বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনঃ
পহেলা বৈশাখ : অপসংস্কৃতির ভয়াবহ কালো থাবা (পাঠ ০২)
মুফতি আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
১৪. উল্কি আঁকাঃ
উল্কি আঁকা অর্থ শরীরে আঁকা-আঁকি করা। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে অনেক যুবক-যুবতিরা তাদের গালে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে উল্কি অঙ্কন করে। এটি একটি কবীরাহ্ গুনাহ্। এ ব্যাপারে ইবনু উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন :
لَعَنَ اللَّهُ الْوَاصِلَةَ وَالْمُسْتَوْصِلَةَ، وَالْوَاشِمَةَ وَالْمُسْتَوْشِمَةَ. قَالَ نَافِعٌ الْوَشْمُ فِي اللِّثَةِ
‘আল্লাহ্ ঐ নারীর উপর অভিশাপ
বর্ষণ করেন
যে, নারী পরচুল লাগায় এবং
অপরকে পরচুল
লাগিয়ে দেয়। আর যে
নারী উল্কি
অঙ্কন করে
এবং যে
তা করায়। নাফি’ বলেন : উল্কি সাধারণতঃ
উচু মাংসের
উপর অঙ্কন
করা হয়। [সহীহ বুখারী
(তা. পা) অধ্যায় : পোষাক-পরিচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ : পরচুলা লাগানো ; হা/৫৯৪০, ৫৯৪২, ৫৯৪৭, সহীহ মুসলিম
হা/ ২১২৪, আহ্মাদ
হা/৪৭২৪, [ই.
ফা ৫৩৯৯]। তাহলে বুঝা যাচ্ছে শরীরে কিছু অঙ্কন করলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হয়। অর্থাৎ সে অভিশাপ্ত। আর অভিশপ্তরা কখনো সফলকাম হয় না। তাছাড়া এতে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তন করা হয়, যা কুরআনের নির্দেশনা মতে হারাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতেও উল্কি অঙ্কন ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
১৫. জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরীঃ
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরী করা হয়। এগুলোকে তথাকথিত বৈশাখী প্রেমিকরা নিজেদের মুখোশ তৈরী করে বানর, হনুমান, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি বেশে সাজে এবং এগুলো নিয়েই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। ইসলামে জীবজন্তু ও প্রাণীর প্রতিকৃতি বা ছবি তৈরী করাকে কঠোরভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ক. আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন : إنَّ أَشَدَّ النَّاسِ
عَذَابًا يَّوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوَّرُوْنَ ‘নিশ্চয়ই কঠিন
শাস্তি ভোগ
করবে ক্বিয়ামতের
দিন জীবজন্তু, প্রাণীর প্রতিকৃতি
তৈরী ও ছবি অঙ্কনকারীরা [সহীহ
বুখারী হা/৫৯৫৪]।
খ. আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন :
مَنْ صَوَّرَ صُورَةً فِي الدُّنْيَا كُلِّفَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ، وَلَيْسَ بِنَافِخٍ
‘যে ব্যক্তি
দুনিয়ায় কোন
প্রাণীর ছবি
নির্মাণ করে, ক্বিয়ামতের দিন
তাকে কঠোরভাবে
নির্দেশ দেওয়া
হবে ঐ ছবির মধ্যে রূহ
দান করার
জন্য। কিন্তু সে
রূহ দান
করতে পারবে
না [সহীহ
বুখারী হা/৫৯৬৩ [তা. পা ২২২৫, আ প্র. ৫৫৩০, ই. ফা ৫৪২৫]।
১৬. সঙ্গীত, গান-বাজনা বা বাদ্য-বাজনাঃ
ক. বাদ্য-বাজনা ব্যবহার ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন : ﴿وَمِنَ
النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ
بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ﴾ অর্থ : ‘একশ্রেণির মানুষ আছে
যারা মানুষকে
আল্লাহর পথ
থেকে বিচ্যুত
করার জন্য
অজ্ঞতার সাথে
অনর্থক কথা (বাদ্য-বাজনা) ক্রয় করে
এবং তাকে
আনন্দ-ফূর্তি হিসেবে
গ্রহন করে, তাদের জন্য রয়েছে
যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি’ [সূরা লুক্বমান : ০৬]।
খ. অনর্থক কথা, বানোয়াট গল্প-কাহিনী এবং গান-বাজনা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শয়তানের পুরোনো কূটচালের একটি, আল্লাহ এ কথা কুরআনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন : ﴿وَاسْتَفْزِزْ
مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ﴾ ‘আর তাদের মধ্যে
যাদেরকে পার
পর্যায়ক্রমে বোকা
বানাও তোমার
গলার স্বরের
সাহায্যে’ [সূরা বনী
ইসরাঈল : ৬৪]। ‘যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার
দিকে আহবান
জানায়, তার সবই এই আয়াতে
বর্ণিত আওয়াজের
অন্তর্ভূক্ত’ [তফসীর ইবনে
কাসীর]।
গ. রাসূল বলেছেন : لَيَكُونَنَّ مِنْ أُمَّتِي
أَقْوَامٌ يَسْتَحِلُّونَ الْحِرَ وَالْحَرِيرَ وَالْخَمْرَ وَالْمَعَازِفَ
