বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
শবে বরাত ; একটি পর্যালোচনা (পাঠ ০২)
প্রচলিত শবে বরাত কেন্দ্রিক ইবাদত; ইসলাম অনুমোদিত না উপেক্ষিত?
মুফতি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
৭. বরাত প্রমাণের মূল ভিত্তি হলো; মিথ্যা, জাল, বানোয়াট, দুর্বল হাদিস ও কুরআনের অপব্যাখ্যাঃ
সম্মানিত বিজ্ঞ মহল, সুস্থ্য ও সচেতন সূধী! আল-কুরআনের সূরা দুখানের ১-৪ নং আয়াতের অসমর্থিত, অপব্যাখা ও শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কিত কয়েকটি মিথ্যা, জাল, বানোয়াট ও দুর্বল হাদিসই হচ্ছে শবে বরাত পালন বা উদযাপনের মূল ভিত্তি। এরই ভিত্তিতে আলেম-উলামাগণ এবং মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতীবগণ আমাদেরকে শবে বরাতের ফজিলত, তাৎপর্য ও মাহাত্ব বর্ণনা দিয়ে ওয়াজ নসীহত করেন এবং সু-মিষ্ট বয়ান শুনিয়ে থাকেন। অথচ মিথ্যা, জাল, বানোয়াট ও দুর্বল হাদিসের উপর ভিত্তি করে শরী’য়তের মধ্যে কোন নতুন বিষয় প্রবর্তন করা যায় না। কেননা মিথ্যা, জাল ও বানোয়াট হাদিস যা রাসূল (সাঃ)-এর হাদিস নয় বলে প্রতিয়মান হয়। তার উপর নির্ভর করে কোন কাজ প্রচলন করা যায় না। তবে হ্যাঁ, কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত বা প্রতিষ্ঠি আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস গ্রহন করা যেতে পারে মর্মে কথিত রয়েছে। যেহেতু সাধারণ মুসলিম সমাজের মাঝে আলেমদের মুখনিসৃত হাদিসের কথা শোনে তদানুযায়ি আমল করার আগ্রহ দেখা যায়, সেহেতু কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ি বিজ্ঞ আলেমদের কাছ থেকে ভালভাবে জেনে-শোনে আমল করা উচিত। কেননা অনেক ক্ষেত্রে মুক্ষ্য হাদিসটি মিথ্যা, জাল, বানোয়াট ও দুর্বলও হতে পারে। তাই এখানে শবে বরাত সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসগুলির তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা করা জরুরি। যাতে সঠিক বিষয় জানা-মানা ও উপলব্ধি করে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যে আমল করা যায়।
৮. মিথ্যা, জাল, বানোয়াট ও দুর্বল হাদিসের উপর আমল না করার জন্য ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর নির্দেশঃ
মিথ্যা, জাল, বানোয়াট ও দুর্বল হাদিসের উপর আমল করতে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) নিষেধ করেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বলেছেন :
ক. إِذَا
صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ হাদীস
সহীহ হলে সেটাই আমার মাযহাব। [রাসমুল মুফতী ১/৪, হাশিয়া ইবনু ‘আবিদীন ১/৬২ ও ৬৩]।
খ. لاَ يَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يَأْخُذَ
بِقَوْلِنَا مَالَمْ يَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ أَخَذْنَاهُ আমরা
কোথা থেকে মাসআলা গ্রহণ করেছি, তা
জানার আগ পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য গ্রহণ করা কারোর জন্যে জায়েজ নেই। [গ নং-এ দেখুন]।
গ. অন্য এক বর্ণনায় ইমাম আবু হানিফার এই বক্তব্য এসেছে যে, حَرَامٌ عَلَى مَنْ لَمْ يَعْرِفَ دَلِيْلِيْ
أَنْ يُفْتىٰ بِكَلَامِيْ যে
ব্যক্তি আমার দলীল-প্রমাণ জানে না, তার জন্য আমার বক্তব্য দিয়ে ফাতুওয়া দেওয়া হারাম। অন্য এক বর্ণনায় তাঁর আরো একটি কথা যোগ করে বলা হয়েছে, ‘আমরা মানুষ। আজ যে কথা বলি কাল সে কথা প্রত্যাহার করি। [ইবনে
আব্দিল বার, ‘আল-ইনতেক্বাউ ফি ফাযায়িলিছ ছালাছাতুল আইম্মাতুল ফুক্বাহাউ’ পৃঃ ১৪৫,
ইবনিল কাইয়্যিম, ই‘লামুল মুওয়াক্বিঈন ২/৩০৯, ইবনে ‘আবিদীন, বাহরুর রায়িক্ব-এর
(হাশিয়া) টীকা ৬/২৯৩, রাসমুল মুফতী পৃঃ ২৯ ও ৩২, আশ-শা‘রানী, আল-মীযান ১/৫৫]।
