Wednesday, 13 November 2019

সীরাতুর রাসূল (সাঃ)। পর্ব : ৫। রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণেই রয়েছে উত্তম আদর্শঃ


বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
রাসূল (সাঃ)-এর সীরাত (জীবন-চরিত) তথা জীবনেতিহাস। পর্ব : পাঁচ।


যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে 
তাদের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ
সংকলনে : আব্দুস সালাম হুসাইন আলী
০১. ভূমিকাঃ
আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কর্তৃক প্রদত্ত রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণের মধ্যেই মানব জাতির ইহ-লৌকিকের সফলতা ও পর-লৌকিকের মুক্তি এবং উত্তম আদর্শ হচ্ছেন মুহাম্মাদ (সাঃ)। তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারই অনুসরণ বাধ্যতামূলক।

০২. আল-কুরআনের আয়াত ও অনুবাদঃ
﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوْا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا
তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ [সূরা আহযাব : ২১]

০৩. ভ্যাখ্যাঃ
৩/১. তাফসীর ইবন কাছীরঃ
এ আয়াত ঐ বিষয়ের উপর বড় দলীল যে, রাসূল (সাঃ)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণের যোগ্য। আহযাবের যুদ্ধে তিনি যে ধৈয্য, সহনশীলতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, যেমন আল্লাহর পথের প্রস্তুতি, জিহাদের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ এবং কাঠিন্যের সময়ও আসমানী সাহায্যের আশা যে তিনি করেছিলেন, এগুলি নিঃসন্দেহে এ যোগ্যতা রাখে যে, মুসলিমরা এগুলিকে জীবনের বিরাট অংশ বানিয়ে নেয়। আর যেন আল্লাহর প্রিয় রাসূল (সাঃ)-কে নিজেদের জন্য উত্তম নমুনা বানিয়ে নেয় এবং তাঁর গুণাবলী যেন নিজেদের মধ্যে আনয়ন করে। এ কারণেই ভয় ও উদ্বেগ প্রকাশকারী লোকদের জন্য আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা‘আলা কুরআনুল কারীমে ঘোষণা দেন :
﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
তোমরা আমার নাবীর অনুসরণ করছ না কেন? আমার রাসূলতো তোমাদের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছেন। তার নমুনা তোমাদের সামনে বিদ্যমান ছিল। তোমাদেরকে তিনি ধৈর্য ও সহনশীলতা অবলম্বনের কথা শুধু শিক্ষাই দিচ্ছেননা, বরং কাজে অটলতা, ধৈর্য এবং দৃঢ়তা তিনি নিজের জীবনেও ফুটিয়ে তুলেছেন।
﴿لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوْا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا
তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। [তাফসীল ইবন কাছীর, বাংলা, ড. মুজীবুর রহমান, ৬/৬৬৬-৬৬৭]।

৩/২. তাফসীর যাকারিয়াঃ
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ অনুকরণের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্যতাকে মূলনীতিরূপে বর্ণনা করা হয়েছেবলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম অনুপম আদর্শ রয়েছে'এদ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীসমূহ ও কার্যাবলী উভয়ই অনুসরণের হুকুম রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়[দেখুন, মুয়াস্‌সার]

৩/৩. তাফসীর আহসানুল বায়ানঃ
অর্থাৎ হে মুসলিমগণ এবং হে মুনাফিকদল! তোমাদের জন্য রসূল (সাঃ)-এর ব্যক্তিত্বে উত্তম আদর্শ রয়েছে, অতএব তোমরা জিহাদে এবং ধৈর্যশীলতা ও পদদৃঢ়তায় তাঁরই অনুসরণ করমহানবী (সাঃ) ক্ষুধার্ত থেকে জিহাদ করেছেন; এমনকি তাঁকে পেটে পাথর বাঁধতে হয়েছেতাঁর চেহারা মুবারক যখম হয়েছে, তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গেছে, তিনি নিজ হাতে পরিখা খনন করেছেন এবং প্রায় এক মাস শত্রু বাহিনীর অবরোধের মুখে সাহসিকতার সাথে মুকাবেলা করেছেনউক্ত আয়াত যদিও আহযাব যুদ্ধের সময় অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে যুদ্ধের সময় বিশেষভাবে রসূল (সাঃ)-এর আদর্শকে সামনে রাখা ও তাঁর অনুসরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছেকিন্তু এটি একটি ব্যাপক আদেশঅর্থাৎ নবী (সাঃ)-এর সকল কথা, কাজ ও অবস্থাতে মুসলিমের জন্য তাঁর অনুসরণ আবশ্যিক; তা ইবাদত সম্পর্কিত হোক বা সমাজ সম্পর্কিত, জীবিকা সম্পর্কিত হোক বা রাজনীতি সম্পর্কিত, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁরই নির্দেশ পালন করা একান্ত কর্তব্যসূরা হাশরের ৫৯:৭ নং আয়াত এবং সূরা আলে ইমরানের ৩:৩১ নং আয়াতের দাবীও তাই