‘আমার উম্মতের
মধ্যে অবশ্যই
এমন কিছু
লোক হবে, যারা যেনা-ব্যভিচার ; (পুরুষের জন্য) সিল্ক, মদ ও
বাদ্যযন্ত্রকে হালাল
মনে করবে’
[সহীহ বুখারী হা নং-৫৫৯০]। তাছাড়া পূজার
অন্যতম উপাদান
হলো ; গান ও
ঢোল-তবলা বাজানো।
১৭. নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা, বেহায়া ও বেলেল্লাপনা চর্চাঃ
বর্তমানে অনেক আদর্শ, নম্র-ভদ্র, সৌখিন, শালীণ ও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরাও পহেলা বৈশাখের নামে অর্ধনগ্ন হয়ে বের হয়। গরমের দিনে তথাকথিত পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি ঘামে ভিজে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অত্যন্ত নোংরাভাবে প্রকাশিত হয়। তাছাড়াও নারী-পুরুষ ঢলাঢলির মাধ্যমে ব্যভিচারের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র তৈরী হয় পহেলা বৈশাখের সংস্কৃতিতে। পান্তা-ইলিশের সাথে ইদানিং যোগ হয়েছে যুবতী মেয়েদের হাতে খেয়ে মনের নোংরা চাহিদা মেটানোর যৌন লালসা। উল্কি অঙ্কনের ক্ষেত্রেও বিপরীত লিঙ্গের হাত ব্যবহার করা হয় তা প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতা। বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে তরুণ-তরণীরা জোড়ায় জোড়ায় মিলিত হয়ে নীরবে-নিবৃতে প্রেমিক-প্রেমিকার অভিনয়ে খোশ গল্প, অনৈতিকতা, অশ্লীলতা ও নগ্নতায় জড়িয়ে পড়ে। এ হল বৈশাখের বাস্তব চিত্র।
ক. নারী-পুরুষের এই ধরণের মেলা-মেশা এবং এহেন কার্যকলাপ ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন : ﴿وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا
إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا﴾ অর্থ : ‘আর
যিনা-ব্যভিচারের কাছেও
যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ
এবং মন্দ
পথ’ [সূরা বানী ইসরাঈল : ৩২]।
খ. অন্যত্র মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন :
﴿ وَقُلْ
لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا
يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ
عَلَى جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ
آَبَائِهِنَّ أَوْ آَبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ أَوْ أَبْنَاءِ
بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي
أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ
التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ
الَّذِينَ لَمْ يَظْهَرُوا عَلَى عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ
بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِنْ زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا إِلَى
اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (31)
وَأَنْكِحُوا الْأَيَامَى مِنْكُمْ وَالصَّالِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ
وَإِمَائِكُمْ إِنْ يَكُونُوا فُقَرَاءَ يُغْنِهِمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ
وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (32)﴾
অর্থ : ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপনাঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহ্র সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (৩১) তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দিবেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’ [সূরা নূর : ৩১-৩২ ]।
গ. পর্দা সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তা’আলা বলেন : ﴿وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ
الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى﴾ অর্থ
: ‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান
করবে, মূর্খতার যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে
প্রদর্শন করবে
না’ [সূরা আহযাব : ৩৩]।
১৮. নতুন পোশাকে সাজ-সজ্জা ও আকর্ষনীয় খাবার ব্যবস্থাঃ