ঘ. إِذَا كَانَ خِلَافَ الُقْرآَنَ وَالسُّنَّةَ أَتْرُكُوْا قَوْلِيْ
بِخَبَرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ আমার কোনো কথা যদি কুরআন ও হাদীসের বিপরীত হয়, তাহলে আমার বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করো। [আল-ফালানী, আল-ইক্বায পৃঃ ৫০, আশ-শা‘রানী, আল-মীযান ১/২৬]।
৯. বরাত প্রমাণে সূরা দুখানের অসমর্থিত ও অপব্যাখার বিবরণঃ
আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা এরশাদ করেন :
حمٓ (1)
وَالْكِتٰبِ الْمُبِينِ (2) إِنَّآ
أَنزَلْنٰهُ فِى لَيْلَةٍ مُّبٰرَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ (3) فِيهَا
يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكِيمٍ (4)
হা-মীম। (২) শপথ সুষ্পষ্ঠ কিতাবের। (৩) আমি একে
নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (৪) এ রাতে
প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ
বিষয় স্থিরীকৃত
হয়। [সূরা দুখান : ০১-০৪]।
আনুসাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ যারা শবে বরাতের সমর্থনে এ আয়াতগুলি উপস্থাপন করেন তারা, لَيْلَةٍ
مُبَارَكَةٍ বা বরকতময় রজনীর
ব্যাখ্যায় শবে
বরাতকে উল্লেখ
করে থাকেন। কিন্তু কুরআনের অন্য স্থানে لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ বা বরকতময় রজনী দ্বারা
সুস্পষ্ঠভাবে শবে
ক্বদরকে বুঝানো
হয়েছে। কেননা কুরআনের মূল
উৎস হলো : إنَّ الْقُرْآَنَ
يُفَسِّرُ بَعْضَهُ بَعْضًا তথা কুরআনের এক
অংশ দিয়ে
অন্য অংশের
ব্যাখ্যা করা
হয়। উদাহরণসরূপ : اهْدِنَا الصِّرَاطَ
الْمُسْتَقِيمَ ۞ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘হে আল্লাহ
আপনি আমাদেরকে
সহজ, সরল ও
সঠিক পথে
পরিচালিত করুন’। তাদের পথ যাদেরকে
আপনি নিয়া’মতের মাধ্যমে অনুগ্রহ
করেছেন’। [সূরা ফাতিহা : ৫-৬]। এখানে নিয়া’মত প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ
স্পষ্ঠ নয়, তাই আল্লাহ তা’আলা এই আয়াতের
ব্যাখ্যা অন্য
আয়াতে এভাবে
করেছেন। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ
أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ
وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا ‘আর
যে কেউ
আল্লাহর হুকুম
এবং তাঁর
রসূল
(সা)-এর হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি
আল্লাহ্ নেয়ামত
দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী
হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও
সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল
উত্তম। [সূরা নিসা : ৬৯]।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ঠ হয়েগেছে যে, যেই রাত্রে মহান আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন, সে রাত্রই মহিমান্বিত, গৌরবান্বিত ও বরকতময়। সকল তাফসীরবীদদের অভিমতে সে রাত ছিল ‘লাইলাতুল ক্বদর’। বরাতের রজনী নয়। এছাড়াও আল্লাহ তা’আলা কুরআনকে রামাদান মাসে অবতীর্ণ করেছেন। মর্মে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা দিয়েছেন : ﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ
وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ﴾ ‘রামাদান মাস যার মধ্যে বিশ্ব মানবের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জল নিদর্শন ও প্রভেদকারী কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছ ‘। [সূরা বাক্বারা : ১৮৫]। আর উল্লেখ্য যে, ‘লাইলাতুল ক্বদর’ শা’বান মাসে হয়না বরং রামাদন মাসে হয়। সুতরাং উক্ত ব্যাখ্যা অগ্রহনযোগ্য।
১০. মহিমান্বিত, গৌরবান্বিত, বরকত-পূণ্যময় ও ভাগ্যরজনী কোনটি?
لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ -এর ব্যাখ্যাঃ ইবনে
আব্বাস, ইবনে কাসীর, ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম), মুজাহিদ, কাতাদা ও হাসান বসরী (রাহিমাহুমুল্লাহ) গণসহ তাফসীর শাস্ত্রের দিকপালগণ لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ -এর ব্যাখ্যায় ‘লাইলাতুল ক্বদর’ কেই
উল্লেখ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত কালোজয়ী প্রখ্যাত মুফাসসির
‘আল্লামা
ইবনে কাসীর
(রহ)
তার تفسير القرآن العظيم (তাফসীরুল
কুরআনুল ‘আজীম) এর ধারাভাষ্যমতে
: إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ أَيْ هِيَ لَيْلَةُ
الْقَدْرِ ‘নিশ্চয়ই তিনি
কুরআনকে মহিমান্বিত, বরকত-পূণ্যময় ও ভাগ্যরজনীতে অবতীর্ণ
করেছেন’। [সূরা দুখান : ০৩]। আর সেই
মহিমান্বিত, গৌরবান্বিত, বরকত-পূণ্যময় ও ভাগ্যরজনীটি হল
‘ক্বদরের’
রাত।
ইমাম শাওক্বানী (রা.) বলেন :
المراد
بليلة المباركة هي الليلة القدر – كما فى قوله تعالي ﴿إنَّآ أنْزَلْنَاهُ فِيْ لَيْلَةِ الْقَدْر﴾
মহিমান্বিত, গৌরবান্বিত, বরকত-পূণ্যময় ও ভাগ্যরজনী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো : ‘ক্বদর রজনী’। যেমন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন : ‘নিশ্চয়ই আমি
কুরআনকে ক্বদরের
রজনীতে অবতীর্ণ
করেছি’। [সূরা ক্বদর : ০১]।
মহান আল্লাহ তা’আলঅ এরশাদ করেন : ﴿إنَّآ أنْزَلْنَاهُ فِيْ
لَيْلَةِ الْقَدْر﴾ ‘নিশ্চয়ই আমি
কুরআনকে ক্বদরের
রজনীতে অবতীর্ণ
করেছি’। [সূরা ক্বদর : ০১]। ইমাম কুরতুবী (রা.) বলেন শবে
বরাতের মর্যাদা
এবং এতে
মানব জাতির
জন্ম-মৃত্যু ও ভাগ্য লিপিবদ্ধ করার
বিষয়ে নির্ভরযোগ্য
কোনো হাদীস
নেই অত্রঃএব
তোমরা এ রাতের প্রতি কোন
গুরুত্ব দিবেনা। [তাফসীর কুরতুবী, সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য]।
১১. শবে বরাতের ফজিলত প্রমাণে দুর্বল হাদীস ও তার পর্যালোচনাঃ
১নং হাদীসঃ
عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ، قَالَ رَسُولُ
اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ
شَعْبَانَ فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا يَوْمَهَا، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ
فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُولُ أَلاَ مِنْ
مُسْتَغْفِرٍ فَأَغْفِرَ لَهُ أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ أَلاَ مُبْتَلًى
فَأُعَافِيَهُ أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ
আলী
ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেনঃ যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন
তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে সালাত (নামায/নামাজ) পড়ো এবং এর দিনে সওম রাখো। কেননা এ দিন সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর আল্লাহ পৃথিবীর নিকটতম
আকাশে নেমে আসেন এবং বলেনঃ কে আছো আমার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করবো। কে আছো রিযিকপ্রার্থী, আমি তাকে রিযিক দান করবো। কে আছো রোগমুক্তি প্রার্থনাকারী, আমি তাকে নিরাময় দান
করবো। কে আছো এই প্রার্থনাকারী। ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত (তিনি এভাবে আহবান করেন)। তাখরীজ
আলবানী: সুনান ইবনু মাজাহ হা/নং ১৩৮৮, মিশকাত ১৩০৮ মাওযূ, যঈফ তারগীব ৬৩২ মাওযূ, যাঈফা ২১৩২ মাওযূ, মিশকাত ১৩০৮, যঈফাহ ২১৩২। তাহক্বীক্ব আলবানী: যঈফ জিদ্দান অথবা মাওযু]।
পর্যালোচনা : ইবনে মাযার এই হাদীসের সনদে ‘আবু সাবরা’ নামক একজন বর্ণনাকারী আছেন যিনি, মুহাদ্দীসগণের নিকট অতি দুর্বল ও ভুল হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে আখ্যায়িত ও পরিচিত।
২নং
হাদীসঃ
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ فَقَدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله
عليه وسلم لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ فَقَالَ : أَكُنْتِ
تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ، قُلْتُ يَا رَسُولَ
اللَّهِ إِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فَقَالَ : إِنَّ
اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى
السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
আইশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসূল (সা)-কে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তার সন্ধানে) বের
হলাম। এসে দেখলাম তিনি বাকী
কবরস্তানে আছেন। তিনি বলেনঃ তুমি কি
ভয় করছ আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার প্রতি কোন অবিচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমান করলাম
আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকটে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মধ্য শা'বানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন। তারপর কালব গোত্রের
বকরী পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন। [সুনান ইবনু মাজাহ হা/নং ১৩৮৯, সুনান আত
তিরমিজী হা/নং ৭৩৯ তাহক্বীক আলবানী : যঈফ (দুর্বল)]।
পর্যালোচনা : এই হাদীসটি বায়হাকীতে মুরসাল সনদে বর্ণিত হয়েছে যা সকল হাদীস বিশারদগণের নিকট সর্বসম্মতিক্রমে অগ্রহণযোগ্য তথা আবূ ঈসা বলেন, হাজ্জাজের
বরাতে এই সূত্রটি ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে আইশা (রাঃ)-এর হাদীসটি প্রসঙ্গে আমরা
কিছুই অবগত নই। আমি মুহাম্মাদ আল-বুখারীকে উল্লেখিত হাদীসকে
দুর্বল বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, রাবী
ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীর উরওয়া (রহঃ) হতে কোন হাদীস শুনেননি। মুহাম্মাদ
আল-বুখারী আরও বলেন, এমনিভাবে
হাজ্জাজও ইয়াহইয়া ইবনু আবূ কাসীরের নিকট হতে কিছুই শুনেননি।
১১. لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانْ (লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান) তথা শা’বানের মধ্য রজনীর ব্যাপারে সহীহ হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছেঃ
প্রশিদ্ধ ৮ জন সাহাবা থেকে কাছাকাছি সহীহ, হাসান সনদে একটি হাদীস বর্ণিত রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো : আবূ মূসা আশ’আরী (রাঃ), মু‘আজ ইবনু জাবাল (রা) থেকে বর্ণনা করেন,
রাসূল (সাঃ) বলেছেন : إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ
شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ ‘মহান আল্লাহ তা’আলা মধ্য শা’বানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন’। [সুনান
ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৪৪৫; বায্যার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭,২০৭, ৭/১৮৬; আহমাদ ইবনু হাম্বাল, মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম; আস-সুন্নাহ পৃঃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান; আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মু’জাম আল-কাবীর ২০/১০৮, ২২/২২৩;আল-মু’জাম আল-আওসাত ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬; ড. আব্দুল্লাহ
জাহাঙ্গির-হাদীসের নামে জালিয়াতি পৃঃ ৫৩৫]।
* আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রঃ) বলেছেন : শবে বরাতের সকল হাদীস দুর্বল ও ভিত্তিহীন।
* কোন কোন আলেম বলেছেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে বর্ণিত কিছু দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে সিরিয়ার তাবিয়িগণ শা’বানের মধ্য রজনীতে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন নফল ইবাদত করতেন।
* ব্যক্তিগত ইবাদতের জন্য মসজিদে সমবেত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং ব্যক্তিগত ইবাদতের জন্য বাসা-বাড়ীই হচ্ছে উত্তম। কেননা রাসূল (সাঃ) নফল সালাত বাসা-বাড়ীতে আদায়ের উৎসাহ দিয়ে বলেছেন : لا
تجعلوا بيوتكم مقابرا – ولا
تجعلوا قبوركم مساجدا ‘তোমরা কবরস্থানে
সালাত আদায়
করোনা এবং
বাসা-বাড়ীকে কবরে
পরিণত করোনা’। [সুনান আবু দাউদ হা/নং ২০৪২, সুনান আহমাদ হা/নং ৮৭৯০]।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এতটুকু প্রতিয়মান হয় যে, শা’বানরে মধ্য রজনীতে কেহ যদি নিজ বাসা-বাড়ীতে বা ঘরে অন্যান্য দিনের ন্যায় ব্যক্তিগতভাবে ইবাদত-বন্দেগী করে তাহলে এটা বিদ’আত হবেনা কিন্তু এ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে ইসলাম বহির্ভূত, সুন্নাহ বিরোধী বিদ’আতে পরিণত হবে। কারণ নিয়ম হলো, যে আমল যেখানে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সে আমল সেখানে সেভাবে আদায় করা সুন্নাহ। আর যা রাসূল (সাঃ) থেকে প্রমাণিত নেই তা পালন না করা সুন্নাহ। তাই যে কোন বিষয়ই যেন শরী’য়ত বিরোধী না হয় সে দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
১২. তথাকথিত বরাত কেন্দ্রিক পালনীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহঃ
ক. তথাকথিত বরাত কেন্দ্রিক করনীয় ও পালনীয় বিষয়সমূহঃ
* রামাদান মাসের রোযা ও অন্যান্য আমলের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
* দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাত আদায় করা।
* অন্যান্য সুন্নাহ ও নফল সালাতসমূহ আদায় করা।
* প্রতি মাসে চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা রাখা।
* কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করা।
* দু’আ পড়া : اَللَّهُمَّ
بَلِّغْنَا رَمَضَانْ (আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাদান) হে
আল্লাহ আপনি আমাদেরকে রামাদান পর্যন্ত পৌছে দিন। [ফাযায়েলে রামাদান
হা/নং ০১, তাবারী মু‘জামুল আওসাত্ব হা/নং ৩৯৩৯]।
খ. তথাকথিত বরাত কেন্দ্রিক নিন্দনীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহঃ
* বরাত কেন্দ্রিক সব আনুষ্ঠানিকতা পরিহার ও পরিত্যাগ করা।
* আলোকসজ্জা, আতশবাজী, পটকা ফুটানো মোমবাতি জ্বালানো, হালুয়া-রুটি খাওয়া ও বিতরণ না করা।
* কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ বিরোধী সকল ভ্রান্ত মতবাদ, রসম-রেওয়াজ, বাৎসরিক আনুষ্ঠানিকতা না করা।
* দুর্বল, মিথ্যা, জাল, বানোয়াট হাদীসের উপর আমল না করা।
* কবর যিয়ারত, মাযারপূজাসহ মনগড়া সব আমল পরিহার করা।
১২. উপসংহারঃ
উদারমানসিক বন্ধুগণ! আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে যে, শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়না বরং ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় লাইলাতুল ক্বদরে। আর মহান আল্লাহ শুধুমাত্র শবে বরাতের রাতেই পৃথিবীর প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না বরং প্রতিদিনই পৃথিবীর প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং আহ্বান করতে থাকেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
قَالَ يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ
الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ يَقُولُ مَنْ يَدْعُونِي
فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي
فَأَغْفِرَ لَهُ – متفق عليه
‘আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন যে, আমাদের প্রতিপালক
প্রতি রাত্রে
যখন এক
তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট
থাকে তখন
দুনিয়ার আসমানে
নেমে আসেন
অতঃপর বলতে
থাকেন- কে আমার
নিকট দু’আ করবে আমি
তার দু’আ কবুল করব, কে আমার
নিকট কিছু
চাইবে আমি
তাকে প্রদান
করব, কে আমার নিকট ক্ষমা
চাইবে আমি
ক্ষমা করব’। [বুখারী হা/নং ১১৪৫, মুসলিম হা/নং ৭৫৮, তাহাজ্জুদ অধ্যায় মাকতাবায়ে শামেলা ৪/২২৭, ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ।]।
অনুরূপভাবে শবে
বরাতই দু’আ কবুলের একমাত্র
রাত নয়
বরং প্রতি
রাতরে শেষাংশ
দু’আ কবুলের জন্য
বিশেষিত। তাই আসুন
আমরা আল-কুরআন, রাসূল (সাঃ)-এর সহীহ
হাদীস ও সহীহ আক্বীদা এবং
সাহাবাদের আমলের
মাধ্যমে জীবন-যাপন করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বিদ’আত ও কু-সংস্কারমুক্ত কুরআন-সহীহ হাদীস
ভিত্তিক জীবন-যাপনের তাওফীক্ব
দান করুন, আমীন।
নির্ঘন্ট / গ্রন্থপঞ্জি
১. তাফসীর ইবনে কাসীর।
২. তাফসীর কুরতুবী।
৩. ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর-হাদীস নামের জালিয়াতি এবং শবে বরাত।
৪. আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম-শবে বরাতের সমাধান।
৫. শবে বরাত সংক্রান্ত বিভিন্ন পুস্তক।
No comments:
Post a Comment