Tuesday, 10 December 2019

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহিঃ)-এর জীবন ও কর্মঃ


উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, বাংলা ভাষায় বুখারী’-এর প্রথম অনুবাদক ; 

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহিঃ)-এর জীবন ও কর্মঃ




বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা, খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, ইসলামী চিন্তাবিদ এবং বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহিঃ) সাহেবকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন 'হরকাতুল জিহাদ' এর প্রতিষ্ঠাতা ও জঙ্গিনেতা হিসেবে উল্লেখ করে ভুমি দস্যু বাবুলের যমুনা টিভিতে মিথ্যা, বানোয়াত ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ উপস্থাপনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি
আসুন জেনে নেইঃ কে ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহিঃ)?
মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর পরগনার লৌহজং থানার ভিরিচ খাঁ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৩২৬ বাংলা সনের পৌষ মাসে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক
তাঁর বাবার নাম আলহাজ্ এরশাদ আলীতিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার মাকে হারানফলে নানা বাড়িতে নানি ও খালার কাছে তাঁর শৈশব কাটে
গ্রামের মক্তবে কিছুদিন পড়ার পর সাত বছর বয়সে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জামেয়া ইউনুসিয়া শায়খুল হাদিস মাদ্রাসায় ভর্তি হনসেখানে মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর তত্ত্বাবধানে চার বছর লেখাপড়া করেন
শায়খুল হাদিস ছয় দশকেরও বেশি সময় হাদিসের চর্চা ও পাঠদানের সঙ্গে জড়িত ছিলেনতিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব
চারদলীয় জোট প্রতিষ্ঠাকালীন তিনি ছিলেন অন্যতম শীর্ষ নেতা
১৯৯৩ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে যে লংমার্চ হয়েছিল তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শায়খুল হাদিস
মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ জামেয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসাসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন
মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর পরগনার লৌহজং থানার ভিরিচ খাঁ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে ১৩২৬ বাংলা সনের পৌষ মাসে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন শায়খুল হাদিস
তাঁর বাবার নাম আলহাজ্ এরশাদ আলীতিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার মাকে হারানফলে নানা বাড়িতে নানি ও খালার কাছে তাঁর শৈশব কাটে
গ্রামের মক্তবে কিছুদিন পড়ার পর সাত বছর বয়সে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জামেয়া ইউনুসিয়া শায়খুল হাদিস মাদ্রাসায় ভর্তি হনসেখানে মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর তত্ত্বাবধানে চার বছর লেখাপড়া করেন
১৯৩১ সালে ঢাকা বড় কাটারা মাদ্রাসায় ভর্তি হনসেখানে কৃতিত্বের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ধাপ দাওরায়ে হাদিস পাস করেন
এ সময়ে আল্লামা জফর আহমদ উছমানি, আল্লামা রফিক কাশ্মিরী, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. প্রমুখ বিজ্ঞ হাদিস বিশারদদের কাছে কুরআন হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন
১৯৪৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য শায়খুল হাদিস ভারতের বোম্বের সুরত জেলার ডাভেল জামেয়া ইসলামিয়ায় ভর্তি হন
সেখানে মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানি রহ. ও মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী প্রমুখের কাছে শিক্ষা লাভ করেনশাব্বির আহমাদ উসমানি রহ. বুখারি শরিফের যে আলোচনা করেন তা তিনি নোট করে রাখেন
পরবর্তী জীবনে এ ব্যাখ্যাই তার জীবনের বিশেষ সম্বল হয়ে ওঠেসর্বশেষ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে মাওলানা ইদরিস কান্ধলবি রহ. এর তত্ত্বাবধানে তাফসির বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন
পরে তার ওস্তাদ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর নির্দেশে ঢাকায় চলে আসেন
ভারতের ডাভেলে জামেয়া ইসলামিয়ায় উচ্চ শিক্ষা শেষে সেখানে অধ্যাপনার দায়িত্ব নেয়ার আহবাদ জানানো হলেও তার মুরুব্বিদের নির্দেশে ঢাকার বড় কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন
সেখানে দক্ষতার সঙ্গে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন১৯৫২ সালে লালবাগ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন১৯৫২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বুখারি শরিফসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের পাঠদান করেন
কৃতিত্বের সঙ্গে বুখারি শরিফের অধ্যাপনায় ব্যাপৃত থাকায় তাকে শায়খুল হাদিসখেতাব দেয়া হয়এ সময়েই বুখারি শরিফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়লালবাগে অধ্যাপনার ফাঁকে ১৯৭১ সাল থেকে দুই বছর বরিশাল জামিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন
১৯৭৮ সালের এপ্রিলে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে বুখারি শরিফের অধ্যাপনা করেন
শায়খুল হাদিস তিন বছর ওই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৬ সালে জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া নামে মোহাম্মাদপুরে মোহাম্মাদী হাউজিং এ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন
১৯৮৮ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি মোহাম্মাদপুরে সাত মসজিদের পাশে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নামে স্থানান্তরিত হয়তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুরুব্বি ও শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন
তিনি মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যায়ও প্রিন্সিপাল হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেনজামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শায়খুল জামিয়াশায়খুল হাদীসহিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিসহিসেবে হাদিসের খেদমত করেন
তিনি হাদিসের একজন গবেষক হিসেবে অধ্যাপনার পাশাপাশি সারা দেশেই ইসলামের দাওয়াত নিয়ে হাজির হনতার বয়ান শুনতে হাজার হাজার লোক জমায়েত হতোতিনি লালবাগ কেল্লা জামে মসজিদ, মালিবাগ শাহী মসজিদ ও আজিমপুর স্টেট জামে মসজিদে খতিব হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন
জাতীয় ঈদগাহেও ইমামতি করেছেন বেশ কয়েক বছরতিনি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেনএছাড়াও তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন
ছাত্রজীবনেই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে শায়খুল হাদিস বিশেষ ভূমিকা রাখেনএ সময় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের কারণে নির্যাতন সহ্য করেনপাকিস্তান আমলে মাওলানা আতহার আলী, মুফতি শফী রহ. প্রমুখের সঙ্গে নেজামে ইসলাম পার্টির কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সে সময় উলামায়ে কেরামের একমাত্র দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন১৯৮১ সালে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ডাকে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন
১৯৮২ সালে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সফরসঙ্গী ও মুখপাত্র হিসেবে ইরান, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্য সফর করেনএ সফরে মুসলিম উম্মাহর শান্তি, স্থিতিশীলতা ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধতার ব্যাপারে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনা করেন
ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের জন্য আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন
১৯৮৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনএ সময় তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন১৯৮৯ সালে ৮ ডিসেম্বর খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠা করেন
১৯৯১ সালে সমমনা ইসলামি কয়েকটি দল নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠন করেনতিনি এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেনতার নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১টি আসন (সিলেট-৫) লাভ করে
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে শায়খুল হাদিস মিছিল, মিটিং ও আন্দোলনে সক্রিয় হন১৯৯৩ সালের ২-৪ জানুয়ারি বাবরী মসজিদ পুনঃ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে যশোর বেনাপোল হয়ে অযোধ্যা অভিমুখে লংমার্চের নেতৃত্ব দেনএ লংমার্চে পাঁচ লক্ষাধিক লোক স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশ নেয়
শায়খুল হাদিস বাবরী মসজিদ ভাঙার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমরাওকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষনা করেন এবং বিমান বন্দর ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেনফলে তৎকালীন সরকার ৯ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে৮ মে ১৯৯৩ সালে সরকার শায়খুল হাদিসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়
শায়খুল হাদিসের অনন্য অবদান হলো, বুখারি শরিফের বঙ্গানুবাদপ্রথমে সাত খণ্ডে ও বর্তমানে ১০ খণ্ডে সমাপ্ত বুখারি শরীফের এ বিশদ ব্যাখ্যাগ্রন্থটি আলেম ও সাধারণ শিক্ষিত সবার কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছেবুখারি শরিফ অনুবাদ ১৯৫২ সালে হজের সফরে শুরু করেন১৬ বছরের কঠোর সাধনায় তা সমাপ্ত করেনএর অনেক অংশই তিনি রওজা শরিফের পাশে বসে অনুবাদ করেন
ছাত্রজীবনে বুখারি শরিফের উর্দু ব্যাখ্যা (শরাহ) লিখেন১৮০০ পৃষ্ঠার এ বৃহৎ গ্রন্থটি ফজলুল বারি শরহে বুখারিনামে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত হয়েছেমুসলিম শরিফ ও অন্যান্য হাদীসের ছয় কিতাবনামে অনবদ্য এক হাদিসগ্রন্থ সংকলন করেন
এতে বিষয়ভিত্তিক হাদিসসমূহ অনুবাদসহ উপস্থাপন করা হয়েছেএর দুই খণ্ড প্রকাশিত হয়েছেএছাড়া মছনবীয়ে রূমীর বঙ্গানুবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলাম, কাদিয়ানি মতবাদের খণ্ডন, মাসনূন দোয়া সম্বলিত মুনাজাতে মাকবূল, সত্যের পথে সংগ্রাম এসব বইয়ের রচয়িতাও তিনি
তিনি দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন২০১২ সালের ৮ আগস্ট, বুধবার দুপুর সাড়ে বারোটায় আজিমপুরে নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছরতিনি পাঁচ ছেলে, আট মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ আত্মীয়-স্বজন, অসংখ্য রাজনৈতিক সহকর্মী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন
দেশে ও দেশের বাইরে তাঁর অসংখ্য ছাত্র রয়েছেতার পরিবারের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ প্রায় ৭০ জন সদস্য কোরআনে হাফেজ
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যেন, এদেশের ইসলামের এই প্রচারক, হাদীস বিশারদ ও শিক্ষককে জান্নাতে সর্বোচ্চ মাকাম দান করেনআমীন

No comments:

Post a Comment