পহেলা বৈশাখকে ঈদের মত মর্যাদা দিয়ে জাতীয়ভাবে নতুন পোশাক ও আকর্ষনীয় খাবার ব্যবস্থা গ্রহনের কালচার সৃষ্টি করা হয়। এমন কি এটাও বলা হয় যে, এটা না-কি বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব! তাহলে ঈদ কত নম্বর সিরিয়ালে? অথচ মুসলিমদের জাতীয় জীবনে দু’টি উৎসব দেওয়া হয়েছে। হিন্দুদের বারো মাসে ১৩ পূজার আদলে কোন মুসলিমের জন্য ‘পহেলা বৈশাখ’কে আরেকটি বাৎসরিক উৎসবের দিন ধার্য করা জায়েয নেই। সাথে এই দিনকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে হরেকরকম খাবারের আয়োজন করা হয় এবং নতুন পোশাকে সাজ-সজ্জা করাও ঠিক নয়। ইদানিং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের অতি তোরজোড় দেখে মনে হয় তারা এটাকে দেশের মানুষের প্রধান উৎসব হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ঘোষণাও করছে।
১৯. নববর্ষের শুভেচ্ছ বিনিময়ঃ
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন তথা ‘পহেলা বৈশাখ’ সহ অনৈসলামিক বিভন্ন উৎসবে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে পরস্পর শুভেচ্ছ বিনিময় করে থাকে। কিন্তু এ ধরণের শুভেচ্ছা বিনিময় করা কি ইসলামী শরী’য়তে গ্রহনযোগ্য? এ সম্পর্কে মুসলিম পন্ডিত আল্লামা ইবনু উসাইমীন ও ইবনুল কায়্যিম (রহ)-এর ফাতুওয়া নিম্নরূপ :
ক. একজন মুসলিমের পক্ষ থেকে অমুসলিমদেরকে কোন উৎসবের সম্ভাষণ, অভিভাদন, অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা এবং তাদের পক্ষ থেকে আসা সম্ভাষণ, অভিভাদন, অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা বিনিময়-এর উত্তর প্রদান করা মানে হলো তাদের বিজাতীয় অনৈসলামিক অনুষ্ঠানাদি ও উৎসবকে অনুমোদন ও সম্মতি প্রদান করা। আরব আলেমদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে বড় দিন বা অন্যান্য অনৈসলামিক বিজাতীয় উৎসব উপলক্ষে তাদের সম্ভাষণ, অভিভাদন, অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানো হারাম।
খ. বিধর্মীদের অনুষ্ঠানের অভিনন্দন ও সমর্থন জানানো হারাম। যে এরূপ করল সে কুফরী করল। কেননা সে ইসলামের আদর্শের চেয়ে বিধর্মীদের আদর্শকে উত্তম মনে করল। আর এটা কখনোই না। যেমন রাসূল (সা) বলেছেন : مَنْ
تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোন
সম্প্রদায়ের সাথে
সাদৃশ্য গ্রহণ
করে সে
তাদের দলভুক্ত’ [আবু দাউদ হা নং-৪০৩১, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা নং-৪৩৪৭ সনদ সহীহ]।
২০. পহেলা বৈশাখ পালন করা কেন হারাম ??
উত্তরঃ নাবী কারিম (সা) হিজরতের পর মদীনায় গিয়ে ঐ এলাকাবাসীর দুটি উৎসব বন্ধ করেছিলেন। একটি হচ্ছে, বছরের প্রথম দিন উদযাপন বা নওরোজ; অন্যটির নাম ছিলো ‘মিহিরজান’। এ উৎসব দু’টির বিপরীতে চালু হয় মুসলমানদের দুই ঈদ’। আনাস (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন :
قَدِمَ النَّبِيُّ ﷺ اَلْمَدِيْنَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُوْنَ فِيْهِمَا فَقَالَ : مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ فَقَالُوْا: كُنَّا نَلْعَبُ فِيْهِمَا الْجَاهِلِيَّةِ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ قَدْ أبْدَلَكُمُ اللهُ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا : يَوْمَ الْأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ
নাবী (সা) মাদীনায় আগমন করার পর তাদের দু’টি দিন ছিল। এ দিন দু’টিতে তারা খেলা-ধূলা ও আমোদ-প্রমোদ করত। (এ দেখে) তিনি (সা) জিজ্ঞেস করলেন, এ দু’টি দিন কী? তারা বলল : ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়্যাতের সময় এ দিন দু’টিতে আমরা খেলা-ধূলা করতাম। (এ কথা শ্রবণে) রাসূল (সা) বললেন : এ দু’দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য আরো উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন। এর একটি হলো ঈদুল আয্হার দিন, অপরটি ঈদুল ফিতরের দিন। [সুনানু আবু দাউদ হা/১১৩৪, তাহক্বীক
মিশকাত হা/১৪৩৯, আহ্মাদ
হা/ ১৩৬২২, মুস্তাদরাক
হা/ ১০৯১]।
মূলতঃ নওরোজ বা বছরের প্রথম দিন ; পালন করার রীতি ইসলামে নেই, এটা পার্সী মজুসীদের (অগ্নিউপাসক) অনুকরণ। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে : مَنْ
تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোন
সম্প্রদায়ের সাথে
সাদৃশ্য গ্রহণ
করে সে
তাদের দলভুক্ত’ [আবু দাউদ হা নং-৪০৩১, তাহক্বীক্ব মিশকাত হা নং-৪৩৪৭ সনদ সহীহ]। তাই যে কোন
নওরোজ সেটা
থার্টি ফাষ্ট
নাইট, পহেলা বৈশখ
(নববর্ষ) হোক কিংবা
হিজরী নববর্ষ
হোক, বিজাতীয় রীতি হিসেবে প্রতেকটি
ইসলামে সম্পূর্ণ
নিষিদ্ধ করা
হয়েছে। এ সম্পর্কে মুসলিম মনীষীদের বক্তব্য ন্মিনরূপ :
ক.
ফখরুদ্দীন উসমান বিন আলী যাইলায়ী বলেন : ‘নওরোজ ও মেলার নামে কিছু দেয়া নাজায়েয। এ দু’দিনের নামে প্রদত্ত হাদিয়া হারাম; বরঞ্চ কুফর’ [তিবয়ানুল
হাকায়িক : ৬/২২৮]।
খ.
ইমাম হাফস কবীর (রহ) বলেন :
নওরোজ বা বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে যদি কেউ একটা ডিমও দান করে, তবে তার ৫০ বৎসরের আমল থাকলে তা বরবাদ হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি নওরোজের দিন এমন কিছু খরিদ করল যা সে পূর্বে খরিদ করত না, এর মাধ্যমে সে যদি ঐ দিনকে সম্মান করতে চায় তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।
গ. ইমাম আহ্মাদ বলেন : কাফিরদের উৎসবে যোগদান করা, সেই দিন উপলক্ষে বেচা-কেনা করা ও উপহার বিনিময় করা হারাম [হাম্বলি ফিকক্বহ্ গ্রন্থ ; আল-ইক্বনা]।
ঘ. নববর্ষ উদযাপন করে আমরা যাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছি, তারা প্রকৃতপক্ষে আমাদের শত্রু। তারা কখনো আমাদের বন্ধু হবে না, যাবত আমরা আমাদের দীন ত্যাগ করে তাদের ধর্মের অনুসরণ না করি। তারা আমাদের দীন ও নবীকে নিয়ে উপহাস করে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন :
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَكُمْ هُزُوًا وَلَعِبًا مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَالْكُفَّارَ أَوْلِيَاءَ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِين﴾
অর্থ : ‘হে
মুমিনগণ! আহলে কিতাবদের
মধ্য থেকে
যারা তোমাদের
ধর্মকে উপহাস
ও খেলা
মনে করে, তাদেরকে এবং
অন্যান্য কাফেরকে
বন্ধু রূপে
গ্রহণ করো
না। আল্লাহ্কে ভয়
কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও’ [সূরা মায়িদাহ্ : ৫৭]।
ঙ. যে তাদের দিকে ধাবিত হবে সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন
: ﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِين﴾
অর্থ : ‘হে
মুমিণগণ! তোমরা ইহুদী
ও খ্রীষ্টানদেরকে
বন্ধু হিসাবে
গ্রহণ করো
না। তারা একে অপরের
বন্ধু। তোমাদের মধ্যে
যে তাদের
সাথে বন্ধুত্ব
করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ জালেমদেরকে
পথ প্রদর্শন
করেন না’ [সূরা মায়িদাহ্ : ৫১]।
সুতরাং তাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া, তাদের সমর্থন জানানো কিংবা কোন ধরণের সহায়তা করা নিজের দীনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। উপরোক্ত দলীল-প্রমাণাদী দেখা এাঁই প্রতীয়মান হয় যে, থার্টি ফাষ্ট নাইট, পহেলা বৈশখ (নববর্ষ), হিজরী নববর্ষ পালন করা শুধু হারাম নয় বরং ঐ দিবস উপলক্ষে কাউকে শুভেচ্ছা জানানো, কিংবা ঐ দিবস গুলো উপলক্ষে কোন অফার দিলে সেটা গ্রহণ করা, ঐ দিবস উপলক্ষে কেনা-বেচা করা, খাদ্য গ্রহণ করা হারাম ও ক্ষেত্র বিশেষ কুফরী।
২১. পহেলা বৈশাখ অনেকেরই বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় উৎসব / পূজা রয়েছে। যথা :
১. হিন্দুদের ঘটপূজা।
২. হিন্দুদের গণেশ পূজা।
৩. হিন্দুদের সিদ্ধেশ্বরী পূজা।
৪. হিন্দুদের ঘোড়ামেলা।
৫. হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তি পূজা-অর্চনা।
৬. হিন্দুদের গম্ভীরা পূজা।
৭. হিন্দুদের কুমীরের পূজা।
৮. হিন্দুদের অগ্নিনৃত্য।
৯. চাকমাদের বিজু উৎসব।
১০. হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপূজা।
১১. হিন্দুদের বউমেলা।
১২. হিন্দুদের মঙ্গলযাত্রা
১৩. হিন্দুদের সূর্য্যপূজা।
১৪. মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব।
১৫. মজুসি তথা অগ্নি পূজকদের নওরোজ।
১৬. হিন্দুদের চড়ক বা নীল পূজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লি¬ষ্ট মেলা।
১৭. ত্রিপুরাদের বৈসাবি মেলা [ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি]।
এখন যে সকল মুসলমান নামধারীরা পহেলা বৈশাখ পালন করে তাদের কাছে প্রশ্ন এখানেতো সব বির্ধমীদের পূজা মুসলমানদের জন্য কিছু আছে কি? যদি মুসলমান থাকতে চাই তাহলে পহেলা বৈশাখ পালন থেকে বিরত থাকা অবশ্যই প্রয়োজন।
২২. আমাদের করণীয়ঃ
সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নববর্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এজন্য যে, এতে নিম্নলেখিত চারটি শ্রেণির ইসলাম বিরোধী বিষয় রয়েছে :
১. শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সংগীত।
২. নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান।
৩. গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান।
৪. সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ।
এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে, নিজে এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে থাকা এবং মুসলিম সমাজ থেকে এই প্রথা উচ্ছেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো নিজ নিজ সাধ্য ও অবস্থান অনুযায়ী।
* এ প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে :
ক. এ বিষয়ে দেশের শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ব হবে আইন প্রয়োগের দ্বারা নববর্ষের যাবতীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
খ.
যেসব ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কর্তব্য হবে অধীনস্থদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এই নির্দেশ জারি করতে পারেন যে, তার প্রতিষ্ঠানে নববর্ষকে উপলক্ষ করে কোন ধরনের অনুষ্ঠান পালিত হবে না, নববর্ষ উপলক্ষে কেউ বিশেষ পোশাক পরতে পারবে না কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারবে না।
গ.
মসজিদের ইমামগণ এ বিষয়ে মুসল্লীদেরকে সচেতন করবেন ও বিরত থাকার উপদেশ দেবেন।
ঘ.
পরিবারের প্রধান এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়। (আল্লাহ চাহে তো সবাই এ কাজটুকু করতে পারি ইনশা-আল্লাহ)।
ঙ.
এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন।
২৩. উপসংহারঃ
অপসংস্কৃতি মুসলিম যুবসমাজের সিংহভাগকে এক অনিশ্চত গন্তব্যহীন মোহগ্রস্ত জীবনের পথে ঠেলে দিচ্ছে। বস্তাপচা সংস্কৃতির প্রধানতম শিকার হয়ে তারা ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জীবন থেকে একটি বছর খসে পড়ার মূল্যবান ক্ষণে আত্মজিজ্ঞাসা না করে হতভাগা মুসলিমগণ আনন্দ-উল্লাস করে পরকালকে ভুলে যাচ্ছে। আল্লাহকে না ডেকে মুশরিকদের মত হাস্যকর ভাবে বৈশাখকে ডাকছে। যার ফলে প্রতি বছরই বৈশাখ আগমন করে কাল বৈশাখী ঝড় নিয়ে। বৈশাখকে আমরা না ডাকলেও আসবে। তবুও বৈশাখের রবকে না ডেকে অযথা বৈশাখকে ডেকে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করছি। অতঃএব হে তরুন মুসলিম সমাজ! অপসংস্কৃতির বেড়াজাল ছিন্ন করে ফিরে এসো মহা সত্যের পথে। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল করুন, আমীন।
No comments:
Post a Comment