এই আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, রসূল (সাঃ)-এর আদর্শে ঐ ব্যক্তি আদর্শবান হবে, যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী এবং যে বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে থাকেবর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান উক্ত দুই গুণ থেকে বঞ্চিতযার ফলে তাদের অন্তরে রসূল (সাঃ)-এর আদর্শের কোন গুরুত্ব নেইএদের মধ্যে যারা দ্বীনদার তাদের আদর্শ হল পীর ও বুযুর্গরাআর যারা দুনিয়াদার বা রাজনৈতিক তাদের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক হল পাশ্চাত্যের নেতারারসূল (সাঃ)-এর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার কথা এরা মুখে খুব দাবী করে, কিন্তু কার্যতঃ তাঁকে নিজেদের আদর্শ, নেতা ও পথপ্রদর্শক মানার ব্যাপারে অধিকাংশই পিছনেসুতরাং এ বিচার আল্লাহই করবেন

৩/৪. তাফসীর ফাতহুল মাজীদঃ
মুসলিমদের উত্তম আদর্শের প্রতীক একমাত্র নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)তাই তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে প্রত্যেক মুসলিম জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শ গ্রহণ করবেআজ বিভিন্ন দল, তরীকা ও সম্প্রদায়ের অনুসারীরা তাদের নেতা ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির আদর্শের দিকে আহ্বান করে থাকেকখনো একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ বর্জন করে অন্য কোন ব্যক্তির আদর্শ গ্রহণ করতে পারে নাকেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবনাদর্শে রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তিপৃথিবীতে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার সকল কথা ও কাজ পালনীয় ও অনুসরণীয়, কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতীতএকমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণযোগ্যপ্রতিটি স্থান, কাল ও পাত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ অনুসরণ করলে মুসলিমরা আবার সে স্বর্ণ যুগে ফিরে যেতে পারবেরাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেভাবে কথা বলেছেন, কাজ করেছেন, এমনকি যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অবশ্যই অনুসরণীয়রাসূল (সাঃ) বিপদে কখনো বিচলিত হননিবরং সর্বদা আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করেছেনআল্লাহ তাআলার বাণী:
﴿أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ ط مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَآءُ وَالضَّرَّآءُ وَزُلْزِلُوْا حَتّٰي يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مَعَهُ مَتٰي نَصْرُ اللّٰهِ ط أَلَآ إِنَّ نَصْرَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ
তোমরা কি ধারণা করেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত সংকটময় অবস্থা এখনো তোমাদের ওপর আসেনিতাদেরকে বিপদ ও দুঃখ স্পর্শ করেছিল এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে তুলা হয়েছিলএমনকি রাসূল ও তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা শেষপর্যন্ত বলেছিল, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী[সূরা বাকারাহ : ২১৪]।

নাফি‘ (রাহি.) হতে বর্ণিত যে, ইবনু উমার (রাযি.) তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনু আবদুল্লাহ এর নিকট গেলেন যখন তাঁর (হাজ্জ যাত্রার) বাহন প্রস্তুত, তখন তাঁর ছেলে বললেন: আমার আশংকা হয় এ বছর মানুষের মধ্যে লড়াই হবে, তারা আপনাকে কাবায় যেতে বাধা দেবেকাজেই এবার নিবৃত্ত হওয়াটাই উত্তমতখন ইবনু উমার (রাযি.) বললেন: আল্লাহ তাআলার রাসূল (সাঃ) একদা রওনা হয়েছিলেন, কুরাইশ কাফিররা তাঁকে বাইতুল্লাহ যেতে বাধা দিয়েছিলআমাকেও যদি বাইতুল্লাহ যেতে বাধা দেয়া হয়, তবে আল্লাহ তাআলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা করেছিলেন আমিও তাই করবকেননা নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ[সূরা আহযাব : ২১] এরপর তিনি বললেন : তোমরা সাক্ষী থেকো, আমি উমরাহর সাথে হাজ্জ এর নিয়ত করলামনাফি‘ (রাহি.) বলেন : তিনি মক্কায় উপনীত হয়ে উভয়টির জন্য মাত্র একটি তাওয়াফ করলেন[সহীহ বুখারী হা : ১৬৩৯]।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ তারাই মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিতে পারবে যারা পরকালের সফলতা কামনা করেতাই আমাদের উচিত হবে যদি আমরা পরকালীন কল্যাণ ও সফলতা চাই তাহলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শ অনুরসণ করবকোন কাজ করার পূর্বে ভেবে দেখব, এ কাজ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) করেছেন কিনাআর করে থাকলে তিনি তা কিভাবে করেছেন সেভাবেই করতে হবে

০৪. আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জীবনের সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কর্মপদ্ধতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির অনুসরণ করতে হবেকেননা তিনি হলেন মানুষের জন্য উত্তম আদর্শ এবং অনুসরণীয় ব্যক্তি

1 comment: