/৩৮. ইমাম সাহেব মিম্বরে এসে হাজির হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা- ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াতে রত থাকা

৭. আলোচ্য আয়াত হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয় :
ক. জুমআর সালাত / নামায প্রত্যেক সুস্থ ও বাড়িতে অবস্থানকারী প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম পুরুষ ব্যক্তির ওপর ফরয
খ. জুমআর খুতবার আযানের পর সকল প্রকার ব্যবসায় বাণিজ্য হারাম
গ. জুমআর দিনের ফযীলত জানতে পারলাম
ঘ. জুমআর দিন দ্বিতীয় আযান দেওয়া বৈধ হবে উসমান (রাঃ) যে কারণে চালু করেছেন যদি সে কারণ পাওয়া যায়
ঙ. জুমুআর দিনের করণীয় ও বর্জণীয় সম্পর্কে জানলাম
চ. জুমআর খুতবা হবে দুটি এবং তা হবে দাঁড়িয়ে ও প্রয়োজনে মাতৃভাষায়
ছ. জুমআর সালাত / নামায আদায় করা যেমন ওয়াজিব তেমন খুৎবা শোনাও ওয়াজিবখুৎবা চলাকালে কথা বলা ও কোন কাজ করা নিষেধ

৮. সম্মানিত ইমাম ও খতিবগণের নিকট অুনরোধ :
ক. কুরআনের মাধ্যমে ইসলামের সু-শীতল ছায়াতলে দ্বীনের পথে আসতে উদ্বুদ্ধ করুন এবং আলোকিত সত্য সুন্দর মানুষ তৈরিতে অবদান রাখুন
খ. মানব জাতির ইহ ও পরকালীণ জীবনের বাস্তবধর্মী সমাস্যার সামাধানে, মুক্তি কল্যাণ ও সফলতা অর্জনে তথ্য-প্রমাণ ও বিষয় ভিত্তিক, জনগুরুত্বপূর্ণ, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সকলের কল্যাণে ফলপ্রসু জীবন্ত খুতবার প্রচলন করুন।
গ. ঈমান ও ইবাদতের খাতিরে জুমার খুতবায় সমাজ পরিবর্তনের সাহসী ভূমিকা রাখুন।
ঘ. একজন ঈমানদার মুসলমান হিসেবে সত্যের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখুন।
ঙ. কৌশলী হয়ে কুরআন ও সুন্নাহর খেদমতে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতি-বিচ্যুতি বিপথগামী মুসলমাদের সামনে তুলে ধরা সহজ-সাবলিল ভাষায় উপস্থাপন করুন।

৯. উপসংহার :
জুমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই দিনটিকে কাজে লাগানোএই দিনে নিজের জন্য এবং সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণ-সৌভাগ্য ও উন্নতির দুআ করা জুমআর দিনের ফজিলত শেষ নবীর উম্মতের জন্য অত্যান্ত বড় নেয়ামততাই এই দিনে কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, তাসবিহ-তাহলিলসহ ইবাদত-বন্দেগিতে মনযোগ দিই মহান আল্লাহ আমাদের সকলের মনোবাসনা পূরণ করুন, জীবিত ও মৃত সকলের অপরাধ ও গুণাহ ক্ষমা করুন, আমীন।

* শিক্ষক, ইনসাইট ইন্টরন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment